গাজার দক্ষিণাঞ্চলের ধ্বংসস্তূপে পরিণত রাফা শহরের সুড়ঙ্গের ভেতর আটকে পড়েছেন প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধযোদ্ধা। সম্প্রতি এই ঘটনাই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী ধাপে যাওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যেই এই ইস্যুটি নতুন করে গুরুত্ব পেয়েছে।
গত ১০ অক্টোবর কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করতে ইসরায়েল এই ইস্যুটি কাজে লাগাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ইসরায়েলের কৌশলগত পদক্ষেপ, যাতে চুক্তির অগ্রগতি মন্থর হয় এবং ময়দানে চাপ বজায় থাকে।
রাফার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা প্রতিরোধযোদ্ধাদের ভাগ্য নিয়ে এখন তীব্র টানাপোড়েন চলছে দখলদার ইসরায়েল ও ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের মধ্যে।
মার্কিন ও ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখতে এই ইস্যুর সমাধানে চাপ দিচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।

রাফায় অবরুদ্ধ হামাস যোদ্ধারা কারা?
হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেড জানিয়েছে, তাদের কয়েকজন যোদ্ধা এখনো রাফায় ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় অবস্থান করছেন।
তারা রয়েছেন ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে, যেটি তথাকথিত ‘হলুদ রেখা’র ভেতরে অবস্থিত। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের অংশ হিসেবে এই রেখা পর্যন্তই ইসরায়েলি সেনারা পিছু হটেছে। পুরো রাফা শহরই এখন এই সীমার মধ্যে পড়েছে।
ইসরায়েলি সূত্রের হিসেবে, সেখানে এখন ১৫০ থেকে ২০০ জন প্রতিরোধযোদ্ধা আটকে আছেন। তবে হামাস বা কাসসাম ব্রিগেডের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি।
এই ঘটনার সূত্রপাত কোত্থেকে?
গত ২৯ অক্টোবর রাফায় ইসরায়েলের একটি সামরিক ইউনিটে হামলার ঘটনায় এক রিজার্ভ সেনা নিহত হয়েছে বলে জানায় দখলদার ইসরায়েলি। তেলআবিবের দাবি, এই হামলাতেই যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ হয়েছে।
এর পরপরই গাজা উপত্যকাজুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা চালায় দখলদার বাহিনী। এতে একশর বেশি ফিলিস্তিনি শহিদ হন। রাফায় একের পর এক বোমা বর্ষণ করে তারা শহরের অবশিষ্ট ভবনগুলোও গুঁড়িয়ে দেয়।
এর আগে, ওই ঘটনার প্রায় দশ দিন আগে, রাফায় দুই সেনা নিহতের অভিযোগ তুলে গাজায় হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল। সেই অভিযানে প্রাণ হারান অন্তত ৫০ জন ফিলিস্তিনি।
রাফা সংকট সমাধানে গৃহীত পদক্ষেপ
রাফার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা হামাস যোদ্ধাদের ইস্যু সমাধানে ইসরায়েল ও হামাস, দুই পক্ষের ওপরই চাপ বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন তথ্য দিয়েছে একাধিক মার্কিন ও ইসরায়েলি গণমাধ্যম।
ইসরায়েলের চ্যানেল 12 জানায়, গত শনিবার এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন হামাসের কাছে ইসরায়েলি সেনা হাদার গোল্ডিনের মরদেহ ফেরত চেয়েছে। এর বিনিময়ে রাফায় আটকে থাকা হামাস যোদ্ধাদের সংকট মেটাতে সমঝোতার সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে আশা করছে ওয়াশিংটন।’
কিন্তু দুই দিন আগে রাফা থেকে নিহত ইসরায়েলি সেনা হাদার গোল্ডিনের মরদেহ ফেরত দিলেও রাফার সমস্যা সমাধানের কোনো ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না। ২০১৪ সালে প্রতিরোধযুদ্ধে নিহত হয় হাদার গোল্ডিন। ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে, ফেরত পাওয়া দেহাবশেষটি গোল্ডিনেরই।
ইসরায়েলি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, রাফার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা হামাস যোদ্ধাদের ইস্যুটি আজকের আলোচনার অংশ হতে পারে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের দুই দূত, জ্যারেড কুশনার ও স্টিভেন উইটকফ ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সরকারি সম্প্রচারসংস্থা।
সংকট সমাধানে কী কী প্রস্তাব উঠেছে?
আমেরিকান ও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রাফায় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সংকট সমাধানে একাধিক প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে।
ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দাবি, রাফার সুড়ঙ্গে থাকা হামাস যোদ্ধাদের সামনে দুটি পথই খোলা, আত্মসমর্পণ করা বা সুড়ঙ্গেই মৃত্যু বরণ করা। কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন, তাঁদের আটক করে ইসরায়েলে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক।
তবে মার্কিন ও ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমে যে প্রস্তাবগুলো আলোচিত হচ্ছে, সেখানে বলা হচ্ছে, প্রতিরোধযোদ্ধারা যদি অস্ত্র জমা দেন, তবে তাঁদের নিরাপদে গাজায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে।
আরেকটি প্রস্তাব অনুযায়ী, রাফার সুড়ঙ্গ থেকে বের হওয়ার পর তাঁদের কোনো তৃতীয় দেশে স্থানান্তর করা হতে পারে।
ইসরায়েলি সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে এই ইস্যুতে কিছুটা নমনীয় হতে বাধ্য হতে পারে ইসরায়েল।
হামাসের অবস্থান কী?
হামাস জানিয়েছে, রাফায় অবরুদ্ধ যোদ্ধারা কোনো অবস্থাতেই আত্মসমর্পণ করবে না। একই সঙ্গে তারা মধ্যস্থতাকারীদের আহ্বান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি বিপন্ন করতে পারে, এমন সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ইসমাইল রিজওয়ান বলেন, হামাস মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়েছে যে তারা রাফার দখলকৃত এলাকা থেকে যোদ্ধাদের ‘হলুদ রেখা’র পেছনে সরিয়ে নিতে প্রস্তুত। তবে তিনি সতর্ক করে দেন, ইসরায়েলি বাহিনী যদি সেই এলাকায় অভিযান চালায়, তার দায়ভার সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলের ওপরই বর্তাবে।
অন্যদিকে, কাসসাম ব্রিগেড রোববার এক বিবৃতিতে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে যে রাফায় অবরুদ্ধ প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ওপর হামলা হলে তার পরিণতি গুরুতর হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘হামাসের অভিধানে আত্মসমর্পণ বলতে কিছু নেই।’
সমাধান প্রচেষ্টায় তুরস্কের ভূমিকা
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এক শীর্ষ তুর্কি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তুরস্ক ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা হাদার গোল্ডিনের মরদেহ ফেরত পাঠাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তিনি আরও জানান, আঙ্কারা এখন গাজার সুড়ঙ্গে আটকে থাকা প্রায় ২০০ ফিলিস্তিনির জন্য একটি নিরাপদ করিডর নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। সূত্রগুলো বলছে, এই ফিলিস্তিনিরা মূলত রাফা অবরুদ্ধ হামাসের যোদ্ধা। গোল্ডিনের মরদেহ ফেরত পাঠানোর পর এ বিষয়ে নতুন করে সক্রিয় হয়েছে তুরস্ক।
সূত্র: আল জাজিরা











