গত ৮ই ডিসেম্বর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হাতে সিরিয়ার স্বৈরাচার বাশার আল আসাদের পতন ঘটে। এটি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। আসাদের পতন শুধু সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই নয়, ইরানের মতো আঞ্চলিক শক্তির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বাশার আল আসাদ ইরানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল। তার পতনের ফলে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব দুর্বল হয়েছে, বিশেষত লেবানন ও সিরিয়ায় তাদের স্থাপিত সরবরাহ শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ইরান নিজেদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে এক ধরনের দ্বিধায় রয়েছে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
বাশার আল-আসাদের পতনের পর ইরান দুই ধরনের মনোভাব প্রকাশ করেছে। একদিকে, তারা সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ইচ্ছা দেখিয়েছে। অন্যদিকে, ইরান সিরিয়ার অভ্যন্তরে উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে এমন হুমকিও দিয়েছে।
গত ৫ই জানুয়ারি ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি কমিটির সদস্য আহমাদ বখশিশ আরদাস্তানি বলেন, ‘সিরিয়ায় সশস্ত্র সংঘাত থামবে না, বরং আরও বাড়বে।’ তিনি সিরিয়ায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানালেও, নতুন প্রশাসনকে ‘চরমপন্থী ইসলামি গোষ্ঠী’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অযোগ্য বলে মনে করেন। ইরানের এমন দোদুল্যমান অবস্থান দেশটির ভবিষ্যৎ নীতিতে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ইরানের অভিযোগ এবং সিরিয়ার প্রতিক্রিয়া
গত ২১ ডিসেম্বর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি দাবি করেন ‘সিরিয়ার রাজনৈতিক পরিবর্তন আমেরিকা ও ইসরায়েলের একটি বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ, যা ইসরায়েলের-বিরোধী প্রতিরোধ জোটকের শক্তি খর্ব করতে চায়।’
তবে, তিনি এইও বলেন, ইরান সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায় না এবং তাদের উপস্থিতি ছিল আসাদ সরকারের আমন্ত্রণে। এই বক্তব্যে ইরানের অবস্থান রক্ষার চেষ্টা স্পষ্ট হলেও, সিরিয়ার বর্তমান সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল কড়া।
সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদ শিবানি ইরানকে সতর্ক করে বলেন, ‘ইরানের উচিত সিরিয়ার জনগণের ইচ্ছা ও দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখানো।’ তিনি আরও বলেন, ইরানের যদি সিরিয়ার অভ্যন্তরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার পরিকল্পনা থাকে, তবে তার প্রতিক্রিয়া ইরানের জন্যই ক্ষতিকর হবে।
আসাদের পতন এবং ইরানের ভূ-রাজনৈতিক দুর্বলতা
বাশার আল-আসাদের শাসনকাল ইরানের জন্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যে একটি শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করার শক্ত খুঁটি। সিরিয়ায় অবস্থান করে ইরান লেবাননের হিজবুল্লাহ-এর মতো গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করত। তবে আসাদের পতনের পর, ইরান কার্যত সিরিয়ায় তাদের কৌশলগত সুবিধা ও সমর্থক দুটোই হারিয়েছে।
সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের নেতা আহমাদ আশ শারা বলেন, ‘সিরিয়া ছিল ইরানের একটি খেলার মঞ্চ, যেখান থেকে তারা চারটি আরব রাজধানীকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু এখন ইরান এই ক্ষমতা হারিয়েছে।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইরানের মধ্যপ্রাচ্য প্রকল্প ৪০ বছরের পেছনে চলে গেছে।
ইরানের সামরিক হস্তক্ষেপ এবং তার ফলাফল
ইরান তাদের কুদস ফোর্সের মাধ্যমে সিরিয়ায় ১,৩০,০০০ যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। তবে, আসাদের পতনের সময় এই বাহিনী কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে লজ্জাজনকভাবে ব্যর্থ হয়। বিশ্লেষক মুরওয়ান ফারজাত বলেন, ইরান সিরিয়ায় সীমিত সংখ্যক অনুগত যোদ্ধা রেখে গেছে, যাদের বেশিরভাগই বর্তমানে অকেজো।
বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন: ইরানের দুর্বলতা
আমেরিকার ‘ওয়ার স্টাডিজ ইনস্টিটিউট’-এর গবেষণায় বলা হয়েছে, আসাদের পতনের পর ইরানের ভূ-রাজনৈতিক শক্তি উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণ ও হিজবুল্লাহর পরাজয় ইরানের ওপর চাপ আরও বাড়িয়েছে।
গবেষকরা আরও বলছেন, ইরান সিরিয়া-লেবানন সংযোগ পুনঃস্থাপনের চেষ্টা করছে। তবে আসাদ সরকারের পতন এই পরিকল্পনাকে ব্যাহত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান ভূ-রাজনীতি ইরানের জন্য এক চ্যালেঞ্জিং অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাশার আল-আসাদের পতন মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সিরিয়ার নতুন সরকার নিজ দেশকে নতুনভাবে গড়ার চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, ইরান তাদের প্রভাব হারানোর শূন্যতা পূরণ করতে মরিয়া। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আসাদের পতনের পর ইরানের ক্ষমতা অনেকটাই কমে গেছে।
ইরানের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো তাদের নীতি পুনর্গঠন এবং সিরিয়ার নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। তবে যদি তারা উত্তেজনা সৃষ্টির পথে হাঁটে, তাহলে তা তাদের জন্যই ক্ষতি পরিণতি বয়ে আনবে।
সূত্র : ইনাব বালাদি