নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞের পর গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি চলছে। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষ দলে দলে ফিরছেন নিজ নিজ ঠিকানায়। ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে আবার স্বপ্নের প্রাসাদ গড়ে তুলার প্রত্যয় সবার মাঝে।
গাজার নারী-শিশুদের মধ্যে আতঙ্ক আর নেই। সাংবাদিকরাও খুলে ফেলেছেন হেলমেট আর সুরক্ষা ভেস্ট। গতকাল তাদেরকে যুদ্ধবিরতির আনন্দ ভাগাভাগি করতে দেখা গেছে সহযোদ্ধা ভাই-বন্ধুদের সাথে।
সামরিক যোদ্ধাদের পাশাপাশি গাজা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন সাংবাদিকরা। সত্য প্রকাশের দুর্দান্ত সাহস, নির্ভীকতা এবং কাজের প্রতি অনুপম নিষ্ঠার সাথে তারা পৃথিবীর সামনে প্রকাশ করেছেন দখলদার ইসরায়েলি বাহিনীর ( আইডিএফ) বর্বরতার মর্মন্তুদ সব খবর। সেজন্য অবশ্য নিজেদের প্রাণও খোয়াতে হয়েছে অনেককে।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটির তথ্য মতে এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬০ জনের বেশি সাংবাদিক। যা সংঘাতে সাংবাদিক মৃত্যুর সব পূর্ব-রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা এক প্রতিবেদনে যুদ্ধে প্রাণ হারানো সাংবাদিকদের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছে। সেখানে কয়েকজন সাংবাদিকের আবেগঘন অন্তিম বার্তা তুলে ধরা হয়েছে ,সম্প্রচারকালেই যারা বোমা কিংবা বুলেটের আঘাতে যারা প্রাণ হারিয়েছেন। যেগুলো গাজা উপত্যকার নিঃসঙ্গতা কেবল নয় বরং পৃথিবীর অসহায়ত্বকেই যেন প্রকাশ করেছে।
হিশাম আল–নাওয়াজাহ
২৭ বছর বয়সী হিশাম খবর নিউজ এজেন্সির একজন সাংবাদিক। ২০২৩ সালের ৯ অক্টোবর গাজার পশ্চিমাঞ্চলের রামাল জেলার একটি এলাকায় বিমান হামলায় তিনি নিহত হন। এসময় তিনি ইসরায়েলি বাহিনী কর্তৃক একটি ভবন জোরপূর্বক খালি করার ঘটনা কভার করছিলেন। সর্বশেষ সম্প্রচারে হিশাম বলেন,
“ এই ঔদ্ধত্বপূর্ণ, ধ্বংসাত্মক এবং হিস্টোরিক্যাল বোম্বিং ইসরায়েল চালাচ্ছে গাজা উপত্যকায় অবৈধ দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য। হে গাজাবাসী, আপনারা শান্ত থাকুন, নিজেদের উদ্বেগ নিয়ন্ত্রণ করুন, পরস্পরকে আশ্বস্ত করুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদেরেকে নিরাপত্তা দিন”।
হিশাম সাহস ও নির্ভীকতার সাথে যুদ্ধক্ষেত্রের কঠিন বাস্তবতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন। তার মৃত্যু আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, যুদ্ধের সত্য তুলে ধরতে গিয়ে সাংবাদিকদের কী ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়।
আয়াত খাদৌরা
একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক এবং পডকাস্ট উপস্থাপক। ২০২৩ সালের ৬ নভেম্বর উত্তর গাজার বাইত আল লাহিয়ায় তার বাড়ি লক্ষ্য করে পরিচালিত বিমান হামলায় পরিবারের আরও সদস্যসহ তিনি নিহত হন। আয়াত গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি তুলে ধরতে সামাজিক মাধ্যমে নিয়মিত ভিডিও শেয়ার করছিলেন।
তার সবচেয়ে হৃদয়বিদারক পোস্টগুলোর একটি ছিল ‘পৃথিবীর জন্য আমার শেষ বার্তা’ শিরোনামে। ওই ভিডিওতে আয়াত বলেন,
‘আমরাও অন্য সবার মতোই মানুষ। জীবন নিয়ে আমাদেরও বড় বড় স্বপ্ন ছিল, কিন্তু এখন আমাদের স্বপ্ন হলো অক্ষত অবস্থায় মরতে পারা। যেন আমাদেরকে টুকরো টুকরো আকারে ব্যাগে ভরে দাফন করতে না হয়। যেন সবাই জানতে পারে আমরা কে ছিলাম।’
আয়াতের এই বার্তা গাজার মানুষের দুর্দশা ও জীবন-মৃত্যুর করুণ বাস্তবতা তুলে ধরে।
জাবের আবু হাদ্রুস
৩৬ বছর বয়সী জাবের আবু হাদ্রুস কুদস আল-ইয়াওম মিডিয়ার সম্প্রচার বিভাগের একজন সাংবাদিক। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসের 30 তারিখে গাজার উত্তরাঞ্চলের নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। তিনি তার পরিবারের আরও সাতজন সদস্যের সঙ্গে প্রাণ হারান। শেষ সম্প্রচারে জাবেরের অন্তিম কথাগুলো ছিল:
‘আমার কলম এবং ক্যামেরা ছিল আমার অস্ত্র। কিন্তু এখন, গল্প বলার জন্য আমার কেউ আর বেঁচে নেই। যদি কেউ আমার গল্প শুনতে পান, জানবেন আমি কেবল ন্যায়ের জন্য এবং আমার মানুষের কষ্টের কথা জানাতে চেষ্টা করেছিলাম। আমরা মরতে নয়, বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম’
জাবের তার কাজের কল্যাণে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকাতে হলো।
ইসমাইল আল গুল
আল জাজিরার সাংবাদিক ইসমাইল আল গুল এবং তার ক্যামেরাম্যান রামি আল-রিফি ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই শাতি শরণার্থী শিবিরে নিজেদের গাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন।
আক্রমণকালে ইসমাইল এবং রামি উভয়েই মিডিয়া ভেস্ট পরিহিত ছিলেন এবং তাদের গাড়িতেও পরিচিতি চিহ্ন ছিল। আল জাজিরার অপর রিপোর্টার আনাস শরিফ বলেন,
‘অন্তিম সম্প্রচারে ইসমাইল বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের যন্ত্রণা, আহতদের কষ্ট এবং গাজায় নিরপরাধ মানুষের ওপর ইসরায়েলি দখলদারের গণহত্যার কথা তুলে ধরছিলেন।’
ইসমাইলের জীবন এবং তার সাংবাদিকতা, গাজার মানুষের কষ্টের কণ্ঠস্বর হয়ে থাকবে, যা কখনো ভোলা যাবে না।
হাসোনা সালেম
2023 সালের 19 নভেম্বর সর্বশেষ ভিডিও সম্প্রচারে হাসোনা সালেম বলেন,
‘আমি গাজার একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক। আমি এই ভিডিওটি সম্প্রচার করছি এবং জানি না, আমি আরও ভিডিও পোস্ট করতে পারব কিনা। গাজার একজন সাংবাদিক হিসেবে, আমরা যে কোনো সময় লক্ষ্যবস্তু হতে পারি। আমাদের তিনজন সহকর্মী আমাদের সঙ্গে ইভেন্ট কভার করতে বের হয়ে নিহত হয়েছেন।
আমরা সত্য পরিবেশন করার যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছি। বর্তমানে আমাদের কোনো সামাজিক মাধ্যম বা ঐক্যবদ্ধ কোনো প্ল্যাটফর্ম নেই। আমরা অনেক কষ্টের মধ্যে আছি। আপনারা যারা দেখছেন, আমাদের কণ্ঠস্বর পৃথিবীজুড়ে পৌঁছে দিন।“
গাজার সাংবাদিকরা যেভাবে তাদের জীবনকে বিপন্ন করে মানবতার ডাকে সত্য প্রকাশে এগিয়ে এসেছিলেন তা অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমার যে খবরগুলো দেখে বা শুনে অশ্রু ঝড়িয়েছি সেই খবর সংগ্রহ করতে গাজার সাংবাদিকদে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। যুদ্ধবিরতির এই আনন্দপূর্ণ সময়ে কামনা করি, প্রাণপন লড়াই করা সাংবাদিক ভাই-বোনদের আবার ভেস্ট পরতে না হোক। চিরতরে বন্ধ হোক ধ্বংসযজ্ঞ। ।
আল জাজিরার একটি আর্টিকেল অবলম্বনে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করেছেন ওলিউর রহমান