‘যদি আমার এই কথাগুলো তোমাদের কাছে পৌঁছায়, তবে বুঝবে—ইসরায়েল আমাকে হত্যা করে আমার কণ্ঠরোধ করেছে।’ এভাবেই শুরু হয় আনাস শরিফের শেষ অসিয়ত। গাজা উপত্যকায় সহকর্মী মুহাম্মদ কুরাইকা ও কয়েকজন আলোকচিত্রীসহ তাঁকে হত্যা করে দখলদার ইসরায়েলের সেনারা।
শিফা হাসপাতালের পাশে সাংবাদিকদের জন্য স্থাপিত তাঁবুতে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে ও তাঁর সহকর্মী মুহাম্মাদ কুরেইকা এবং কয়েকজন ফটোসাংবাদিককে হত্যা করে দখলদার ইসরায়েলি বাহিনী। শরীফের মৃত্যুর পর প্রকাশিত অসিয়তে উঠে এসেছে তাঁর অটল বিশ্বাস, অবিচল আদর্শ এবং যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য তুলে ধরার অঙ্গীকার।
শেষ বার্তায় আনাস শরীফ লিখেছেন, ‘আল্লাহ জানেন, আমার যা কিছু শক্তি ও সামর্থ্য আছে—সবটুকু আমি ব্যয় করেছি আমার জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে ও তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে।’ তিনি বলেন, জীবনে হাজারো যন্ত্রনা ও প্রিয়জন হারানোর কষ্ট সয়েও কখনো সত্য বলা থামাইনি।
শরীফকে হত্যার আগে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক উসকানিমূলক প্রচারণা চালায় ইসরায়েল। এরপর দখলদার সেনারা তাঁকে টার্গেট করে হামলা চালায়। উত্তর গাজায় থেকে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও দুর্ভিক্ষের বাস্তবিক চিত্র তুলে ধরা কয়েকজন সাংবাদিকের একজন ছিলেন তিনি।
বার্তায় শরীফ ফিলিস্তিনকে বর্ণনা করেছেন ‘মুসলমানদের মুকুটমণি’ ও ‘প্রতিটি স্বাধীন হৃদয়ের স্পন্দন’ হিসেবে। তিনি ফিলিস্তিনের জনগণ ও শিশুদের উপর আস্থা রাখার আহ্বান জানান। যারা জীবন নিয়ে স্বপ্ন দেখার ও নিরাপদে বাঁচার সুযোগই পায়নি। এর আগেই তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয়েছে ইসরায়েলের বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে।
শেষ অসিয়তে তিনি পরিবারের কথাও লিখেছেন। উল্লেখ করেছেন মেয়ে শামের কথা, যাকে বড় হতে দেখার স্বপ্ন ছিল তাঁর। লিখেছেন ছেলে সালাহর কথা, যে একদিন তাঁর ভরসা হবে বলে আশা করেছিলেন। স্মরণ করেছেন মায়ের কথা—যার দোয়া তাঁর জন্য ছিল দুর্ভেদ্য দুর্গ আর পথের দিশা। আর বলেছেন স্ত্রীর কথা, যিনি যাইতুন গাছের মতো দৃঢ়তা ও ধৈর্য নিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা মোকাবিলা করেছেন।
আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টি জানিয়ে তিনি বার্তাটি শেষ করেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন নিজের আদর্শে অটল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল—তাঁর রক্ত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পথে আলো হয়ে জ্বলবে। জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত সেই অঙ্গীকার তিনি রক্ষা করেছেন।
গাজার আশ শিফা হাসপাতালের পাশে সাংবাদিকদের একটি তাঁবুতে দখলদার বাহিনীর হামলার কয়েক ঘণ্টা পর এই বার্তাটি প্রকাশিত হয়। এই হামলায় আনাস শরীফ, তাঁর সহকর্মী মোহাম্মদ কুরেইকা এবং আরও তিন জন ফটোগ্রাফার শহীদ হন। এই হত্যাকাণ্ডে ফিলিস্তিনসহ আন্তর্জাতিক মহল তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে।
হামাস ও ইসলামিক জিহাদ আন্দোলন শহীদ সাংবাদিকদের প্রতি শোক প্রকাশ করেছে। এই হত্যাকাণ্ডকে একটি পরিকল্পিত যুদ্ধাপরাধ উল্লেখ তারা বলেন, সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর জন্য এই ধরনের হামলা চালানো হয়েছে। যাতে নতুন করে গণহত্যা চালানো সহজ হয়। আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা দখলদার বাহিনীকে তাদের অপরাধ চালিয়ে যেতে উৎসাহ জোগাচ্ছে।
জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদক আইরিন খান সম্প্রতি আনাস শরীফের প্রতি ইসরায়েলের হুমকির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর জীবন ঝুঁকিতে আছে।
বর্তমান যুদ্ধে দখলদার ইসরায়েল আল জাজিরার বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা করেছে। তাঁদের মধ্যে আছেন ইসমাইল গুল ও হুসাম শুবাত।
সূত্র: আল জাজিরা











