ফিলিস্তিনিরা যখনই ইসরায়েলি সৈন্য বা বসতকারীদের বন্দি করেছে, তখনই তাদের প্রতি মানবিক আচরণ দেখিয়েছে। তবে এবার যা ঘটল, তা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তুলেছে। সম্প্রতি আটক হওয়া ইসরায়েলি সৈন্য ওমের শিম তোভ, বন্দি বিনিময়ের সময় কাসসাম ব্রিগেডের এক যোদ্ধার মাথায় চুমু খেয়েছে। আল-জাজিরা ও অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের সরাসরি সম্প্রচারে দেখা যায়, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কাজ করেছে এবং বিনিময় প্রক্রিয়ার সময় তার চোখেমুখে কোনো আতঙ্ক ছিল না—বরং ছিল এক ধরনের স্বস্তি।
অনেকেই প্রশ্ন করছেন, কেন একজন ইসরায়েলি সৈন্য তার বন্দিদাতার প্রতি এতটা কৃতজ্ঞতা দেখাল? এর উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ৭ই অক্টোবরের সেই দিনে, যেদিন থেকে এই অধ্যায়ের শুরু। এরপর যা ঘটেছে, তা কেবল সামরিক সংঘর্ষ নয়, বরং নৈতিকতার এক পরীক্ষাও। ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধের ময়দানে প্রতিরোধ করেছে, কিন্তু তাদের আচরণ দিয়েও দেখিয়েছে তারা কারা। বিপরীতে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা আন্তর্জাতিক আদালতেও গণহত্যা হিসেবে নিন্দিত হয়েছে।
অনেকেই এই ঘটনাকে মজার দৃষ্টিতে দেখছেন, কিন্তু বাস্তবতা আরও গভীর। একজন বন্দি, যে কিনা কয়েক মাস আগেও এই যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়ছিল, সেই সে-ই আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখাচ্ছে। এটি এক প্রতীকী মুহূর্ত, যা দেখিয়ে দেয় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ কেবল অস্ত্রের লড়াই নয়—এটি এক নৈতিক লড়াইও।
এই ছবি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি কোনো নাটকও নয়। বরং এটি এক জাতির লড়াইয়ের গভীরতম সত্যকে তুলে ধরে—এক জাতি, যারা মানবিকতা ধরে রেখেও প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছে।
যখন একজন ইসরায়েলি সৈন্য, যে এতদিন ধরে ফিলিস্তিনিদের দানব হিসেবে দেখে এসেছে, সেই সে-ই আজ এক কাসসাম যোদ্ধার মাথায় চুমু খায়, তখন তা প্রমাণ করে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধশক্তি শুধু যুদ্ধের ময়দানে নয়, মানুষের হৃদয়েও জয়ী হচ্ছে। গত কয়েক দিনে প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি বিশ্বজুড়ে যে মুগ্ধতা আর প্রশংসা দেখা গেছে, এটি তারই প্রমাণ।
নৈতিকতা ও এর গুরুত্ব
১৫ মাসের টানা সংঘাতে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন শুধু সামরিক কৌশলেই নয়, নৈতিকতার ক্ষেত্রেও এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বিশেষ করে বন্দিদের প্রতি তাদের আচরণ এবং অন্যান্য বিষয়ে যে মানবিকতা তারা দেখিয়েছে, তা চোখে পড়ার মতো।
‘তুফানুল আকসা’ অভিযানের শুরুতেই শহীদ মোহাম্মদ দাইফের ঘোষণায় এই নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি সেদিন স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, তারা শিশু বা বৃদ্ধদের লক্ষ্যবস্তু করবে না। যুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে এই মূল্যবোধ অটুট থেকেছে, যা বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে।
এমনকি কিছু ইসরায়েলি বসতকারীও এই সত্য স্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে রোতেম নামের এক নারী সরাসরি বলেছেন, কাসসাম ব্রিগেডের যোদ্ধারা তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে তারা নারী ও শিশুদের হত্যা করে না।
প্রতিরোধ আন্দোলনের এই নৈতিক অবস্থান তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বৈধতা আরও শক্তিশালী করছে—দেশের ভেতরে, আঞ্চলিকভাবে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
অনেক দার্শনিক মনে করেন, যুদ্ধক্ষেত্রে নৈতিকতা বজায় রাখা শুধু নীতি বা মূল্যবোধের বিষয় নয়, বরং এটি বিজয়ের কৌশল হিসেবেও কাজ করে। ইমানুয়েল কান্টসহ অনেক চিন্তাবিদই এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
কাসসাম ব্রিগেডের আচরণ আসলে ফিলিস্তিনি সমাজের মূল্যবোধেরই প্রতিফলন। তাদের এই নৈতিক অবস্থান শুধু নিজেদের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল করেনি, বরং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গিও ইতিবাচক করেছে। এটি প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন বাড়াতে পারে এবং সেই বিচ্ছিন্নতা ভাঙতে সাহায্য করতে পারে, যা দখলদার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।
নৈতিক আচরণের বাস্তব উপকারিতা
মানবিক আচরণ অপপ্রচারকে নস্যাৎ করে, ইসরায়েলি বন্দি সৈনিক ওমের শিম তোভ ও তার সঙ্গীরা সম্প্রতি প্রকাশ্যে কাসসাম ব্রিগেডের আচরণের প্রশংসা করেছেন। তারা জানিয়েছেন, বন্দি অবস্থায় তাদের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করা হয়নি। বরং তারা স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন, যা বন্দিবিনিময়ের সময় তাদের ব্যবহারে স্পষ্ট হয়েছে।
অথচ ইসরায়েল সরকার দীর্ঘদিন ধরে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালিয়ে এসেছে। এমনকি বিশ্বনেতাদের সামনে সাজানো ভিডিও উপস্থাপন করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনকে হেয় করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আমরা জানি না, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঠিক কী ধরনের ভিডিও দেখিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করছেন। তবে এটা স্পষ্ট, তারা একটি সুসংগঠিত অপপ্রচার চালাচ্ছে।
এর একটি বড় উদাহরণ হলো, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত পিবাস পরিবারের বিষয়টি। ইসরায়েল প্রথমে এই পরিবারকে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে নিহত বলে প্রচার করে, কিন্তু পরে জানা যায়, তাদের মৃত্যু হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলাতেই।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও সম্প্রতি পিবাস পরিবারের প্রসঙ্গ টেনে আনেন, যা স্পষ্টতই ইসরায়েলি অপপ্রচারের অংশ।
এই পরিস্থিতিতে কাসসাম ব্রিগেডের বন্দিদের প্রতি মানবিক আচরণের ভিডিওগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এগুলো ইসরায়েলি অপপ্রচার ভেঙে দিতে পারে এবং বিশ্ববাসীর সামনে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরতে পারে।
ইসরায়েলের অপপ্রচার ব্যর্থ হচ্ছে
ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডার আরেকটি বড় উদাহরণ জাতিসংঘে দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদানের বক্তব্য। তিনি একবার দাবি করেছিলেন, গাজার বাসিন্দারা কোনো ইসরায়েলি বন্দিকে বাঁচানোর চেষ্টা করেনি, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রচারণা।
এসব অভিযোগের ভিত্তিহীনতা এতটাই স্পষ্ট যে, ইসরায়েলি জনগণের মধ্যেও এটি খুব একটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাচ্ছে না।
সম্প্রতি জেরুজালেম পোস্ট একটি জনমত জরিপ চালায়, যেখানে ৫০ শতাংশ ইসরায়েলি উত্তরদাতা বলেছেন, তারা হামাস ও নাৎসিবাদের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পান না।
এ থেকেই বোঝা যায়, ইসরায়েল বছরের পর বছর ধরে যেসব বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, সেগুলো এখন আর আগের মতো কার্যকর হচ্ছে না। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান এবং বাস্তব চিত্র প্রকাশ পাওয়ায় ইসরায়েলি অপপ্রচার ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বন্দি ইস্যু: আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার লড়াই
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দীর্ঘদিন ধরে এমন নীতি অনুসরণ করে আসছেন, যেখানে বন্দি ইস্যুকে এড়িয়ে চলা হয়। তিনি নানা উপায়ে এ বিষয়ে আসা চাপ হালকা করার চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে বন্দিদের পরিবারের ক্ষোভ ও চাপকে প্রশমিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু হামাসের সামরিক শাখা, কাসসাম ব্রিগেড, এই ইস্যুটিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে বারবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা বন্দিদের ভিডিও প্রকাশ করে ইসরায়েলি সমাজে চাপ সৃষ্টি করছে, যাতে এই ইস্যু নেতানিয়াহুর জন্য এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। কারণ, বন্দি ইস্যু প্রতিরোধ আন্দোলনের হাতের শক্তিশালী তাস।
বন্দিদের ভিডিও ও এ সংক্রান্ত যেকোনো প্রচারণা শুধু ইস্যুটিকে সামনে রাখার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি নেতানিয়াহুর এই কৌশল ব্যর্থ করতেও সহায়ক, যেখানে তিনি বন্দি ইস্যুকে এড়িয়ে যেতে চান।
সম্প্রতি ইসরায়েলি বন্দিদের পরিবারের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়ছে। তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছে এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, অথচ নেতানিয়াহু ও তার সরকার এ নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাচ্ছে না।
এছাড়া, ইসরায়েলের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বন্দিদের পরিবারগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করছে, যাতে তারা তাদের স্বজনদের ছবি ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রচার না করতে বলেন। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য বন্দিদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা নয়, কিংবা ইসরায়েলি সমাজকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ থেকে দূরে রাখা নয়। বরং মূল লক্ষ্য নেতানিয়াহুর সরকারকে এ বিষয়ে যেকোনো রাজনৈতিক ও জনমত চাপ থেকে বাঁচানো।
কৌশল ও সৃজনশীলতা
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন বন্দি ইস্যুতে যে কৌশলী ও সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করছে, তা শুধু নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, বরং কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি প্রতিরোধ আন্দোলন যে ভিডিওটি প্রকাশ করেছে, সেখানে দেখা গেছে, দুই ইসরায়েলি বন্দি তাদের সঙ্গীদের মুক্তির দৃশ্য দেখছে এবং এরপর নিজেদের মুক্তির জন্য সরকারের প্রতি আকুতি জানাচ্ছে। ভিডিওটি ইসরায়েলের নিরাপত্তাব্যবস্থার জন্য ছিল একপ্রকার চ্যালেঞ্জ, আবার প্রতিরোধ আন্দোলনের পক্ষ থেকে বার্তা পাঠানোর অভিনব কৌশলও বটে।
এ ধরনের প্রচারণা বন্দি বিনিময় প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছানোর পথ তৈরি করছে, যা শেষ পর্যন্ত স্থায়ী যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল করতে পারে।
স্মৃতির প্রতিচিত্র
এই সব দৃশ্য—৭ অক্টোবর এক ইসরায়েলি সেনাকে ট্যাংক থেকে নামানোর মুহূর্ত থেকে শুরু করে বন্দি বিনিময়ের চিত্র—শুধু তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা নয়। এগুলো স্থানীয়, আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং এমনকি ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতেও গভীর প্রভাব ফেলবে।
এগুলো প্রতিরোধ আন্দোলন ও ইসরায়েলি সমাজ—উভয়ের জন্যই একটি বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করছে, যা দীর্ঘমেয়াদে রাজনীতি ও সামরিক কৌশলে প্রভাব ফেলতে পারে।
সূত্র : আল জাজিরার একটি আর্টিকেল অবলম্বনে লেখা