এক সময় গাজায় হৈ-হৈ করে শীত আসত। গাজার লোকদের কাছে শীত মানেই ছিল কল্যাণ ও বরকতের মৌসুম। গরমকালে গাজার পরিবেশ থাকত উত্তপ্ত। তীব্র গরম থেকে মুক্তির আশায় ছোটবড় সকলেই শীতের অপেক্ষায় থাকত।
শীতকালের বড় আকর্ষণ ছিল বর্ষা। ঝুম বৃষ্টিতে কচিকাচারা রাস্তায় নেমে আসত। তাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠত গাজার পথ-প্রান্তর। শিশুরা নেচেকুঁদে সুর করে গাইত:
شطي يا دنيا شطي، وأروي كل الأراضي، ليزرع الفلاح خوخ ورمان وتفاح
‘বৃষ্টি এসেছে হে পৃথিবী, বৃষ্টি, সকল ভূমিতে আজ হবে সৃষ্টি; কৃষকেরা ফলাবে জাম, ডালিম ও আপেল।’
বাচ্চাদের এই গানে গাজার আকাশ-বাতাস সুরভিত হয়ে উঠত।
বৃষ্টি গাজার জন্য ছিল রহমত। কারণ গাজা শুষ্ক অঞ্চল। কৃষকদের কাছে বৃষ্টির কদর ছিল ভিন্ন মাত্রার। এই সময়েই তারা নতুন ফলনের জন্য প্রস্তুত হতেন। বাজারগুলো ভরে উঠত মৌসুমি শাকসব্জিতে। সেইসাথে থাকত ফলমূলের বিশাল সমাহার।
শহরবাসীর কাছে বৃষ্টি ছিল বিশ্রামের দিন। তারা উষ্ণ কম্বলের নিচে গুজিমুজি দিয়ে থাকত। অথবা আগুন জ্বালিয়ে তার চারিপাশে জড় হয়ে বসত। তৈরী করত গরম চা। গল্পের ফাঁকেফাঁকে চুমুক দিত সালেবে। সালেব তৈরী করা হয় দুধ, নারেকেল কুচি ও বাদাম দিয়ে।
শীতের বৃষ্টি এক সময় শেষ হয়ে যেত।
অনেকেই তখন সমুদ্র-বিলাসে যেত। কারও সময় কাটত ঘুরেফিরে। আবার কেউ কেউ দলবল নিয়ে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠত। সমুদ্রের আকাশ তখন ভুট্টা ও বাদাম ভাজার মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করত। সমুদ্রতীরের যাতায়াত পথেই ছিল ‘আবু আল সৌদ’ নামক বিখ্যাত সেই মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। গরম গরম কুনাফার জন্য অনেকেই সেখানে দাঁড়াত। কুনাফাও ছিল হরেক রকমের।
দুই.
গাজার এই শীতকালীন চিত্র এখন যেন সুদূর অতীত। আবু আল সৌদের সেই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারটিও বিলুপ্ত এখন। নেই সেই উচ্ছ্বাসভরা মিলনমেলা। নেই মুখরিত সেই আড্ডা। না আছে কুনাফা আর না আছে সালাব।
শীতকালের বৃষ্টিতেও বাচ্চারা আর হৈ-হৈ করে পথে নেমে পড়ে না। তাদের কচি কণ্ঠে তারা আর গায় না : শাতি ইয়া দুনিয়া শাতি—বৃষ্টি নেমেছে হে দুনিয়া, বৃষ্টি।
এবছরের শীত কল্যাণ ও বরকতময় নয়। বৃষ্টি এখন আতঙ্ক ও ভয়ের নাম। কেউ আর বৃষ্টি কামনাই করে না। বৃষ্টি এলেই তো নামবে ঢলের পানি। ভাসিয়ে নেবে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো। বজ্রপাত এখন যেন বোমাবর্ষণের আওয়াজ। মানবিক সংস্থাগুলোর মতে প্রায় দশ লাখ মানুষের নূন্যতম শীতবস্ত্র পর্যন্ত নেই।
অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোও খুবই দুর্বল। কাপড়-তেরপাল-কম্বল-কাগজের শক্ত বোর্ড এমনকি কেউ কেউ চালের বস্তা দিয়েও তাবু বানিয়েছে। এই তাঁবু হালকা বাতাস ও বৃষ্টিতেই ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। তাই রাতের বেলায় পরিবারের লোকেরা জেগে থাকে। তারা শক্ত করে তাঁবুর রশি ধরে রাখে। যাতে তা উড়ে না যায়। উড়ে গেলেই সর্বনাশ। বৃষ্টির পানিতে তাদের বিছানাগুলো স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে যাবে।
কারও কারও তাঁবু একদমই নামকাওয়াস্তে ঝুলে আছে। বৃষ্টি এলেই তা অকেজো হয়ে পড়বে। তখন আরেকটি তাঁবু খাঁটাতে গিয়ে পরিবারগুলোকে হিমশিম খেতে হবে— জীবনের প্রতিটি মুহূর্তেই তো তারা হিমসীমই খাচ্ছে। সামানপত্রের মূল্যও এখন আকাশছোঁয়া।
কেউ কেউ তাদের বিধ্বস্ত বাড়িঘরেই ফিরে যেতে যায়, এমনকি যায়ও। বাড়ি বলতে সেখানে পড়ে আছে কিছু ধ্বংসস্তূপ। বোমার আঘাতে ছাদগুলো সব ঝুরঝুরে হয়ে আছে। যেকোনো মুহূর্তেই তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। তবু তারা সেখানেই থাকতে চায়। দ্বিতীয় কোনো উপায়ই যে নেই তাদের।
কনকনে শীতের মধ্যে সামান্য উষ্ণতার মূল্যও আকাশছোঁয়। জ্বালানি কাঠ ক্রয়ক্ষমতার বহুদূরে। এক কেজি কাঠের জন্য গুনতে হবে হাজার টাকা। কারওই তো সেই অর্থে সামর্থ্যই নেই। ফলে একটু আগুনের জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আগুন তো কেউ কেউ জ্বালাতে পারে বটে। কিন্তু গোটা পরিবারকে উষ্ণ রাখার মতো পর্যাপ্ত জ্বালানি দুষ্প্রাপ্য।
একদিকে হাড়কাঁপানো শীত। অন্যদিকে পেটের মধ্যে ক্ষুধার অনল। গত অক্টবর থেকেই দ্রব্যমূল্যে আকাশচুম্বী। এক প্যাকেট আটার মূল্য বিশ হাজার টাকা। মাছ-মাংসের গন্ধও পাওয়া যায় না। শাকসবজিও দুষ্প্রাপ্যপ্রায়। পাওয়া গেলেও তা দুর্মূল্য। কাঁচামালের অভাবে বেকারিগুলোতেও শাটার পড়ে আছে।
রাতের বেলায় রিফিউজি ক্যাম্পের আকাশ-বাতাস শিশুদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে। তারা বাবা-মায়ের পায়ে পড়ে গড়াগড়ি খায়—এক টুকরো রুটির জন্য!
তিন.
সেই গাজা আজ কেবলই স্মৃতি। শীতের সেই গাজা ছিল উৎসব-মুখর। সেখানে এখন কেবলই আতঙ্ক ও হতাশা। ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগের যেন কোনো অন্ত নেই। তবু ঘোলাটে স্বপ্ন নিয়ে গাজাবাসী বসে আছে যে, এই গণহত্যা এক দিন শেষ হবে। গাজার বাজারে তখন পর্যাপ্ত খাবার থাকবে। মানুষের থাকবে উপযুক্ত বাসস্থান।
কল্যাণ ও বরকতের এই উইন্টার আবারও ফিরে আসবে। তবে সেই উইন্টার হবে গাজার বসন্ত—ইনশাআল্লাহ।
আল জাজিরা ইংরেজিতে প্রকাশিত ইমান আলহাজ আলির একটি আর্টিকেল অবলম্বনে লেখা