দখলদার ইসরায়েলি সেনাবাহিনী উত্তর গাজায় পুনরায় ভারি বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ শুরু করেছে। একই সঙ্গে তারা সেখানকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার গাজার উত্তরাঞ্চল বেইত লাহিয়ায় যুদ্ধবিরতির দাবিতে বিক্ষোভে নামে ফিলিস্তিনিরা।
এদিকে বিক্ষোভ শেষে সোশ্যাল মিডিয়ায় গাজার বিভিন্ন স্থানে পুনরায় বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়। পরবর্তীতে এটিই হামাসের গাজা ত্যাগের দাবিতে পরিণত হয়, যা হামাসের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এবং যেই উদ্দেশ্যে এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল তা ব্যাহত হয়ে পড়ে।
নিচের প্রশ্নগুলোর সমাধান গাজার সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও চলমান পরিস্থিতির মূল রহস্য উদঘাটনে সহযোগিতা করবে।
উত্তর গাজায় কেন বিক্ষোভ হলো?
যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই একের পর এক উচ্ছেদ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে গাজাবাসী। সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল তাদের জীবনে। কিন্তু এর মধ্যেই গাজার উত্তরাঞ্চলের বাসিন্দাদের জন্য নতুন করে উচ্ছেদ আদেশ জারি করে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী, যা আবারও তাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে।
এই ভয়াবহ বাস্তবতায়— যেখানে ইসরায়েল মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এবং রাজনৈতিক সমাধানেরও কোনো আশার আলো নেই— বেইত লাহিয়ার কিছু বাসিন্দা বিক্ষোভে নামে। ‘গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করো’ স্লোগান তুলে মিছিলে বের হয় তারা। সেসময় তাদের হাতে ‘যুদ্ধ বন্ধ করো’, ‘আমরা মরে যেতে রাজি নই’, ‘আমাদের শিশুদের রক্ত সস্তা নয়’ ইত্যাদি স্লোগান সম্বলিত প্ল্যাকার্ড দেখা যায়।
বিক্ষোভ কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল?
বেইত লাহিয়ার বিক্ষোভের ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক হৈচৈ পড়ে যায়। কেউ এটিকে গাজায় গণহত্যা বন্ধের স্বাভাবিক জাতীয় দাবি হিসেবে দেখেছেন, যা সকলেরই প্রত্যাশা। অন্যদিকে কেউ কেউ এটিকে হামাসের শাসন ছাড়ার আহ্বান এবং গাজার পুনর্গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধ-অবসানের প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
ইসরায়েলি সাংবাদিক ইদি কোহেন বিক্ষোভের দৃশ্য ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই মতপার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে হামাসবিরোধী বিক্ষোভ জোরদারের আহ্বান জানান। তিনি গাজার বিভিন্ন অঞ্চলে নির্দিষ্ট সময় ও স্থান উল্লেখ করে বিক্ষোভের ডাক দেন। পাশাপাশি কিছু প্রবাসী ফিলিস্তিনিও নির্দিষ্ট সময় ও স্থানে বিক্ষোভের আহ্বান ছড়িয়ে দেন।
এভাবেই বিক্ষোভটি তার মূল প্রেক্ষাপট থেকে সরে হামাসবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্রে পরিণত হয়।
হামাসবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পূর্বের আন্দোলনের সম্পর্ক কী?
ফিলিস্তিনের বাইরে বসবাসকারী কিছু একটিভিস্ট ২০১৮ সালে প্রথম হামাসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেসময় তারা ‘আমরা বাঁচতে চাই’ শিরোনামে একটি আন্দোলন শুরু করেন, যেখানে গাজায় ইসরায়েলি অবরোধে সৃষ্ট বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের দাবি তোলা হয়েছিল।
পরবর্তী বছরগুলোতেও একই ব্যক্তিরা একই দাবিতে রাস্তায় নামার আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন। তবে ফাতাহ আন্দোলন ও ফিলিস্তিনি মিডিয়ার সমর্থনের কারণে আন্দোলনটি প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হতে থাকে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল
এ বিষয়ে হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য বাসেম নাঈম মন্তব্য করেছেন— ‘প্রতিটি নিপীড়িত মানুষের অধিকার রয়েছে যে, নিজের যন্ত্রণার কথা চিৎকার করে জানাবে। শত্রুর আক্রমণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চস্বরে প্রতিবাদ জানাবে। আমাদের প্রতিবাদী জনগণ যারা রাস্তায় বেরিয়েছে বা বের হয়নি, সকলেই আমাদের অংশ। আমরা তাদের ও তারা আমাদের প্রতিনিধি।’
বাসেম নাঈম ফেসবুক পোস্টে সেসব ব্যক্তিদের নিন্দা জানিয়েছেন, যারা এই মানবিক বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন কিংবা দখলদার বাহিনীর অপরাধ আড়াল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
গাজার অভ্যন্তরীণ ফ্রন্ট এক বিবৃতিতে বলেছে, ন্যায্য দাবি মানে দখলদার রাষ্ট্র ও তার অসৎ পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হওয়া নয়। যারা শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং শত্রুর পক্ষে দাঁড়ায়, তারা প্রকৃত ফিলিস্তিনি হতে পারে না। ইসরায়েলিদের আহ্বানে সাড়া দেওয়ার অর্থ হলো, তাদের পক্ষাবলম্বন করা এবং প্রকারান্তে এটি শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।
সূত্র: আল জাজিরা