মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

২৫ আগস্ট: গণহত্যার ক্ষত বুকে নিয়ে রোহিঙ্গাদের টিকে থাকার লড়াই

ফাইল ফটো
ফাইল ফটো

প্রতি বছর ২৫ আগস্ট বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গারা স্মরণ করেন সেই দিনটিকে, যেটি তাদের ইতিহাসকে চিরতরে পাল্টে দিয়েছিল। দিনটি পরিচিত রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে। ২০১৭ সালের এই দিনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী শুরু করেছিল কথিত ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’। সেই অভিযানে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় অগণিত গ্রাম, চলে গণহত্যা, লাখো মানুষকে বাধ্য করা হয় আরাকান ছেড়ে যেতে। রয়ে যায় এমন ক্ষত, যা কোনো দিন সহজে ভরাট হবে না।

সশস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ার কথা বলে শুরু হলেও অল্প সময়ের মধ্যে তা পরিণত হয় রাষ্ট্র-সমর্থিত গণহত্যার অভিযানে। জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের স্বাধীন তদন্তে উঠে এসেছে—গণহত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ আর গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার মতো নৃশংসতার তথ্য।

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রও আনুষ্ঠানিকভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। রোহিঙ্গাদের কাছে ২৫ আগস্ট কেবল একটি তারিখ নয়, এটি এক গভীর ক্ষত। সেই দিন তাদের টিকে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল ঘরবাড়ি, পরিচয় আর জন্মভূমি ফেলে অনিশ্চিত নির্বাসনের পথে যাত্রা।

রোহিঙ্গারা আরাকানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি জাতিগোষ্ঠী। শত শত বছর ধরে তারা সেখানে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য নিয়ে বসবাস করে এসেছে।

কিন্তু ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার নতুন নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে রোহিঙ্গাদের বাদ দেয়। এর ফলে তারা নিজেদের জন্মভূমিতেই রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ে। নাগরিকত্ব হারিয়ে তাদের থেকে কেড়ে নেওয়া হয় চলাফেরার স্বাধীনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও জীবিকার অধিকার।

সরকারি পরিকল্পনায় গড়ে ওঠা নাতালা (NaTaLa) বসতিগুলোতে অন্যান্য সম্প্রদায়কে এনে বসানো হয়েছিল। ফলে রোহিঙ্গারা আরও প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেই বৈষম্যই পরবর্তী সহিংসতার পথ তৈরি করে দেয়।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট আরাকানের উত্তরাঞ্চলে সমন্বিতভাবে কথিত ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে সামরিক জান্তা। এটা কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই ছিল না, ছিল রোহিঙ্গা বেসামরিক জনগণের ওপর পরিকল্পিত আক্রমণ। বেঁচে ফেরা মানুষদের বর্ণনায় উঠে এসেছে—গণহত্যা, যৌন সহিংসতা আর অগ্নিসংযোগে পুরো গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ঘটনা। পরিবারের সকলকে হত্যা করা হয়েছে, নারীরা হয়েছেন ধর্ষণের শিকার, শিশু পর্যন্ত রক্ষা পায়নি।

পরে স্যাটেলাইট ছবিতে ধরা পড়ে মংডু, বুথিডং ও রাথেডং অঞ্চলের শত শত গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দৃশ্য। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন মেদসঁ সঁ ফ্রঁতিয়েরের (MSF) হিসাব অনুযায়ী, ওই অভিযানের প্রথম মাসেই অন্তত ৬ হাজার ৭০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৭৩০ জন ছিল পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নথিতে দেখা যায়, অন্তত ৩৫৪টি রোহিঙ্গা গ্রামকে জ্বালিয়ে ছাই করে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের জানান, মিয়ানমার সেনারা অনেক সময় স্থানীয় গ্রামপ্রহরী ও নালালা বসতির বৌদ্ধদের নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। তুলা টোলির মতো গণহত্যার ঘটনায় এই যোগসাজশ পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ ও শোচনীয় করে তোলে।

যৌন সহিংসতা ছিল পরিকল্পিত ও সংগঠিত। শত শত নয়, হাজারো রোহিঙ্গা নারী ও কিশোরীকে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হয়েছিল। আতঙ্ক ছড়িয়ে গোটা জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার অস্ত্র বানানো হয়েছিল নারীর দেহ।

২০১৭ সালের শেষ নাগাদ ৭ লাখ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগে আসা শরণার্থীদের সঙ্গে মিলে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে এখন বাস করছে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ। অতিরিক্ত ভিড় ও দুর্যোগপ্রবণ পরিবেশে গড়ে ওঠা এই শিবিরগুলো আজও দাঁড়িয়ে আছে গণহত্যার জীবন্ত সাক্ষ্য আর বিশ্বের অপূর্ণ দায়বদ্ধতার প্রতীক হয়ে।

বাংলাদেশে পৌঁছানোর পথটা অনেক রোহিঙ্গার জন্য ছিল সহিংসতার মতোই প্রাণঘাতী। মরিয়া হয়ে পরিবারগুলোকে পাড়ি দিতে হয়েছে পাহাড়, জঙ্গল আর নদী। নিরাপত্তার ভরসা জাগানো নাফ নদীই কেড়ে নিয়েছে অসংখ্য নারী ও শিশুর প্রাণ।

যারা বেঁচে পৌঁছেছেন, তারা এসেছেন ক্লান্ত, শোকে বিধ্বস্ত ও সর্বস্বান্ত হয়ে। বছরের পর বছর কেটে গেলেও তাদের জীবন রয়ে গেছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। কমছে আন্তর্জাতিক সহায়তা, কমছে খাদ্যের বরাদ্দ, সীমিত হয়ে আসছে শিক্ষা, জীবিকা আর নিরাপত্তার সুযোগ।

তবু রোহিঙ্গাদের কাছে ২৫ আগস্টকে স্মরণ করা কোনো পছন্দ নয়—এটা তাদের প্রতিরোধের প্রতীক। তাদের কাছে এ দিন মানে স্মৃতির মুখোমুখি দাঁড়ানো, শোককে শক্তিতে রূপ দেওয়া, আর বিশ্বকে মনে করিয়ে দেওয়া—তাদের গল্প এখনো শেষ হয়নি।

ন্যায়বিচার এখনো জুটেনি। আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা চলছে বটে, কিন্তু ভুক্তভোগীরা এখনো অপেক্ষায়—কবে অপরাধীরা জবাবদিহির মুখোমুখি হবে। বিচার না পাওয়ায় ২০১৭ সালের ক্ষত আজও উন্মুক্তই রয়ে গেছে।

মৃতের সংখ্যার চেয়ে বেঁচে থাকা মানুষের কণ্ঠই বেশি হৃদয়বিদারক।

৩৭ বছরের জামালিদা জানান, ‘মিয়ানমারের সেনারা স্থানীয় নাতালা পুরুষদের নিয়ে আমাকে গণধর্ষণ করে। আমার সামনে আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করে। আমি একাই বেঁচে আছি। আমার যন্ত্রণার ভাষা নেই। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করছি—আমাদের ন্যায়বিচার দিন।’

২৪ বছর বয়সী ফটোগ্রাফার ও এক্টিভিস্ট আরজে সায়েদ নূর মনে করিয়ে দেন ২৫ আগস্টের সেই ভয়াল দিনকে। তিনি বলেন,

‘নয় বছর আগে আমরা মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়েছিলাম। তখন থেকেই আমরা গৃহহীন, আশাহীন। বিশ্বকে অবশ্যই মিয়ানমারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের কাছে এই দিন চিরকাল রোহিঙ্গা ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে।’

২৩ বছর বয়সী মুজাম্মেল হক ছিলেন মিয়ানমারের এক তরুণ শিক্ষার্থী। এখন তিনি আশ্রয় নিয়েছেন কক্সবাজার শরণার্থীশিবিরে। তিনি বলেন,

‘গণহত্যা আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে। আমি এখন ত্রিপলের ঘরে থাকি। শিক্ষা নেই, নিরাপত্তা নেই। খাবারের রেশনও কমে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন আমাদের ভুলে না যায়।’

রোহিঙ্গাদের কাছে গণহত্যার স্মরণ কেবল শোকের নয়, বরং ভবিষ্যৎ নির্মাণের অঙ্গীকার। নিজেদের ইতিহাস তারা মুছে যেতে দেয়নি, দেবে না। বাস্তুচ্যুতির যন্ত্রণা বুকে নিয়েই তারা টিকে আছে। আর ন্যায়বিচার না পাওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারও জানিয়ে যাচ্ছে। তাদের বিশ্বাস স্পষ্ট—প্রকৃত নিরাময় তখনই সম্ভব, যখন অপরাধীদের জবাবদিহির মুখোমুখি করা হবে এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে।

গণহত্যা স্মরণ দিবসে রোহিঙ্গাদের কণ্ঠে তাই একটাই আহ্বান শোনা যায়—স্মরণ মানেই পদক্ষেপ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই আহ্বান এড়িয়ে যেতে পারে না। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে, বেঁচে থাকা মানুষদের নিরাপত্তা দিতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য রাষ্ট্রহীনতা ও হতাশাকে উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাওয়া মানবতারই পরাজয় হবে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট—রোহিঙ্গাদের জীবনে এক বিভীষিকাময় দিন। সেদিন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য গ্রাম, নিশ্চিহ্ন হয়েছিল বহু পরিবার। জীবন বাঁচাতে লাখো মানুষ বাধ্য হয়েছিল নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে। নয় বছর পরও প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা এখনো নির্বাসিত—রাষ্ট্রহীন, অস্থির ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বোঝা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

তবে এই দিনটিকে স্মরণ করা শুধু শোক প্রকাশ নয়, ন্যায়বিচারেরও দাবি। ভুলে যাওয়ার অর্থ হবে শহীদদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা।

রোহিঙ্গাদের ইতিহাস এক গভীর ট্র্যাজেডির ইতিহাস, তবে এর ভেতরেই আছে অবিশ্বাস্য টিকে থাকার গল্প। ২৫ আগস্টকে স্মরণ করা তাই নীরবতা মেনে নেওয়া নয়, বরং অস্বীকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এই স্মরণ এক সতর্কবার্তাও বটে—বিশ্ব যদি ভুলে যায়, তবে আবারও গণহত্যার দরজা খুলে যেতে পারে।

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন