মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

যুদ্ধবিরতি কি কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে নতুন আশার দ্বার খুলবে?

যুদ্ধবিরতি কি কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে নতুন আশার দ্বার খুলবে?
যুদ্ধবিরতি কি কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে নতুন আশার দ্বার খুলবে?

সাম্প্রতিক সেনা উত্তেজনার পর ভারত ও পাকিস্তান অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এক যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে আবারও সামনে এসেছে সেই পুরনো ইস্যু—কাশ্মীর। সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চল ঘিরেই চলেছে দুই পারমাণবিক প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘাত, সন্দেহ আর শত্রুতা।

অনেকে বলছেন, এই যুদ্ধবিরতি হয়তো কাশ্মীর সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজার সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে কেউ কেউ এটিকে দেখছেন সাময়িক বিরতি হিসেবে—যা পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মতপার্থক্যের কারণে যে কোনো সময় আবার ভেঙে পড়তে পারে।

উত্তেজনার সূচনা হয় ২২ এপ্রিল, ভারত-দখলকৃত কাশ্মীরে একদল পর্যটকের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে। হামলার জন্য নয়াদিল্লি সরাসরি ইসলামাবাদকে দায়ী করে। এরপর ভারত পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীর ও পাঞ্জাবে বিমান হামলা চালায়।

জবাবে পাকিস্তান ৫টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ও ডজনখানেক ড্রোন ভূপাতিত করে। পাশাপাশি তারা ‘বুনয়ানুম মারসুস’ নামে একটি পাল্টা সামরিক অভিযান শুরু করে। উত্তেজনা দ্রুতই সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে পাল্টাপাল্টি হামলায় রূপ নেয়।

শেষ পর্যন্ত ১০ মে, শনিবার সন্ধ্যায় দু’পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। কিন্তু এই বিরতি কি স্থায়ী শান্তির পথে এক পা এগোনো, নাকি কেবল অস্থায়ী এক নিঃশ্বাস? সেটাই এখন সবার মনে বড় প্রশ্ন।

অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি: উত্তেজনা প্রশমনে সাময়িক উদ্যোগ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম এই যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেন। পরে পাকিস্তান ও ভারত তা আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করে। প্রাথমিকভাবে ৪৮ ঘণ্টার জন্য এই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ ঠিক করা হয়েছে। আজ সোমবার, ১২ মে, দুই দেশের সেনাপ্রধানদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

চুক্তিটি ময়দানে সহিংসতা প্রশমনে কার্যকর হলেও, এটি আবারও আলোচনায় এনে দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার পুরোনো, গভীর সংকট—কাশ্মীর ইস্যু। প্রশ্ন উঠেছে, এই যুদ্ধবিরতি কি শান্তিপূর্ণ আলোচনার পথে কোনো নতুন সূচনা, নাকি শুধু একটি সম্ভাব্য বিস্ফোরণ এড়াতে নেওয়া ক্ষণস্থায়ী পদক্ষেপ?

আল-জাজিরা নেটকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাওয়েদ রানা মন্তব্য করেন, এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য কেবল ‘শত্রুতার অস্থায়ী বিরতি’; কাশ্মীর সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান এতে নিহিত নেই। তার মতে, ‘ভারত এই ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে নিজের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ রক্ষা করে এবং ইচ্ছে করেই মূল সমস্যাটিকে আড়াল করে রাখে।’

ইসলামাবাদ পলিটিক্যাল স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক আবদুল করিম শাহ মনে করেন, রাজনৈতিক সমাধান নিয়ে পেছনে কোনো আলোচনা হয়ে থাকলেও, তা বর্তমান চুক্তির কোথাও প্রতিফলিত হয়নি।

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান এখন আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের আহ্বান জানাচ্ছে, যেন তারা জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে একটি সুস্পষ্ট সময়সূচির ভিত্তিতে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি, ভারত যে পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, তা পুনরায় কার্যকর করার দিকেও নজর দেওয়া দরকার।’

তবে শাহ মনে করেন, এই জটিল সংকটের দ্রুত সমাধান সম্ভব নয়। কারণ, দ্বিপক্ষীয় সদিচ্ছার অভাব এখনো বড় বাধা। তার ভাষায়, ‘এই চুক্তি আসলে কেবলমাত্র উত্তেজনা কিছুটা কমিয়ে রাখার একটা ব্যবস্থা, তার বেশি কিছু নয়।’

অসাধারণ সামরিক দক্ষতা ও পারমাণবিক সংঘাতের শঙ্কা

সাম্প্রতিক সংঘর্ষগুলো আবারও সামনে এনেছে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা। কারণ, দুই প্রতিবেশী দেশই ভয়ংকর ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের অধিকারী। বিশ্লেষক জাভেদ রানা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মূলত সংঘাতের কারণ বা সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ নিয়ে নয়, বরং উদ্বিগ্ন এই নিয়ে যে পরিস্থিতি যেন পারমাণবিক যুদ্ধ পর্যন্ত না গড়ায়।’

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কার্যকর এবং চমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়া ভারতের ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। ড্রোন ব্যবহারে পাকিস্তান যে প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে, তা ভারতীয় নেতৃত্বকে হতবাক করেছে এবং শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হতে বাধ্য করেছে।’

এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত সাবেক সেনাপ্রধান ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী নঈম খালেদ লোধীও। আল–জাজিরা নেটকে তিনি বলেন, ‘আকাশপথে প্রথম দফার লড়াইয়ে পাকিস্তান জয়ী হয়েছে এবং তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দৃঢ়ভাবে ফিরিয়ে এনেছে।’ তিনি জানান, মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় প্রায় ৮০টি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে, যা একটি সম্ভাব্য বিশ্ব রেকর্ড।

বিশ্লেষক আবদুল করিম শাহর মতে, ‘পাকিস্তানের এই সামরিক দক্ষতাই ভারতকে তাদের অবস্থান নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে এবং একইসঙ্গে মার্কিন মধ্যস্থতাকে সফল করতে বড় ভূমিকা রেখেছে।’

কাশ্মীর আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে

যুদ্ধবিরতির সাম্প্রতিক চুক্তিতে কোনো রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলেও, অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন—এই ঘটনার ফলে কাশ্মীর ইস্যু বহুদিন পর ফের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গুরুত্ব পাচ্ছে, যেটি এতদিন প্রায় উপেক্ষিত ছিল।

বিশ্লেষক জাভেদ রানা বলেন, ‘সাম্প্রতিক উত্তেজনা প্রমাণ করেছে—কাশ্মীর শুধুই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, যেমনটা নয়াদিল্লি দাবি করে। এটি আসলে দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যকার একটি আঞ্চলিক বিরোধ, এবং যতদিন এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান না হবে, যুদ্ধের ঝুঁকি থেকেই যাবে।’

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল লোধি মনে করেন, এই চুক্তিকে শুধু যুদ্ধবিরতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তাঁর মতে, এতে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ, সীমান্ত সংঘর্ষ এবং বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখোয়ার বিদ্রোহের বিষয়গুলোও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তিনি হুঁশিয়ারি দেন—কোনো বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া কেবল যুদ্ধবিরতির ওপর ভরসা করলে সমস্যা থেকে যাবে।

অন্যদিকে বিশ্লেষক আবদুল করিম শাহ মনে করেন, উত্তেজনা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কোনো কূটনৈতিক সাফল্য নিয়ে ফিরতে পারেননি। বরং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাঁর অবস্থান দুর্বল হয়েছে, যা আসন্ন নির্বাচনে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা