বিশ্বের অন্যতম বড় শিপিং কোম্পানি ডেনমার্কভিত্তিক মার্সক গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের সাম্প্রতিক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মার্সকের সংশ্লিষ্টতা কীভাবে?
ডেনমার্কের কোপেনহেগেনভিত্তিক মার্সক গ্রুপ বিশ্বজুড়ে শিপিং ও লজিস্টিক খাতে অন্যতম প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান। ১৯০৪ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটির বর্তমানে ৬৭৫টি জাহাজ ১৩০টির বেশি দেশে পণ্য পরিবহন করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে—ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর যুদ্ধপ্রস্তুতি ও হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনে সহায়তা করেছে তারা।
অস্ত্র পরিবহনের অভিযোগ ও প্রমাণ
মানবাধিকার সংগঠনগুলো জানিয়েছে, গাজায় ব্যবহৃত ১০০টিরও বেশি ওশকশ সাঁজোয়া যান মার্সকের জাহাজে করে ইসরায়েলে পাঠানো হয়েছে। ২০২৪ সালেই প্রায় ৬০ লাখ পাউন্ড ওজনের সামরিক সরঞ্জাম ইসরায়েলে পৌঁছেছে, যার শিপিং ডকুমেন্টগুলোতে তথ্য ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে।
স্পেন সরকার ইসরায়েলি জাহাজে অস্ত্র পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা দিলেও দেশটির আলজেসিরাস বন্দর হয়ে এক হাজারের বেশি কার্গো ইসরায়েলে পৌঁছেছে। এপ্রিলে মার্সক নিজেই স্বীকার করেছে, তারা এফ-৩৫ স্টেলথ ফাইটার জেটের যন্ত্রাংশ পরিবহন করেছে।
বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভ ও প্রভাব
এই অভিযোগ সামনে আসার পর বিভিন্ন দেশে মার্সকের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। মরক্কো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক ও লেবাননের বিভিন্ন বন্দর ও অফিসে বিক্ষোভ হয়। মরক্কোর তাঞ্জিয়ার বন্দরে ৮ জন শ্রমিক ‘গাজায় রক্তের ব্যবসা’ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাকরি ছেড়ে দেন।
বিক্ষোভ ও সমালোচনার প্রভাব পড়ে মার্সকের ব্যবসায়ও। গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা শুরু হলে কোম্পানিটির শেয়ার দর ৫ শতাংশ কমে যায়। আরব ও ইউরোপের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মার্সকের সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তি বাতিল করেছে।
আর্থিক চিত্র ও ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ
২০২৩ সালে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হামলার কারণে লোহিত সাগর হয়ে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হয়। এ কারণে মার্সকের মুনাফা ওই বছর ৮৭ শতাংশ কমে যায়। বাধ্য হয়ে জাহাজ চলাচলের রুট পরিবর্তন করে আফ্রিকার কেপ অব গুড হোপ হয়ে পণ্য পরিবহন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি, ফলে সময় ও খরচ দুই-ই বেড়ে যায়।
তবে ২০২৪ সালের শুরুতে আয় কিছুটা বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির আয় ৯ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।
আইনি চাপ ও নৈতিক প্রশ্ন
মানবাধিকার সংগঠনগুলো মার্সকের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ ও যুদ্ধাপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ এনে আন্তর্জাতিক আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে ডেনমার্ক সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে, যেন তারা মার্সকের কার্যক্রমের নিরপেক্ষ তদন্ত করে।
একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘একটি বেসরকারি কোম্পানি হিসেবে মার্সকের উচিত ছিল মানবতার পক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু তারা বেছে নিয়েছে রক্তের বাণিজ্য।’
এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রশ্ন উঠেছে—বহুজাতিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নৈতিকতা ও মানবিক দায় কোথায়? গাজার নিরীহ মানুষের রক্তে কি তাদের হাতও রঞ্জিত নয়?
সূত্র: কুদস এন