চাণক্য কৌটিল্য ছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দে তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তিনি বিখ্যাত সংস্কৃত গ্রন্থ ‘অর্থশাস্ত্র’-এর রচয়িতা। বইটি সাম্রাজ্য পরিচালনার নির্দেশিকা হিসেবে পরিচিত। অপরদিকে, ১৫৩২ সালে নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি রচনা করেন তাঁর প্রভাবশালী রাজনৈতিক গ্রন্থ দ্য প্রিন্স। এ গ্রন্থ থেকেই ‘ম্যাকিয়াভেলিয়ান’ শব্দটি উৎপত্তি, যা এখনও প্রতারণা, কপটতা ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
জার্মানির খ্যাতনামা দার্শনিক ও আইনবিদ ম্যাক্স ওয়েবার তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ পলিটিকস অ্যাজ এ ভোকেশন-এ বলেন, ‘জনপ্রিয় অর্থে ‘চূড়ান্ত ম্যাকিয়াভেলিয়ান চিন্তাধারা’ ভারতীয় সাহিত্যে ক্লাসিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে; তার তুলনায় ম্যাকিয়াভেলির দ্য প্রিন্স বেশ নিরীহ।’
ম্যাকিয়াভেলির জন্মের ১৮০০ বছর আগে চাণক্য ‘রাজ মণ্ডল’ নামে এক শাসনব্যবস্থার মডেল প্রচলন করেন। ষড়যন্ত্র, গুপ্তচরবৃত্তি, হত্যাকাণ্ড ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে ধ্বংস সাধনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এ মডেল ক্ষমতা অর্জন বা তা ধরে রাখতে পারিবারিক সদস্যদের হত্যা করাকেও প্রয়োজনীয় মনে করত। চাণক্যের অন্যতম প্রিয় বচন ছিল, ‘তোমার প্রতিবেশী তোমার স্বাভাবিক শত্রু, আর প্রতিবেশীর প্রতিবেশী তোমার বন্ধু।’ মজার ব্যাপার হলো, স্বাধীনতার কয়েক বছর পর দিল্লির কূটনৈতিক পাড়া কে ‘চাণক্যপুরী’ নামে নামকরণ করা হয়।
স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান ভারতের চাণক্যীয় কূটচালের মূল শিকার হয়ে এসেছে। পাকিস্তান ভাঙার ঘটনা এখনো ভারত গর্বভরে স্মরণ করে। শুধু সন্ত্রাসে উসকানি দেওয়াই নয়, এখানকার শিখ ও কাশ্মিরি নেতাদের লক্ষ্য করে একের পর এক হত্যাকাণ্ডেও যুক্ত থেকে আসছে ভারত। বেলুচিস্তানে ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা কুলভূষণ যাদব গ্রেপ্তার হয়ে সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করলে পাকিস্তানের অবস্থান সত্য প্রমাণিত হয়।
ফাইভ আইস গোয়েন্দা জোটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিখ নেতা হরদীপ সিং নিঞ্জারের হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতকে দায়ী করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে শিখ মতপ্রকাশকারী গুরপতওয়ন্ত সিং পানুনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দেশটি ভারতের সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিকাশ যাদবের বিরুদ্ধে মামলা করে। ব্রিটেনেও শিখ অধিকারকর্মী অবতার সিং খান্দার হত্যাকাণ্ডের জন্য ভারতকে দায়ী করা হচ্ছে।
ভারতকে ‘বিশ্বের বিভ্রান্তিকর তথ্যের রাজধানী’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২৪ সালের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্টে ভারতকে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানোর শীর্ষ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়া হেট ল্যাব জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘৃণাভাষণের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচারক। নথিভুক্ত ঘৃণাভাষণের ৯৮.৫ শতাংশের লক্ষ্য মুসলমানরা।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে, ইইউ ডিসইনফো ল্যাব ভারতের একটি ১৫ বছরব্যাপী ধোঁকাবাজির অপারেশন উদ্ঘাটন করে, যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানকে দুর্বল করা। ৯৫টি দেশে সক্রিয় ৫০০টি ভুয়া গণমাধ্যমের মাধ্যমে চালানো হয় এ অভিযান। এ সাহসী প্রচারণায় জাল ইইউ নথি জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে সরবরাহ করা হয়।
এই ভুয়া প্রচারণাকে আরও উসকে দেয় ভারতের সর্ববৃহৎ বার্তা সংস্থা এএনআই, যারা ওই ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ তৈরি করে তা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেয়। ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থার এ ধরনের ফাঁস করা তথ্যে ভারতকে জবাবদিহির মুখে না ফেললেও, উল্টো পাকিস্তানকেই শাস্তিমূলক পদক্ষেপের শিকার হতে হয়, যেমন ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্সের (এফএটিএফ) ধূসর তালিকাভুক্তি। এ অবস্থায় মোদি উদ্যাপন করেন নিজের লাগামহীন চাণক্যীয় ক্ষমতা।
আ লাইফ ইন দ্য শ্যাডোস শিরোনামের স্মৃতিকথায় ভারতের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান এএস দুলাত প্রধানমন্ত্রী মোদি ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে বর্ণনা করেছেন “একটি আদর্শ যুগল; স্বর্গে তৈরি এক জুটি” হিসেবে। মোদির এই “স্বর্গসঙ্গী” ডোভাল তাঁর অধীনে নির্মাণ করেন এক নির্মম অভিযান ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্যভিত্তিক নীতি।
পহেলগামে নিরপরাধ মানুষের মর্মান্তিক প্রাণহানি রহস্যজনকভাবে পুলওয়ামা, পাঠানকোট ও উরির দুরভিসন্ধিমূলক ফ্ল্যাগ অপারেশনের সঙ্গে মিলে যায়। প্রতিবারই কাশ্মিরের মতো দুর্গতুল্য এলাকায় হামলার সহজতা, ঘটনার পরপরই পাকিস্তানকে মূল অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া এবং ভারতের আগ্রাসী গণমাধ্যমের যুদ্ধোন্মাদনা—এই একই চিত্র চোখে পড়ে। পাকিস্তান-কেন্দ্রিক ভারত এই ঘিসেপিটে, আর-এ ডব্লিউ-এর তৈরি স্ক্রিপ্ট আঁকড়ে ধরে পাকিস্তানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে হেয়প্রতিপন্ন ও (ব্যর্থভাবে) চাপে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
পহেলগাম ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভারতীয় মিডিয়া পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক তীব্র আক্রমণ শুরু করে। হতভাগ্য পরিবারগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় সান্ত্বনার বদলে, এই বিষোদ্গার যেন আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ‘অধিকৃত কাশ্মীরে ইসরায়েলি পন্থা’ অনুসরণের আহ্বান জানানো হয়, যা গাজায় ৫০,৭০০ এরও বেশি মানুষের, ১৭,০০০ শিশুসহ, হত্যাকাণ্ডের একটি গণহত্যার পটভূমি।
পুলওয়ামা হামলার সময় জম্মু-কাশ্মীরে নিযুক্ত ছিলেন মোদি সরকার মনোনীত গভর্নর সত্যপাল মালিক। ওই হামলায় ভারতের কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফ-এর ৪০ জন সদস্য নিহত হন, যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করে। পরবর্তীতে এক গুরুতর অভিযোগে মালিক জানান, হামলার পরপরই তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ফোন করে বলেছিলেন, “এটা আমাদের গাফিলতির কারণে ঘটেছে।”
মালিক আরও জানান, সিআরপিএফ এত বড় সামরিক বহর সড়কপথে পাঠানোর আগে বিমান চেয়েছিল। কিন্তু ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। মালিকের ভাষ্যে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল তাকে চুপ থাকতে বলেন, যেন সরকার রাজনৈতিক সুবিধার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করতে পারে। চাণক্য থেকে মোদি পর্যন্ত, রাজ মণ্ডলের নীতি একই রয়ে গেছে।
করন থাপারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মালিক বলেন, “২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন আমাদের শহিদদের মৃতদেহের ওপর দাঁড়িয়ে লড়া হয়েছিল। আমি আশঙ্কা করি, আগামী নির্বাচনে জেতার জন্য এরা যেকোনো কিছু করতে পারে। তারা রাম মন্দিরে হামলার নাটক সাজাতে পারে, বিজেপির কোনো নেতাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করতে পারে। যদি তারা পুলওয়ামা ঘটাতে পারে, তাহলে তারা সবই করতে পারে।” তিনি আরও বলেন, মোদি “কাশ্মীর সম্পর্কে অজ্ঞ ও ভুল তথ্যভিত্তিক ধারণা পোষণ করেন।”
দখলকৃত কাশ্মীরে ভারতের নির্যাতন, বালুচিস্তানে সন্ত্রাসে রাষ্ট্রীয় মদদ—যাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল পাকিস্তানের ‘নরম পেট’ বলে উল্লেখ করেছেন—এবং ভারতের আধিপত্যবাদী পরিকল্পনার বিপরীতে বিশ্ব আজও নীরব। “Non vedo, non sento, non parlo”—আমি কিছু দেখি না, কিছু শুনি না, কিছু বলি না—এটি কোনো শান্তিপূর্ণ দর্শন নয়; বরং এটি মাফিয়া জগতে প্রচলিত ‘ওমার্তা’—একটি চাপিয়ে দেওয়া নীরবতার শপথ।
পশ্চিমা বিশ্বের ‘ওমার্তা’—( ওমার্তা’ (Omertà) একটি ইতালীয় শব্দ, যার মূল অর্থ ‘নীরবতার শপথ’। এটি মূলত সিসিলিয়ান মাফিয়া সংস্কৃতির অংশ, যেখানে অপরাধ সংঘটনের পর কেউ মুখ না খুলে চুপ থাকার অঙ্গীকার করে।
বর্তমানে ‘ওমার্তা’ শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়—কোনো অন্যায় বা অপরাধ সম্পর্কে ইচ্ছাকৃতভাবে নীরব থাকা, বিশেষত ক্ষমতাধরদের স্বার্থে। যেমন, রাষ্ট্রীয় অপরাধ বা দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা বোঝাতে এ শব্দটি ব্যবহৃত হয়।) এই নীরবতা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে একপ্রকার ছাড়পত্র, যার ফলে পাকিস্তানবিরোধী বেপরোয়া ও বিকারগ্রস্ত মনোভাব এখন একটি পারমাণবিক সংঘাতের আশঙ্কায় রূপ নিচ্ছে। হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার পরিচালিত একের পর এক উসকানিমূলক দুঃসাহসিকতা ও ‘ফলস ফ্ল্যাগ’ অভিযান পুরো অঞ্চল তো বটেই, সারা বিশ্বের জন্যই এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে, দখলকৃত কাশ্মীরের জনগণকে তাদের জন্মগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করাই হতে পারে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। এটি কোনো রুবিকস কিউব নয়; বরং একেবারে সহজ ও সরল একটি সিদ্ধান্ত, যা প্রায় ২০০ কোটি মানুষের স্বার্থে সেরা বিকল্প। অবশ্য সেটি সম্ভব শুধু তখনই, যদি হিন্দুত্ববাদী উন্মাদনার মধ্যে একটুও সুবিবেচনার জায়গা অবশিষ্ট থাকে।