ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের দীর্ঘদিনের সংঘাতের মধ্যে বন্দী বিনিময় সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দুই পক্ষের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির ঘোষণা নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গত বুধবার গাজা উপত্যকায় বন্দী বিনিময় ও যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণা করা হয়, যা আগামীকাল রোববার থেকে কার্যকর হবে। এই চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আগে হওয়া ঐতিহাসিক বন্দী বিনিময় চুক্তিগুলোর দিকে আবারও নজর পড়েছে।
ফিলিস্তিনি মুক্তি আন্দোলনের (পিএলও) বন্দী বিষয়ক দপ্তর ও বেসরকারি ফিলিস্তিনি বন্দী ক্লাবের তথ্যমতে, ১৯৪৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে ৪০টি বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়েছে। সবশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে চুক্তির আওতায় মুক্তি পেয়েছেন ২৪০ জন ফিলিস্তিনি বন্দী, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ৭১ জন নারী এবং ১৬৯ জন শিশু-কিশোর। এই চুক্তিগুলো একদিকে যেমন দীর্ঘদিনের উত্তেজনা নিরসনে ভূমিকা রেখেছে, তেমনি শান্তির পথে নতুন আশার সঞ্চার করেছে।
আলোচিত বন্দী বিনিময় চুক্তিগুলো
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৮ সালের ২৩ জুলাই প্রথমবারের মতো ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়। এতে ইসরায়েল একটি বিমানের ১০০ যাত্রীকে মুক্তি দেওয়ার শর্তে ৩৭ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয়। বিমানটি ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’অপহরণ করেছিল।
এরপর ১৯৭১ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাতাহ আন্দোলনের সঙ্গে চুক্তি করে ইসরায়েলি সেনা শামুয়েল ফায়েজের মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দী মাহমুদ বকর হাজাজিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৭৯ সালের ১৪ মার্চ ‘নওরস’ নামে একটি চুক্তি হয়। এতে ১৯৭৮ সালের লিটানি অপারেশনের সময় আটক হওয়া ইসরায়েলি সেনা আব্রাহাম ওমরামকে মুক্তি দেওয়া হয়। এর বিনিময়ে ৭৬ জন ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি পায়, যাদের মধ্যে ১২ জন নারী ছিলেন।
১৯৮৩ সালের ২৩ নভেম্বর ফাতাহর সাথে আরেকটি চুক্তি হয় ইসরায়েলের। এতে ইসরায়েল ৪৭০০ বন্দী এবং ৬৫ জন নেতাকে মুক্তি দেয়। এর বিনিময়ে ফাতাহ ১৯৮২ সালে আটক হওয়া ৬ ইসরায়েলি সেনাকে মুক্তি দেয়।
১৯৮৫ সালের ২০ মে ইসরায়েল ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’ গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি করে ১১৫৫ জন ফিলিস্তিনি এবং লেবানিজ বন্দীকে মুক্তি দেয়। বিনিময়ে তিনজন ইসরায়েলি সেনাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৯৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে, তেল আবিব হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ আহমদ ইয়াসিন এবং তার সঙ্গীদের মুক্তি দেয়। এর বিনিময়ে, জর্ডানের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটক মোসাদের দুই এজেন্টকে মুক্তি দেওয়া হয়, যারা সেই সময় হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান খালেদ মিশালের উপর ব্যর্থ হত্যার প্রচেষ্টার পর গ্রেপ্তার হয়েছিল।
২০০৯ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল ২০ জন নারী বন্দীকে মুক্তি দেয়। এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর হাতে বন্দী ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের একটি ভিডিও পায়।
২০১১ সালের ১১ অক্টোবর আরেকটি বড় চুক্তি হয়, যা হামাস ‘ওফা-আল-আহরার’ নামে অভিহিত করে। এতে ইসরায়েল ১০২৭ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেয় তাদের মাঝে ইয়াহইয়া সিনওয়ারও ছিলেন। বিপরীতে হামাস গিলাদ শালিতকে মুক্তি দেয়।
সবশেষ ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে গাজায় চলমান সংঘর্ষের মধ্যে একটি মানবিক চুক্তি হয়। এতে ৫০ জন ইসরায়েলি বন্দীর বিনিময়ে ২৪০ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে ১৬৯ জন শিশু-কিশোর এবং ৭১ জন নারী।
গত বুধবার কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, কাতার, মিশর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় গাজায় বন্দী বিনিময় এবং যুদ্ধবিরতির এই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
তিনি জানান, চুক্তির প্রথম ধাপ ৪২ দিন স্থায়ী হবে। এই সময়ের মধ্যে ৩৩ জন ইসরায়েলি বন্দীর বিনিময়ে আরও কয়েকজন ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হবে।
সূত্র : আনাদোলু, আল জাজিরা