মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

গাজা যুদ্ধ শেষের পথে: বন্দি বিনিময় ও সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতি

2023-10-29t123718z_1222308768_mt1eyeim260111_rtrmadp_3_israel-ground-operation-in-gaza-1170x600-1

গাজা যুদ্ধের অবসানসংক্রান্ত চুক্তি কার্যকর হয়েছে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর ২০২৫) দুপুরে। বুধবার গভীর রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত গাজা পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সমঝোতায় পৌঁছায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাস। এই ধাপে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এটি দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের অবসানের নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

মিশরের মধ্যস্থতায় আয়োজিত পরোক্ষ আলোচনার মাধ্যমে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনার প্রথম ধাপে এই সমঝোতা হয়।

ট্রাম্প আগেই জানিয়েছিলেন, চুক্তি এখন ‘খুব কাছাকাছি’। তিনি আগামী সপ্তাহের শুরুতে মিশর সফর করতে পারেন বলেও জানান। ইঙ্গিত দিয়েছেন, হয়তো শনিবারই রওনা দেবেন।

মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস-এর খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প ইসরায়েলও যেতে পারেন এবং সেখানকার পার্লামেন্ট ‘কনেসেট’-এ ভাষণ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

মিশরের শারম আশ শাইখে শুরু হওয়া এই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও তুরস্কের উচ্চপর্যায়ের দূতেরা অংশ নেন, যা আলোচনাকে নতুন গতি দেয়।

ট্রাম্পের পক্ষে আলোচনায় ছিলেন তাঁর জামাতা জ্যারেড কুশনার ও বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। ইসরায়েলের প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির কৌশলবিষয়ক মন্ত্রী রন ডারমার, যিনি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত।

কী ঘটেছে শেষ মুহূর্তে?

বুধবার রাতে, ‘তুফানুল আকসা’ অভিযানের দ্বিতীয় বার্ষিকীর এক দিন পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ লিখেছেন, ‘ইসরায়েল ও হামাস আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে—এটি ঘোষণা করতে পেরে আমি সম্মানিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর ফলে খুব শিগগিরই সব বন্দি মুক্তি পাবে। ইসরায়েলও একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত সেনা সরিয়ে নেবে। এটি শক্তিশালী ও টেকসই শান্তির পথে প্রথম ধাপ।’

ট্রাম্প তাঁর পোস্টে লেখেন, ‘সব পক্ষের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করা হবে। এটি আরব ও ইসলামি বিশ্ব, ইসরায়েল, প্রতিবেশী দেশগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। আমরা কাতার, মিশর ও তুরস্কের মধ্যস্থতাকারীদের ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা এই নজিরবিহীন চুক্তি সফল করতে পাশে ছিলেন।’

হামাসও যুদ্ধ শেষের চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, ‘চুক্তি অনুযায়ী গাজা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে, দখলদার বাহিনী গাজা থেকে সরে যাবে, ত্রাণ ঢুকবে এবং বন্দি বিনিময় হবে।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, চুক্তির গ্যারান্টিদাতা দেশগুলো এবং আরব–ইসলামি ও আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই—তারা যেন দখলদার সরকারকে চুক্তির শর্ত পূর্ণভাবে বাস্তবায়নে বাধ্য করে, এবং যেন কোনোভাবেই পিছু হটা বা বিলম্বের সুযোগ না দেওয়া হয়।’

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, ‘আল্লাহর কৃপায় আমরা সবাইকে ঘরে ফিরিয়ে আনব,’—হামাসের হাতে থাকা বন্দিদের প্রসঙ্গ টেনে। তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার তাঁর সরকার বিশেষ বৈঠকে বসবে।

এখন কী হবে?

ইসরায়েলি ও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, আগামী কয়েক ঘণ্টায় চুক্তি স্বাক্ষরসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ঘটনাগুলো হবে এভাবে—

দুপুর ১২টা: শারম আশ শাইখে চুক্তি স্বাক্ষর এবং যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে।

বিকেল ৩টা: ইসরায়েলের নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা (ক্যাবিনেট) বৈঠক বসবে চুক্তিতে সই করার জন্য।

বিকেল ৪টা: ইসরায়েল সরকারের পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে চুক্তি অনুমোদন দেওয়া হবে।

চুক্তির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি নিয়ে যা জানা গেছে

চুক্তির পূর্ণাঙ্গ ও আনুষ্ঠানিক বিস্তারিত এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে জানা গেছে, জীবিত ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে শনিবার বা সোমবারের মধ্যে। নিহত বন্দিদের দেহাবশেষ জীবিতদের মুক্তির পর ধীরে ধীরে হস্তান্তর করা হবে।

হামাসের এক সূত্র রয়টার্স-কে জানিয়েছে, ইসরায়েল সরকার চুক্তিতে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত বন্দিদের হস্তান্তর করা হবে।

সংগঠনটির কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, যেসব নিহত বন্দির মরদেহ এখনো গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা রয়েছে—যাদের সংখ্যা আনুমানিক ২৮ জন—সেগুলো উদ্ধার ও হস্তান্তরে আরও সময় লাগবে।

ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি নিয়ে যা জানা গেছে

চুক্তি স্বাক্ষরের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলের কারাগার থেকে দুই হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে।

বর্তমান শর্ত অনুযায়ী, মুক্তি পাবেন প্রায় ১ হাজার ৭০০ জন গাজার বাসিন্দা—যাদের ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদের পাশাপাশি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আরও প্রায় ২৫০ জন ফিলিস্তিনিকেও মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে।

হামাস জানিয়েছে, তারা মুক্তির জন্য যেসব ফিলিস্তিনি বন্দির নাম চেয়েছে, তার তালিকা ইসরায়েলি পক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, তালিকায় ইসরায়েলের কারাগারে থাকা বেশ কয়েকজন শীর্ষ বন্দির নামও রয়েছে—যাদের মুক্তি নিয়ে আগের যুদ্ধবিরতি আলোচনাগুলোতে কোনো সমঝোতা হয়নি।

রয়টার্স-এর কাছে ঘনিষ্ঠ এক ফিলিস্তিনি সূত্র জানিয়েছে, তালিকায় আছেন ফাতাহ নেতা মারওয়ান বারগুতি ও ফিলিস্তিনের জনপ্রিয় মুক্তি ফ্রন্টের (পিএফএলপি) নেতা আহমেদ সা’দাত। দুজনই ইসরায়েলিদের হত্যার অভিযোগে একাধিক যাবজ্জীবন সাজা ভোগ করছেন।

ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

ইসরায়েলি টেলিভিশন চ্যানেল 12-এর খবরে বলা হয়েছে, সবশেষ বন্দী মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত গাজার প্রায় ৫৩ শতাংশ এলাকার নিয়ন্ত্রণে থাকবে ইসরায়েল। সেনারা সরে যাবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রকাশিত মানচিত্রের তথাকথিত ‘হলুদ রেখা’ পর্যন্ত।

ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম জানিয়েছে, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত যুদ্ধ-সমাপ্তি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) তিনটি সামরিক ইউনিট গাজা শহর থেকে সরে যেতে শুরু করেছে।

ট্রাম্পের পরিকল্পনায় এরপর কী আছে?

পরবর্তী ধাপে ট্রাম্পের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এতে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও থাকবেন। যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা পরিচালনায় এই কমিটি ভূমিকা রাখবে।

পরিকল্পনাটির পক্ষে থাকা আরব দেশগুলো বলছে, শেষ পর্যন্ত এটি একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ খুলে দেবে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তা স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এমন কিছু কখনোই ঘটবে না।’

যুদ্ধ শেষ হলে গাজার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ কার হাতে যাবে, সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
হামাস জানিয়েছে, তারা গাজার শাসন থেকে সরে যেতে রাজি, তবে শর্ত হলো—এটি পরিচালনা করবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে একটি টেকনোক্র্যাট সরকার, যেটি আরব ও ইসলামি দেশগুলোর সমর্থন পাবে।

হামাস স্পষ্ট জানিয়েছে, টনি ব্লেয়ার বা অন্য কোনো বাইরের পক্ষকে গাজা শাসনে কোনো ভূমিকা দিতে তারা রাজি নয়।

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন