মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় চীন কোন দিকে?

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় চীন কোন দিকে?
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনায় চীন কোন দিকে?

দীর্ঘদিন ধরে কাশ্মীর উপমহাদেশের এক স্পর্শকাতর ও বিরোধপূর্ণ ভূখণ্ড—যেখানে ভারত, পাকিস্তান ও চীন, তিন পক্ষেরই ভূরাজনৈতিক স্বার্থ জড়িত। ২০১৯ সালে ভারত কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের সিদ্ধান্তের পর এই অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা এক নতুন মাত্রায় পৌঁছায়। সর্বশেষ ২২ এপ্রিল ২০২৫, ভারত-দখলকৃত কাশ্মীরে এক হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় আবারও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েন চরমে উঠেছে। এর ঠিক পরেই পেহেলগামে সংঘটিত হামলার রেশ কাটতে না কাটতেই সীমান্ত এলাকায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বিমান হামলার ঘটনা ঘটে, যেখানে ইসলামাবাদের দাবি অনুযায়ী পাঁচটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয় এবং এতে অন্তত আটজন নিহত ও ৩৩ জন আহত হন, যাদের মধ্যে কয়েকজন বেসামরিক নাগরিকও ছিলেন।

এই ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে সামরিক প্রস্তুতি তীব্রতর হয়, এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেও দ্রুত অবনতি ঘটে। ভারত পাকিস্তানি নাগরিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়, সীমান্ত বন্ধ করে এবং সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে; অন্যদিকে পাকিস্তানও ভারতীয় কূটনীতিক বহিষ্কার ও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য স্থগিতের মতো কঠোর পদক্ষেপ নেয়। প্রথম হামলার দায় প্রথমে স্বীকার করলেও পরে অস্বীকার করে কাশ্মীরভিত্তিক সশস্ত্র সংগঠন ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ (TRF)। তারা দাবি করে, ভারত সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিজেই এ হামলা ঘটিয়েছে। পাকিস্তান সরকারও হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে জরুরি নিরাপত্তা বৈঠক আহ্বান করেছে।

সামরিক ও কূটনৈতিক এই উত্তেজনা এখন শুধু দুই দেশের সরকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—চরম আতঙ্কে দিন কাটছে সীমান্তবর্তী সাধারণ জনগণের। চীন, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়েও ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়াসে এক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শান্ত থাকার আহ্বান জানালেও বাস্তবতায় যুদ্ধের আশঙ্কা দিনদিন ঘনিভূত হচ্ছে। বিশেষ করে ২০১৯ সালের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। সেই সময় ভারত-পাকিস্তান কার্যত পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল বলে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন। বর্তমান প্রেক্ষাপট সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে আবারও সামনে নিয়ে এসেছে—যে কোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ, যা কেবল দক্ষিণ এশিয়া নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।

সংযম ও সংলাপের আহ্বান

চীন উভয় দেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—উত্তেজনা প্রশমনে সংযম বজায় রাখুন এবং সমস্যার সমাধান হোক সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে। তারা বলেছে, দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সংঘর্ষ শুধু তাদের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলেই অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

বেইজিং একটি নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত চায় এবং একে অপরকে দোষারোপ না করে আলোচনা ও কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে। চীন মনে করে, যেহেতু তাদের ভারতের সঙ্গেও এবং পাকিস্তানের সঙ্গেও দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, তাই উত্তেজনার প্রভাব সরাসরি তাদের ওপরও পড়তে পারে।

পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন, তবে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টাও

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের কৌশলগত অবস্থান অনেকটাই পাকিস্তানপন্থী। চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে ফোনালাপে বলেন, পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু ও কৌশলগত অংশীদার হিসেবে চীন তাদের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত বৈধ উদ্বেগগুলোকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করে এবং সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ রক্ষায় পাশে থাকবে।

তবে তিনি একইসঙ্গে আশা প্রকাশ করেন যে, দুই পক্ষই সংযত আচরণ করবে, পরস্পরের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব দেখাবে এবং উত্তেজনা হ্রাসে একযোগে কাজ করবে।

ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া গবেষণা কেন্দ্রের উপ-পরিচালক লিন মিনওয়াং মনে করেন, চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য আসলে ভারতের প্রতি এক ধরনের সতর্কবার্তা। চীন চায় না ভারত পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করুক। ইসলামাবাদকে তারা শুধু নয়াদিল্লির পাল্টা ভারসাম্য হিসেবে নয়, বরং নিজস্ব কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে, যার মাধ্যমে চীন নিজস্ব আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষা করতে চায়।

তবে সবকিছুর পরও চীন চেষ্টা করছে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে থাকতে। আল-জাজিরার সাংবাদিক শাইমা ঝো ই ই বলছেন, বেইজিং একদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে গভীর কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখছে, অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়লে তা যেন সীমান্তে নতুন জটিলতা তৈরি না করে, সেই হিসাবও কষছে। কারণ, চীন-ভারত সীমান্তের ইতিহাস বহু পুরোনো এবং দুই দেশের মধ্যে ৩,৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ এক বিরোধপূর্ণ সীমান্ত রয়েছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত জোট

চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি গভীর কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে উঠেছে, যার সবচেয়ে স্পষ্ট প্রকাশ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC)। এটি ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং করিডোরটি পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের মতো স্পর্শকাতর অঞ্চল অতিক্রম করায় পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা চীনের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে পাকিস্তানের প্রায় ৮০ শতাংশ অস্ত্রই সরবরাহ করেছে চীন, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিমান ও সাবমেরিন। এতে পাকিস্তানের সামরিক সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চীন পাকিস্তানের পাশে রয়েছে। ২০১৯ সালে কাশ্মীর পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের যে বৈঠক চীন আহ্বান করেছিল, তা তার প্রমাণ।
চীনের এই অবস্থানের পেছনে রয়েছে একটি বড় কৌশলগত হিসাব—তারা ভারতকে তাদের প্রধান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে। সীমান্তে চলমান উত্তেজনা (যেমন ২০২০ সালের লাদাখ সংঘর্ষ) ও অন্যান্য ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় পাকিস্তানকে পাশে রাখা চীনের জন্য দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ঠেকানোর কৌশলের অংশ।

চীন-ভারত উত্তেজনার পটভূমি

কাশ্মীর সংকট কিংবা ভারত-পাকিস্তান সংঘাত—উভয়ের পেছনেই ছায়ার মতো রয়েছে চীন ও ভারতের মধ্যকার টানাপোড়েন। এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরেই ইতিহাস, সীমান্ত এবং ভূরাজনীতির নানা জটিলতা দ্বারা প্রভাবিত:

সীমান্ত বিরোধ:
চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্তবিরোধ বহু পুরোনো। ৩৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (LAC) আজও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। উত্তেজনার প্রধান দুটি অঞ্চল হলো আকসাই চিন (যা চীনের নিয়ন্ত্রণে, তবে ভারতের দাবি অনুযায়ী সেটি তাদের অংশ) এবং অরুণাচল প্রদেশ (ভারতের নিয়ন্ত্রণে, তবে চীন এটিকে তিব্বতের অংশ বলে দাবি করে)।
১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের সময় চীন আকসাই চিনের নিয়ন্ত্রণ নেয়, যা পরবর্তীকালে সম্পর্কের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনার বীজ বপন  করে।

ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা:
চীন মনে করে, ভারত এখন একটি ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক শক্তি, যার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদে আগ্রহ এবং যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া নিয়ে গঠিত কোয়াড নিরাপত্তা জোটে সক্রিয় অংশগ্রহণ চীনের জন্য হুমকি।
চীনের মতে, যুক্তরাষ্ট্র কোয়াডকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চায়। সেই বিপরীতে চীন নিজে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের মতো উদ্যোগের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারে মনোযোগী।

অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব:
চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য মোটামুটি শক্ত অবস্থানে থাকলেও (২০২৪ সালে যা ছিল ১৩৫ বিলিয়ন ডলার), ভারতে ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে—প্রায় ৮৫ বিলিয়ন ডলারের মতো।
বিশেষ করে প্রযুক্তি খাতে চীনা বিনিয়োগ ভারতে নিরাপত্তা উদ্বেগ তৈরি করেছে। এর জের ধরেই গালওয়ান উপত্যকার সংঘর্ষের পর ভারত টিকটকসহ বেশ কয়েকটি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত যোগেশ গুপ্ত বলেন, ‘১৯৪৯ সালে চীনের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তারা ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থান ও অগ্রগতিকে নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে এবং একধরনের বিরূপ মনোভাব পোষণ করে।’

মার্কিন-ভারত সম্পর্কের অগ্রগতি এবং কাশ্মীর সংকট

গত দুই দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের সম্পর্ক ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়েছে, যা মূলত চীনের উত্থানকে প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে। এই সম্পর্কের গভীরতা কাশ্মীরের ২০২৫ সালের সংকটের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে চীনকে প্রতিরোধ করতে সাহায্য করছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ‘লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ এগ্রিমেন্ট’ (এলইএমওএ) এবং ‘কমিউনিকেশনস কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট’ -এর মতো চুক্তি, যা দুই দেশের সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই চুক্তিগুলির মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা তথ্যের আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যৌথ সামরিক মহড়া পর্যন্ত সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত।

‘কোয়াড’ জোটের আওতায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ভারত মহাসাগরে চীনের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী সামুদ্রিক প্রতিরোধী শক্তি হিসেবে দেখতে চায়, যা বেইজিংয়ের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। ভারতকে সমর্থন জানিয়ে, যুক্তরাষ্ট্র কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার পর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘কথিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার’ আহ্বান জানিয়েছে।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও পাকিস্তানকে হামলার তদন্তে সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানিয়ে, ভারতের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টিন ফেয়ার বলেন, ভারতের প্রতিক্রিয়া থেকে সরে আসতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে কোনো চাপ দেবে না। ভারতকে তার নিজস্ব পথ নির্বাচন করার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

অতএব, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক উত্তপ্ত হলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের পাশে দাঁড়াবে এবং গোয়েন্দা ও সামরিক সহায়তা প্রদান করবে, যা ভারতের পাকিস্তান-সংক্রান্ত কঠোর অবস্থানকে আরো দৃঢ় করবে এবং চীনের শান্তির আহ্বানগুলোকে দুর্বল করবে।

এদিকে, চীনা বিশ্লেষকরা মনে করেন, কাশ্মীর সংকটকে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়াতে তার অবস্থান আরো শক্তিশালী করার জন্য ব্যবহার করছে, যা চীনকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে, চীন পাকিস্তানকে আরও বেশি সমর্থন দিয়ে থাকে, যাতে মার্কিন প্রভাব মোকাবিলা করা যায়।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক আসফানদিয়ার মির মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান এক উত্তপ্ত যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যা ২০১৯ সালের চেয়েও আরো তীব্র হতে পারে। চীন-পাকিস্তান সম্পর্ক শক্তিশালী এবং চীন পাকিস্তানকে আরও সামরিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত, যাতে তারা ভারতের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে।

ভারতের কূটনীতিক ইউগেশ গুপ্ত বলেন, চীন পাকিস্তানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি, ভারী অস্ত্র এবং আধুনিক যুদ্ধজাহাজ সরবরাহ করছে, যা ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা শক্তি বাড়াতে সহায়ক।

চীনের অবস্থানের নেপথ্যে যে কারণগুলো

যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা:
পাকিস্তানকে পাশে রেখে চীন মূলত যুক্তরাষ্ট্র-ভারত জোটের পাল্টা ভারসাম্য তৈরি করতে চায়। দুই দেশের মধ্যে যে অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি হয়েছে, তা চীনের জন্য আরব সাগরে সরাসরি প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে, যা মালাক্কা প্রণালীর ওপর নির্ভরতা কমায়। উল্লেখ্য, মালাক্কা প্রণালী মার্কিন প্রভাবাধীন অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। তাই এই করিডোর চীনের জন্য কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনৈতিক স্বার্থের সুরক্ষা:
কাশ্মীরে সামরিক উত্তেজনা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (CPEC) চীনের বিপুল বিনিয়োগের জন্য সরাসরি হুমকি। এই প্রকল্পের বেশ কিছু অংশ পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যায়, আর এতে চীনের বিনিয়োগ প্রায় ৪৬ বিলিয়ন ডলার। ফলে ওই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, সংঘাত আরও ছড়িয়ে পড়লে ভারত-চীন বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে। ভারত চীনের অন্যতম বড় রপ্তানি বাজার। এ অবস্থায় চীন কোনও পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে যেতে চায় না, কারণ এতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি আঞ্চলিক প্রকল্পগুলোতেও বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে।

আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা:
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক গবেষক লিও ঝোংগি মনে করেন, চলমান উত্তেজনার মধ্যেও চীন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। এতে শুধু দুই দেশের জন্য নয়, গোটা অঞ্চলের জন্য একটি স্থিতিশীল ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের সহায়ক।
তিনি আরও বলেন, চীন তার বৈদেশিক স্বার্থ রক্ষায় কঠোর অবস্থান নেবে—বিশেষ করে পাকিস্তানে থাকা চীনা প্রকল্প ও নাগরিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে।
লিওর ভাষায়, বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির মতো গোষ্ঠীগুলো, যাদের পেছনে ভারতের মদদের অভিযোগ রয়েছে (যদিও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ মেলেনি), অতীতে একাধিকবার চীনা প্রকল্প ও নাগরিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ কারণে পাকিস্তানে চীনের উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারে আগ্রহ:
বিশ্বমঞ্চে দায়িত্বশীল শক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চায় চীন। সে লক্ষ্যে চীন বারবার শান্তিপূর্ণ সংলাপের আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবে ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থন চীনের কূটনৈতিক ভূমিকাকে অনেকটাই সীমিত করে দিচ্ছে। ভারতের চোখে পাকিস্তানের মিত্র হওয়ায় চীনকেও সংকটের অংশ হিসেবে দেখা হয়।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর ভাষ্য অনুযায়ী, ‘চীনের বৃহত্তর ভূমিকা নেওয়ার বিষয়ে নয়াদিল্লি বা ওয়াশিংটনের আগ্রহ খুবই কম। বরং যুক্তরাষ্ট্র চীন ও পাকিস্তানকে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে, যা চীনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যাহত করতে পারে।’

চীনের অবস্থান ও আঞ্চলিক উত্তেজনা

যুক্তরাষ্ট্রের ভারত-সমর্থন এবং চীন-পাকিস্তান জোট আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি করছে—এমনটাই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তাঁদের মতে, এই প্রেক্ষাপটে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে, যা সরাসরি চীন ও পাকিস্তানের বিপরীতে একটি জোট তৈরি করছে।

যদি যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কঠোর অবস্থানকে উৎসাহ দিয়ে যায়, তবে এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় চীন সীমান্তে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে পারে বা পাকিস্তানকে আরও সরাসরি সহায়তা দিতে পারে। এতে করে অঞ্চলটিতে সামরিক উত্তেজনা আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে চীন রাশিয়া বা জাতিসংঘের মতো তৃতীয় পক্ষের ওপর নির্ভর করতে পারে।

চীনের বিশ্লেষক ওরাং ওয়াং জানিয়েছেন, হিমালয়ের সীমান্ত-উত্তেজনা, সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ এবং পারস্পরিক ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো ঘটনার পর চীন সম্প্রতি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এসবের পেছনে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের ভূরাজনৈতিক চাপও কাজ করেছে।

চীনের সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী ভূমিকাসংক্রান্ত প্রশ্নে ওয়াং বলেন, চীন বহু দশক ধরেই পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ২০১৫ সাল থেকে যেকোনো পরিস্থিতিতে তাদের পাশে থেকেছে। এ কারণেই প্রশ্ন উঠছে—চীন কি এবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতায় ভূমিকা রাখবে বা মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী হবে?

তবে বিশ্লেষক লিন মিনওয়াং এই সম্ভাবনাকে খুব একটা বাস্তবসম্মত মনে করছেন না। তাঁর ভাষায়, ‘বর্তমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চীনের ভূমিকা সীমিতই থাকবে। কারণ, মধ্যস্থতার জন্য উভয় দেশের সম্মতি প্রয়োজন, আর ভারতের পক্ষ থেকে চীনের এমন চেষ্টাকে গ্রহণ করার সম্ভাবনা খুবই কম—বিশেষ করে যখন বিষয়টি পাকিস্তানের অবস্থান ব্যাখ্যার সঙ্গে জড়িত।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা