দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে এক নাটকীয় মোড় এসেছে। ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর পর ভারতের বহুমুখী কূটনৈতিক অবস্থান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, আর সেই সুযোগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দৃশ্যপটে জোরালোভাবে ফিরে এসেছে পাকিস্তান। ফরাসি প্রভাবশালী দৈনিক ল্য মোঁদ-এর এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমনই চিত্র।
হোয়াইট হাউসে জেনারেল, হতবাক দিল্লি
১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির হোয়াইট হাউসে উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরাসরি প্রশংসা ও আন্তরিক ব্যবহারে রীতিমতো চমকে ওঠে দিল্লি।
ভারতের জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য বলবীর অরোরা বলেন,
‘আমরা এক ঐতিহাসিক পালাবদল প্রত্যক্ষ করছি। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই পরাশক্তিই পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে, আর ভারত আজ হয়তো প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে হয়ে পড়েছে।’
‘সিন্দুর’: মোদির কৌশল ও উল্টো ফলাফল
কাশ্মীরে পর্যটক হত্যার জবাবে ৭ মে ভারত পাকিস্তানে ‘অপারেশন সিন্দুর’ নামে হামলা চালয়। পাকিস্তান-ভিত্তিক বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দায়ী করে এই হামলা চালানো হয়। কিন্তু মাত্র চার দিনের মাথায় পাকিস্তান পাল্টা আঘাত হানে, এবং পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছে যে, হস্তক্ষেপ করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে।
বিশ্লেষকদের মতে, মোদি সরকার ভেবেছিল, ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে ভারতের পাশে থাকবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ওপর নিজেদের প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, যাতে ইসলামাবাদ পুরোপুরি চীনের প্রভাবমুক্ত না হয়ে যায়। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের অস্ত্রভাণ্ডারের ৮০ শতাংশ এখন চীনের সরবরাহে, আর চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগও দেশটিতে বিপুল।
জাতিসংঘে পাকিস্তান, কোণঠাসা ভারত
‘সিন্দুর’ অভিযানের পর ভারত একাধিক দেশের সঙ্গে মিলে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদের দায়ে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। উল্টো জাতিসংঘে ইসলামাবাদ গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদ পায়—তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটির সভাপতি ও সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির সহ-সভাপতি।
এমনকি ভারত চাইলেও পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF)-এর ১.৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আটকাতে পারেনি। ভারত বলেছিল, এই অর্থ সন্ত্রাসে ব্যবহৃত হতে পারে, কিন্তু সেই অভিযোগ গুরুত্ব পায়নি।
ভারতের কৌশল: নিরপেক্ষতা না বিভ্রান্তি?
বহুদিন ধরেই ভারত বহুপাক্ষিক নিরপেক্ষতার কৌশল অনুসরণ করে আসছে—একক কোনো জোটে না জড়িয়ে বিভিন্ন পরাশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা। কিন্তু এই নীতি এখন ভারতের একাকীত্বের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বলবীর অরোরা বলেন, ‘এই নিরপেক্ষতার কৌশল ভারতের আন্তর্জাতিক ভূমিকা ও অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলেছে।’
স্বরাষ্ট্রনীতি নিয়ে সমালোচনা
এদিকে, গাজায় মানবিক বিপর্যয় ও ইরানের বিরুদ্ধে উত্তেজনার সময়ে ভারতের নীরবতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী বলেন,‘এই নীরবতা শুধু রাজনৈতিক ব্যর্থতা নয়, এটা আমাদের কূটনৈতিক ঐতিহ্যেরও বিসর্জন। এটা ভোট হারানোর চেয়েও বড়—নীতির প্রশ্নে আত্মসমর্পণ।’
ভারতের কূটনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে
কাশ্মীর বিশেষজ্ঞ ক্রিস্টোফ জাফরেলো ল্য মোঁদ-কে বলেন,
‘সিন্দুর অভিযান ভারতের কূটনৈতিক দুর্বলতা স্পষ্ট করে দিয়েছে। যতটা শক্তিশালী ভাবা হয়, ভারত ততটা নয়। বরং পাকিস্তান এখন চীনের ছায়ায় আন্তর্জাতিকভাবে অনেক বেশি সমর্থন পাচ্ছে।’
‘সিন্দুর’ অভিযান যেন মোদি সরকারের বহুমুখী কূটনৈতিক কৌশলের অন্তঃসারশূন্যতা সামনে এনে দিয়েছে। একদিকে পাকিস্তান কৌশলে জোট গড়ে শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করছে, অন্যদিকে ভারত তার দীর্ঘদিনের কৌশলগত অবস্থান নিয়ে প্রশ্নের মুখে।
সূত্র: Le Monde