বিশ্বজুড়ে যখন শেয়ারবাজারে ধস, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে স্বাগত জানাচ্ছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে। ট্রাম্পের শুল্ক সংস্কার বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ধাক্কা দিলেও, তিনি যেন তাতে উদাসীন—মধ্যপ্রাচ্যে নিজের কৌশল বাস্তবায়নেই যেন তাঁর পুরো মনোযোগ।
মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে এই দ্বিতীয়বারের মতো নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক থেকে বোঝা যায়, ট্রাম্প হয়তো নিজের ভাবমূর্তি ঘোচাতে মরিয়া। এমনকি তার নিজ দলের অনেকেই এখন তার সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে গতকালের বৈঠকে মুখ্য বিষয় ছিল ইরান এবং গাজা—দুইটিই হটস্পট।
নেতানিয়াহু চাচ্ছেন, ইরানে সম্ভাব্য হামলার আগে ট্রাম্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় দেখাতে। এদিকে, ট্রাম্প চমক দেখিয়ে জানালেন, যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইরানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে, যা চলবে আগামী শনিবার পর্যন্ত। আলোচনার সূত্রপাত গত মাসে ট্রাম্পের পাঠানো এক চিঠি থেকে।
গাজা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী আরও বেশি ভূমিকা নিতে। অথচ নেতানিয়াহু মূলত সময়ক্ষেপণেই ব্যস্ত, যদিও হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়েছে এক বছর পেরিয়ে। আর এক বছর আগেই তিনি বলেছিলেন, ‘গাজায় বিজয় এখন এক ধাপ দূরে।’
পেছনের মঞ্চে চলছে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে জটিল বার্তা-বিনিময়। ইতোমধ্যে ইসরায়েলে মোতায়েন হয়েছে মার্কিন ‘থাড’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা ‘হেতস’-এর সঙ্গে মিলে তৈরি করছে শক্তিশালী নিরাপত্তা বলয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ইসরায়েলের সম্ভাব্য হামলার প্রস্তুতির আভাস দিচ্ছে। একইসঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র বিশাল সামরিক শক্তি জড়ো করছে মধ্যপ্রাচ্য ও ভারত মহাসাগরে—যুক্ত হয়েছে ‘বি-৫২’ বোমারু বিমানও। পাশাপাশি, ইয়েমেনে হুথিদের লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন চালিয়ে যাচ্ছে ধারাবাহিক হামলা।
এই প্রেক্ষাপটে, ইরানের ওপর আমেরিকা ও ইসরায়েলের যৌথ চাপ ক্রমেই বাড়ছে। মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক জেনারেল ম্যাকেনজি সম্প্রতি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, হুথিদের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের হামলা বাইডেনের নীতির থেকে একেবারে ভিন্ন। তাঁর মতে, এটি ইরানের প্রভাববলয় দুর্বল করার কৌশল। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে ইসরায়েলের সাফল্য—সব মিলে ইরান এক চাপের মধ্যে আছে।
ম্যাকেনজি বলছেন, ইরানি শাসকরা শক্তিকে সম্মান করে। আর এখন যেহেতু আমেরিকা ও ইসরায়েল—দুই দেশই আক্রমণের সম্ভাব্য অবস্থানে, তাই টিকে থাকার তাগিদেই ইরান আবার পরমাণু আলোচনা শুরু করতে পারে।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প ইসরায়েলকে নিজের কৌশল বাস্তবায়নের এক ধরণের ‘চাপ সৃষ্টিকারী হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছেন। গাজায় সীমিত হামলা কিংবা ইরানে আক্রমণের হুমকি—সবকিছুই যেন আলোচনার টেবিলে যুক্তরাষ্ট্রের সুবিধাজনক অবস্থান নিশ্চিত করার কৌশল।
এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে কিছুটা আশাবাদের সুর শোনান। অপহৃতদের পরিবারকে জানান, শান্তিচুক্তির একটি দুই ধাপের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে। প্রথম ধাপে যুদ্ধবিরতি এবং কয়েকজন অপহৃতের মুক্তি; দ্বিতীয় ধাপে স্থায়ী চুক্তি যার মধ্যে থাকবে বাকি অপহৃত ও মৃতদেহ ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা।
মিশরের মধ্যস্থতায় প্রথম ধাপে আটজন মুক্তির প্রস্তাবও এই পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির গাজা দখলের বিশাল পরিকল্পনা আঁকছেন, সেনাবাহিনী এখনো পুরোপুরি সেই পথে হাঁটেনি। বরং তারা চাইছে, বর্তমান চাপের মধ্যে আলোচনার পথেই অগ্রগতি হোক।
গাজা দখলে একমাত্র আগ্রহী ব্যক্তি মনে হচ্ছে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ, যিনি অর্থনৈতিক সংকট বা সেনা বিক্ষোভের প্রতি উদাসীন। তাছাড়া সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, তাঁর দল পার্লামেন্টে ঢোকার ন্যূনতম ভোটও পাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে, মধ্যপ্রাচ্য এখন এক কূটনৈতিক দাবা খেলায় পরিণত হয়েছে—যেখানে ট্রাম্প চাল দিচ্ছেন, নেতানিয়াহু সৈনিক, আর ইরান সেই খেলায় টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত।
সূত্র: কুদস আল আরাবি