মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

পাকিস্তানের তালেবানভীতির নেপথ্যে

পাকিস্তানের তালেবানভীতির নেপথ্যে
পাকিস্তানের তালেবানভীতির নেপথ্যে। ছবি : সংগৃহীত

আফগানিস্তান যখন নিজ দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুসম্পর্ক স্থাপনে কাজ করে যাচ্ছে, তখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আবারও আফগানিস্তানে আঘাত হেনেছে। গত কয়েক দিন ধরে দক্ষিণ-পূর্ব আফগানিস্তানের খোস্ত ও পাকতিয়া প্রদেশে বেসামরিক জনগণের ওপর হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অজুহাত তুলে এবং ভিত্তিহীন অভিযোগে এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন বহু নারী ও শিশু। ধ্বংস হয়েছে স্থানীয়দের বসতবাড়ি।

পাকিস্তান দাবি করেছে, তাদের সাম্প্রতিক হামলা আফগানিস্তানের ভেতরে থাকা ‘তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি)-এর সদস্যদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে। পাকিস্তানের ভাষ্যমতে, এসব হামলার লক্ষ্য ছিল ডুরান্ড লাইনের ওপারে থাকা পাকিস্তানবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। উল্লেখ্য, ডুরান্ড রেখা ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে পশতুন জনগোষ্ঠীকে বিভক্ত করতে নির্ধারণ করা হয়েছিল, যা আজও আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে বিতর্কপ্রবণ বিষয় হয়ে আছে।

আফগানিস্তানের ইসলামী আমিরাত ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রতিবেশী ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ‘কারও ক্ষতি না করা এবং নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া’ নীতির আওতায় দেশটি কূটনৈতিক সম্পর্ক দৃঢ় করতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এই নীতির আলোকে আফগানিস্তান বিশ্বের বহু দেশের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করেছে এবং উন্নত করেছে।

কিন্তু পাকিস্তান বরাবরই এই সম্পর্ককে উপেক্ষা করে আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘাত বাড়িয়ে তুলছে। একের পর এক হামলা চালানোর পাশাপাশি আফগান ভূখণ্ডে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষত ‘আইএস’ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে আফগানিস্তানে হামলা চালানোর বিষয়ে আফগান সরকার বারবার পাকিস্তানকে সতর্ক করলেও দেশটি এসব কর্মকাণ্ড থামায়নি।

পাকিস্তানের এই শত্রুতামূলক আচরণ নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তানে ২০ বছরের যুদ্ধকালীন পাকিস্তান তাদের বিমানঘাঁটি এবং জমি দখলদারদের হাতে তুলে দেয়। সেই সময় মার্কিন ও মিত্র বাহিনী পাকিস্তানের ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করে আফগানিস্তানে গণহত্যা চালায়। আফগানদের ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট।

এছাড়াও, পাকিস্তান বরাবরই আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছে। বিশেষত, তোরখাম ও স্পিন বোল্ডাক সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে আফগান ব্যবসায়ীদের ভোগান্তিতে ফেলে দেশের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বাধা তৈরি করে আসছে বরাবরই।

শুধু বাণিজ্যে নয়, পাকিস্তান আফগান শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও দমনপীড়নের নীতি গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানে আশ্রয় নেওয়া আফগান শরণার্থীদের ওপর নির্যাতন চালানো, সম্পত্তি দখল করা এবং জোরপূর্বক দেশে ফেরত পাঠানোর মতো কাজ করে আসছে। । ২০২২ সালের শীত মৌসুমে পাকিস্তান প্রায় পাঁচ লাখ আফগান শরণার্থীকে জোর করে দেশে ফেরত পাঠায়। এবারও পাকিস্তান শীতের শুরুতে একই কর্মকাণ্ডের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের এই শত্রুতামূলক কার্যক্রম শুধু আফগানিস্তানের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগান সরকার বারবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়ে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

আফগানিস্তান শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের নীতিতে বিশ্বাসী হলেও পাকিস্তানের শত্রুতাপূর্ণ কার্যক্রমের কারণে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এমন আচরণ আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করছে। প্রশ্ন থেকে যায়, সাধারণ মানুষের ওপর হামলা এবং প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করে পাকিস্তান আসলে কী অর্জন করতে চায়?

পাকিস্তানের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম মূলত তাদের নিজস্ব ভূখণ্ডেই পরিচালিত হয়। এসব গোষ্ঠী আফগানিস্তানের মাটি ব্যবহার করে না। অথচ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই অজুহাতে বারবার আফগান ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে বেসামরিক জনগণকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে।

প্রশ্ন হলো, কেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এ ধরনের ভিত্তিহীন অভিযোগের আশ্রয় নিচ্ছে? কেন নিরীহ নারী-শিশুদের রক্ত ঝরানোর পথে হাঁটছে ? আফগান জনগণকে শান্তিতে বসবাস করতে না দিয়ে পাকিস্তান আসলে কী অর্জন করতে চায়?

আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন, সেখানে পাকিস্তান উল্টো কাজ করছে। দেশটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএসসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে মদদ দিচ্ছে। তাদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির, নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং লজিস্টিক সহায়তা সরবরাহ করছে।

এই দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ শুধু আফগানিস্তান নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য বড় হুমকি। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা এই ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধ করে এবং তাদের ব্যর্থ নীতিগুলো সংশোধন করে।

পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বর্তমান নীতি দেশটির নিজস্ব স্বার্থে যেমন ক্ষতিকর, তেমনই তা প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও বিপদজনক। এ ধরনের নীতি শুধু উত্তেজনা বাড়ায় এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে।

পাকিস্তানের উচিত তার অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং সেগুলোর জন্য আফগানিস্তানকে দায়ী না করা। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বারবার দোষারোপ এবং সামরিক পদক্ষেপ কেবল দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাবে।

আফগান সরকার বারবার পাকিস্তানকে তাদের সামরিক কার্যক্রম বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। আফগানিস্তানের জনগণ কখনো অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়নি। তারা নিজেদের শক্তি ও ধৈর্যের মাধ্যমে শতাব্দী ধরে যেকোনো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করেছে। পাকিস্তানের উচিত আফগানিস্তানের জনগণের ধৈর্য পরীক্ষা না করা।

সম্প্রতি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর হামলার প্রতিশোধ হিসেবে আফগান বাহিনী ডুরান্ড রেখার ওপারে পাকিস্তানি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। একই সঙ্গে আইএসের ঘাঁটি লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছে। এ ধরনের প্রতিরোধ আফগানিস্তানের জনগণের প্রতিজ্ঞার প্রতিফলন।

পাকিস্তানের উচিত তাদের ভুল নীতি ও কার্যক্রম বন্ধ করে আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। অভিযোগ-প্রতিঅভিযোগের রাজনীতি বাদ দিয়ে দেশগুলোর উচিত নিজেদের সীমানা সুরক্ষিত করা এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা। আফগানিস্তান এখন এমন মানুষের দ্বারা রক্ষিত, যারা নিজেদের দেশপ্রেমে অবিচল। কোনো ষড়যন্ত্র বা আক্রমণে তাদের মনোবল ভাঙানো সম্ভব নয়।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা