বিশ্বব্যাপী একের পর এক হুমকি দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামরিক আগ্রাসন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, সবখানেই তার সরব উপস্থিতি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এখন আর এককভাবে এসব নীতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম নয়। বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তিত বাস্তবতা, উদীয়মান শক্তিগুলোর উত্থান এবং সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ট্রাম্পের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিনি তার বেশিরভাগ হুমকি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হবেন।
ট্রাম্পের বহুমুখী হুমকি: কতটা বাস্তবসম্মত?
২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগ্রাসী নীতির জন্য আলোচিত ছিলেন। দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জয়ী হলে, তিনি আগের মতোই কঠোর অবস্থান বজায় রেখেছেন। তার হুমকির তালিকায় রয়েছে—
• সামরিক আগ্রাসন: পানামা ও গ্রিনল্যান্ডের মতো অঞ্চল দখলের ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।
• অর্থনৈতিক শাস্তি: চীন, কানাডা, মেক্সিকো, কলম্বিয়া, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করেছেন বা করার হুমকি দিয়েছেন।
• শরণার্থী স্থানান্তর: ফিলিস্তিনিদের গাজা ও পশ্চিম তীর থেকে সরিয়ে অন্যত্র পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
• বৈদেশিক সাহায্য হ্রাস: মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (USAID)-এর কার্যক্রম বন্ধ করার কথা বলেছেন।
যুদ্ধ কি জয় করা সম্ভব? বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে
ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর নীতির মূল লক্ষ্য ছিল, সামরিক শক্তি ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বাধ্য করা। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বলছে, এই কৌশল আর আগের মতো কার্যকর নয়।
• ইউক্রেন সংকট: যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের সর্বোচ্চ সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে ইউক্রেনের জেলেনস্কি সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু এতে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেন এখনও স্পষ্ট কোনো বিজয় অর্জন করতে পারেনি।
• গাজা যুদ্ধ: ইসরায়েলকে সহায়তা করেও যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতে সরাসরি সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বরং হামাস ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছে, যা মার্কিন কূটনীতির জন্য বড় ধরনের ধাক্কা।
• চীনের পাল্টা আঘাত: ট্রাম্প যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (AI) ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিলেন, তখন চীনের DeepSeek কোম্পানি এমন প্রযুক্তি নিয়ে এলো, যা মার্কিন কোম্পানি Nvidia-র শেয়ারের মূল্য ১৬% কমিয়ে দিয়েছে।
• বিশ্ব বাণিজ্যে পরিবর্তন: চীন ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করতে চলেছে। এদিকে, ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ১.১% বেড়েছে, যেখানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাণিজ্য ৬.৪% বৃদ্ধি পেলেও উন্নত দেশগুলোর মধ্যে এটি ২.২% হ্রাস পেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কি এককভাবে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রই ছিল বৈশ্বিক নেতৃত্বের মূল চালক। কিন্তু ২১ শতকের বাস্তবতা ভিন্ন। ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চীনের জিডিপি ৬৭% বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বৃদ্ধি ছিল ৫৯.৯%। এছাড়া, ভারত ও ব্রাজিলের মতো দেশ অর্থনীতিতে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ট্রাম্পের চাপ কি বিশ্ব মেনে নেবে?
ট্রাম্পের নীতি নিয়ে বিশ্বের প্রতিক্রিয়াও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—
• চীন ও কানাডার পাল্টা শুল্ক: ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে চীন ও কানাডাও পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে।
• কলম্বিয়ার প্রত্যাখ্যান: যুক্তরাষ্ট্রের শরণার্থী স্থানান্তরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে কলম্বিয়া।
• ডেনমার্কের বিরোধিতা: গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে ডেনমার্ক।
• ভেনিজুয়েলার সঙ্গে আপস: যুক্তরাষ্ট্র এখন ভেনিজুয়েলার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে তেল আমদানি নিয়ে, যা ট্রাম্পের আগের কঠোর অবস্থানের বিপরীত।
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের চাপে বিপদে পড়বে কারা?
ট্রাম্পের কৌশল মূলত দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে আরও চাপে ফেলার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
• জর্ডান: দেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে বাজেট ঘাটতি মেটাতে ১০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে হবে, যার মধ্যে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার মার্কিন গ্যারান্টির ওপর নির্ভরশীল। যদি এই সাহায্য বন্ধ হয়, তাহলে জর্ডান নতুন অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে।
• মিশর: দেশটির জাতীয় ঋণ বর্তমানে জিডিপির ৯৫%-এ পৌঁছেছে, যা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
• ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের চাপ: ট্রাম্প প্রশাসন মিশর ও জর্ডানের ওপর চাপ দিচ্ছে, যেন তারা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের গ্রহণ করে।
তাহলে ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে, ট্রাম্প তার হুমকিগুলো থেকে একে একে পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছেন।
• ভেনিজুয়েলার সঙ্গে তেল আমদানির জন্য আলোচনায় বসেছে যুক্তরাষ্ট্র।
• কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর শুল্ক বসানোর সিদ্ধান্ত এক মাসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে।
• ন্যাটো মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের করণীয় কী?
বিশ্বের দেশগুলোর উচিত ট্রাম্পের চাপে নতি স্বীকার না করে নিজেদের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত করা। বিশেষ করে—
• ডলারনির্ভরতা কমিয়ে বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্য বাড়ানো।
• চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করা।
• মধ্যম আয়ের দেশগুলোর নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানো।
বিশ্ব এখন আর আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর নেই। ট্রাম্প যতই হুমকি দিন, বাস্তবতা বলছে, তিনি সব যুদ্ধ একসঙ্গে লড়তে পারবেন না। বরং, পাল্টা চাপে পড়ে তাকে একের পর এক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হচ্ছে। ফলে, বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য আর আগের মতো নেই।
সূত্র : মায়াদিন