মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

আফগানিস্তানে কীভাবে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে তালেবান সরকার ?

আফগানিস্তানে কীভাবে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে তালেবান সরকার ?
আফগানিস্তানে কীভাবে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেছে তালেবান সরকার ? ছবি : আস সমুদ

নিরাপত্তা—এটি কেবল একটি রাষ্ট্রীয় কৌশল নয়, বরং মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মূলভিত্তি। যেখানে নিরাপত্তা থাকে, সেখানেই মানুষ স্বপ্ন দেখে, শান্তিতে ঘুমায়, সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হয়। নিরাপত্তাই মানুষকে দেয় আত্মবিশ্বাস, করে কর্মমুখর, মুক্ত করে চিন্তার দুয়ার, গড়ে তোলে অগ্রগতির পথ।

কিন্তু নিরাপত্তার ছায়া যখন সরে যায়, তখন যেন জীবনের সব রং মুছে যায়। আতঙ্ক চেপে বসে জনমনে, থমকে যায় বিনিয়োগ, বন্ধ হয় পর্যটন, নিস্তেজ হয়ে পড়ে উদ্ভাবনের স্পৃহা। অনিরাপত্তা হয়ে ওঠে এক অদৃশ্য দৈত্য, যা প্রতিনিয়ত গিলে খায় স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে।

এই কারণেই তো নবী ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন—
﴿رَبِّ اجْعَلْ هَذَا بَلَدًا آمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ﴾ (বাকারা: ১২৬)

চার দশকেরও বেশি সময় ধরে আফগানিস্তান ছিল যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র আর সংকটের এক দীর্ঘ ট্র্যাজেডি। প্রাণ গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষের, পঙ্গু হয়েছে কোটি কোটি স্বপ্ন। বিভাজন, হিংসা আর বিদ্বেষের বিষবাষ্পে ভারী হয়ে উঠেছিল বাতাস।

এমন এক দুর্বিষহ বাস্তবতায় যদি বলা হয়—মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেখানে ফিরে এসেছে স্বস্তি, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিরাপত্তা—তাহলে তা অলৌকিক বলেই মনে হয়।
কিন্তু সেই অলৌকিকতাকে বাস্তব রূপ দিয়েছে ইসলামি ইমারত আফগানিস্তান।

তবে কীভাবে?
কীভাবে তারা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনরায় দাঁড় করিয়ে দিল?
কী এমন করল যা অন্যরা পারেনি?

এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তিনটি শক্ত ভিত, যা আজকের প্রতিটি সংগ্রামী জাতির জন্য হতে পারে এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।

১. ঐক্যের অটুট আদর্শ

ইসলামি ইমারত প্রথম দিন থেকেই জানত—বিজয়ের প্রকৃত চাবিকাঠি অস্ত্র নয়, বরং ঐক্য।
তারা তাদের কাঠামোর মধ্যে কোনো বিভক্তির সুযোগ দেয়নি। ব্যক্তিগত ক্ষোভ থাকলেও তা যেন দলীয় বিভাজনে রূপ না নেয়, তা নিশ্চিত করা হয়েছিল দৃঢ়ভাবে।

জিহাদের সময় কোনো স্বতন্ত্র গোষ্ঠীকে বাইরে থেকে লড়াইয়ের অনুমতি দেওয়া হয়নি—ইভেন যদি তা দখলদারদের বিরুদ্ধেই হয়।
শত্রুপক্ষ একাধিকবার চেষ্টা করেছিল ইমারতের শরীরকে টুকরো করতে—কখনো ‘কঠোরপন্থী’, কখনো ‘মধ্যপন্থী’, আবার কখনো ‘তালেবান নেটওয়ার্ক’ ও ‘হাক্কানি নেটওয়ার্ক’ নামে বিভক্ত করার অপচেষ্টা।

অর্থ ঢালা হয়েছে, ষড়যন্ত্র রচিত হয়েছে, এমনকি শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতেও পিছপা হয়নি তারা—তবুও ব্যর্থ হয়েছে।
এর একমাত্র কারণ—ইমারতের নেতৃত্বে ছিলেন বাস্তববাদী, অভিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাশালী আলেমরা, যারা আবেগ নয়, বরং বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতেন।

২. সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো

যুদ্ধকালীন সময়েও ইসলামি ইমারত গড়ে তুলেছিল একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামো।
শীর্ষে ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরিষদ, যার অধীনে কার্যকর হতো বিভিন্ন বিভাগ—সামরিক, গোয়েন্দা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, দাওয়াহ, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও বন্দি বিষয়ক শাখা।

প্রত্যেক প্রদেশে ছিল গভর্নর, জেলায় ছিল পরিচালক, এবং সর্বত্র ছিল উলামা পরিষদ—যারা দিতেন শরিয়াহভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
সামরিক বিভাগে ছিল প্রশিক্ষিত বাহিনী ও বিশেষ ইউনিট, যারা যেকোনো পরিস্থিতিতে প্রস্তুত থাকত।

যখন দখলদার বাহিনী পতনের মুখে পড়ে, তখন এই সুসংগঠিত কাঠামোই ধাপে ধাপে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ফলত, দেশের কোথাও বিশৃঙ্খলা, লুটতরাজ বা গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়নি। বরং প্রতিষ্ঠিত হয় সুসংহত ও কার্যকর প্রশাসনিক শৃঙ্খলা।

৩. সর্বজনীন সাধারণ ক্ষমা

সবচেয়ে চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত ছিল—সাধারণ ক্ষমা।
যারা দুই দশক ধরে মুজাহিদদের রক্ত ঝরিয়েছে, যারা দখলদারদের সহযোগী ছিল—তাদের সবাইকে দেওয়া হয় নিঃশর্ত ক্ষমা।

এত বড় উদারতার নজির ইতিহাসে কেবল মক্কা বিজয়ের সময়ই দেখা গিয়েছিল। আফগানিস্তানে সেটিই ঘটল দ্বিতীয়বার।
অনেকে ভেবেছিল প্রতিশোধের দাবানলে হাজার হাজার লোকের প্রাণ যাবে। কিন্তু ইসলামি ইমারত স্পষ্ট ঘোষণা দেয়—
‘আজ থেকে কেউ আর কারও প্রতিশোধ চাইবে না।’

এই এক ঘোষণাই বদলে দেয় জাতির মনস্তত্ত্ব। শত্রুতার জায়গা নেয় সহনশীলতা, প্রতিহিংসার জায়গা নেয় ভালোবাসা।
ফলাফল—আজ আফগানিস্তানে বইছে শান্তির বাতাস।

এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা

ঐক্য, পরিকল্পিত কাঠামো আর ক্ষমার বিস্তৃত হৃদয়—এই তিন স্তম্ভে ভর করেই ইসলামি ইমারত নির্মাণ করেছে এক শান্তিপূর্ণ আফগানিস্তান।
এক বিধ্বস্ত জাতিকে ফিরিয়ে এনেছে জীবনের আশা, ভবিষ্যতের আলোক।

এ যেন ইতিহাসের পাতা ছিঁড়ে লেখা এক নতুন গল্প—যেখানে বার্তাটি সুস্পষ্ট:
যেখানে আছে ঐক্য, আছে দূরদর্শী পরিকল্পনা, আর আছে উদার ক্ষমা—সেখানেই টিকে থাকে সত্যিকারের শান্তি।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা