মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

গাজায় পণ্যের সংকট, দাম বেড়েছে কয়েকগুণ

এক কেজি টমেটোর দাম দাঁড়িয়েছে ১২০ শেকেল, আর কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ শেকেল কেজি দরে। একইভাবে বেড়েছে অন্যান্য সবজির দামও।
গাজায় পণ্যের সংকট, দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ছবি : ফিলিস্তিন পোস্ট
গাজায় পণ্যের সংকট, দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ছবি : ফিলিস্তিন পোস্ট

গাজা উপত্যকায় চলমান দুর্ভিক্ষ ইতিমধ্যে পঞ্চম মাসে গড়িয়েছে। এখনো খাদ্য সংকটের তীব্রতা কাটেনি, বরং দিন দিন তা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। উপত্যকার বাসিন্দাদের অনেকটা সময়ই কেটে যাচ্ছে খাদ্যের খোঁজে এদিক–ওদিক ছোটাছুটিতে। কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারকে একমুঠো খাবার জোগাতে চেষ্টা করছেন।

অবরোধের মধ্যে পণ্য পরিবহন বন্ধ, মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে নানা বিধিনিষেধ, পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে নির্দিষ্ট রুটে চলতে বাধ্য করাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে গাজার বাজারগুলো এখন প্রায় শূন্য। যেটুকু খাবার বা নিত্যপণ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তাও আবার খুব সীমিত কিছু পণ্যে সীমাবদ্ধ।

আকাশ ছোঁয়া পণ্যের দাম

গত দুই সপ্তাহে লাফিয়ে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। বিশেষ করে সবজি ও জরুরি খাদ্যপণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এক কেজি টমেটোর দাম দাঁড়িয়েছে ১২০ শেকেল, আর কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ শেকেল কেজি দরে। একইভাবে বেড়েছে অন্যান্য সবজির দামও। এক কেজি আটার দাম এখনো ৪০ শেকেলের বেশি, আর চিনি কেজিপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ শেকেলের বেশি দামে।

এই পরিস্থিতিতে চরম খাদ্যসংকটে পড়েছেন উপত্যকার বাসিন্দারা। বাজারে জিনিস আছে হাতে গোনা, দামও বেশি। ফলে অনেকেই খাবার জোগাড় করতে পারছেন না, যা দুর্ভিক্ষকে আরও তীব্র করেছে। বেড়েছে অপুষ্টিজনিত রোগ।

গাজার বাসিন্দা আহমাদ মাসউদ বললেন, ‘আমি তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে আছি। এই দামে কিছু কেনা সম্ভব না। পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে আছি।’ তিনি জানান, দেশের বাইরে থাকা এক আত্মীয় তাঁর খবর পেয়ে ৫০০ ডলার পাঠিয়েছিলেন। তবে দালালদের মাধ্যমে টাকা তোলার সময় তিনি পেয়েছেন মাত্র অর্ধেক। বাকি টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে কমিশন ও নানা খরচের নামে।

এই টাকাতেই তিনি কিছু আটা আর জ্বালানি কাঠ কিনেছেন। তাঁর স্ত্রী প্রতিদিন এক কেজি আটা দিয়ে ১২টি রুটি বানান। সেগুলো পরিবারের আট সদস্যের মধ্যে ভাগ করে খেতে হয়—প্রতি জনে দিনে দেড়টা রুটি। ওইটুকু দিয়েই তিন বেলা কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা।

তিনি জানান, রুটির সঙ্গে কিছু খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও বাজারে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। ডাল, ম্যাকারনি আর দুক্কাহ (একধরনের মসলাযুক্ত শুকনা মিশ্রণ)—হাতেগোনা এই কয়েকটি পণ্যই এখন দোকানে মিলছে। যেটুকু আছে, তার দামও আকাশছোঁয়া। ফলে পরিবার নিয়ে তাঁরা এখন কেবল রুটি আর পানি খেয়ে দিন পার করছেন। তাঁর ভাষায়, ‘এটাও আমাদের জন্য অনেক কিছু, কারণ কিছুদিন আগেও পুরোপুরি না খেয়ে থাকতে হয়েছে। তখন আশপাশের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে যতটুকু পাওয়া যেত, সেটুকু নিয়েই চলতাম।’

গাজার আরেক বাসিন্দা সামি ওমর বললেন, হাতে টাকা থাকলেও বাজার থেকে কিছু কিনতে পারছেন না। কারণ তাঁর কাছে নগদ অর্থ নেই, আর অধিকাংশ দোকানদার মোবাইল ব্যাংকিং বা ই-ওয়ালেটের মাধ্যমে লেনদেন নিতে রাজি নন। বাজারে ডিজিটাল লেনদেন চালুর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। ডিজিটাল লেনদেন বাধ্যতামূলক করলে কিছুটা হলেও সংকট কমবে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, বাজারে পণ্যের জোগান ও চাহিদাই মূল নিয়ন্ত্রক। চাহিদা বাড়লেও যদি জোগান না বাড়ে, তাহলে দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায়।

দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে গাজায় চালু হয়েছে নতুন এক বিক্রির ধারা—সবজি বিক্রি হচ্ছে একটি করে, আর অনেক পণ্য বিক্রি হচ্ছে গ্রাম বা খণ্ড আকারে। আগে যেসব পণ্য কেজি বা প্যাকেট হিসেবে বিক্রি হতো, সেগুলোরই এখন দাম এত বেশি যে মানুষ বাধ্য হয়ে এক চিমটে, এক গ্রাম করে কিনছেন। দুর্ভিক্ষ আর উচ্চমূল্যের এই বাস্তবতায় এটিই হয়ে উঠেছে গাজার প্রতিদিনের চিত্র।

অল্প পরিমাণে বিক্রি হওয়া পণ্যের মধ্যে অন্যতম চিনি। চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি ১০০ গ্রাম ৩৫ শেকেলে। আগে যা কেজিতে বিক্রি হতো, এখন তা মিলছে গ্রাম ধরে।

তিলবীজ থেকে তৈরি মিষ্টান্ন ‘হালাওয়া তাহিনী’ এখন বিক্রি হচ্ছে টুকরো করে—একটা পূর্ণ প্যাকেট কেটে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে তা বিক্রি করছেন দোকানিরা। বাজারে দেখা যাচ্ছে ভেজাল কফিও, যা আসলে ভাজা ছোলা থেকে তৈরি গুঁড়া। সেই কফিও বিক্রি হচ্ছে এক চামচ করে, যার দাম কমপক্ষে ৬ শেকেল।

গাজার বাসিন্দা মাহমুদ মানসুর জানান, অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য চায়ে দেওয়ার মতো সামান্য চিনি কিনতে গিয়েছিলেন। ৭০ শেকেল দিয়ে তিনি ২০০ গ্রাম চিনি কিনেছেন, যা দিয়ে বড় একটি কেটলিতে মাত্র একবার চা বানানো যাবে। তিনি বলেন, ‘আগে চিনির তিন কেজির প্যাক কিনতাম ১০ শেকেলেরও কম দামে। আর এখন কিনতে হচ্ছে গ্রাম ধরে—এটা খুবই কষ্টের।’

বিক্রেতা খালেদ আরাফাত বলেন, ‘গাজার বাজার এখন একেবারে ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ আর পণ্যের ঘাটতি আমাদের বাধ্য করেছে এই অল্প পরিমাণে বিক্রি করতে। এখন অনেক কিছুই বিক্রি হচ্ছে টুকরো করে। দোকানিরা পণ্য কিনছেন অল্প করে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও কিছু জটিলতা—যেমন খুচরা টাকার সংকট, নগদ অর্থের ঘাটতি এবং বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত পণ্য না থাকায় দোকানিদের অস্বস্তি। যা পুরো বাজার ব্যবস্থাকেই দুর্বিষহ করে তুলেছে।’

পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির মুখে গাজার অনেক বাসিন্দা এখন আশ্রয় নিচ্ছেন পণ্য বিনিময় প্রথার। যার কাছে যেসব পণ্য মজুত আছে, সেগুলোর বদলে প্রয়োজনীয় অন্য পণ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

বাসিন্দারা বলছেন, দুর্ভিক্ষ আর ইসরায়েলি অবরোধের চাপ সামলাতে সমাজ নিজেই বিকল্প পথ খুঁজছে। বিনিময় প্রথা এখন সেই বিকল্প সমাধানের একটি রূপ, যা মানুষ নিজেদের মতো করে চালু করেছে।

তবে গাজার ভেতরে চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহনের অভাব, জ্বালানির সংকট ও রাস্তাঘাটের দুরবস্থার কারণে এই বিনিময় প্রক্রিয়া অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে উঠছে না। এতে করে বহু চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে, মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য জোগাড় করতেও হিমশিম খাচ্ছে।

পণ্যের দাম কমছে না কেন?

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ আবু ক্বমার বলেন, গাজায় পণ্যের দাম বাড়তে থাকার প্রধান কারণ হলো, যতো পরিমাণ পণ্য প্রতিদিন প্রবেশ করছে তা মোট চাহিদার মাত্র ১০ শতাংশ। দীর্ঘ ১৫০ দিন সীমান্ত বন্ধ থাকার পর মাত্র ছয় দিন আগে নিয়মিত ট্রাক প্রবেশ শুরু করেছে।

তিনি জানান, বড় সমস্যা হলো কয়েকটি পরিবার বা দল নিয়মিত সাহায্য পাচ্ছে। তারা এসব পণ্য জমিয়ে রেখে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে। কিছু ব্যবসায়ী বড় পরিমাণ পণ্য কিনে মজুদ রাখছেন, যাতে ভবিষ্যতে অবরোধ শুরু হলে দাম আরও বাড়িয়ে বিক্রি করতে পারেন। এতে তারা ব্যাপক মুনাফা উপার্জন করছেন, যদিও তা মানুষের ক্ষুধা, মৃত্যু ও দুঃখের বিনিময়ে।

আবু ক্বমার বলেন, গাজার বৈধ বাজার ব্যবস্থা ইসরায়েলি বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে, যার কারণে বাজারে বিশৃঙ্খলা ও কালোবাজারি ছড়িয়ে পড়েছে। পণ্য গোপনে রেখে ইচ্ছাকৃতভাবে সরবরাহ কমিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। ফলে মানুষের চাহিদা বাড়লেও পণ্য সরবরাহ সীমিত থাকায় দাম ক্রমশ বাড়ছে।

আবু ক্বমার বলেন, গত মার্চ মাস থেকে ইসরায়েলি অবরোধের কারণে গাজায় বাণিজ্যিক পণ্য প্রবেশ বন্ধ থাকার ফলে সংকট তীব্র হয়েছে।

তিনি আরও জানান, যুদ্ধ চলমান থাকার আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি করে পণ্য কিনে মজুত করছেন। এর ফলে বাজারে সব সময় চাহিদা বেশি থাকছে।

তবে আবু ক্বমার আশা প্রকাশ করে করে বলেন, যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হলে বাজার দ্রুত স্থিতিশীল হয়ে উঠবে, এমনকি ট্রাকের সংখ্যা না বাড়ালেও দাম কমে আসবে।

গাজার সাধারণ মানুষের দাবি, বাজারে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। তারা অভিযোগ করছেন, কিছু ব্যবসায়ী ও বিক্রেতা চুরি হওয়া ত্রাণসামগ্রী কিনে তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করছেন, যা বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে।

তাদের মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দুটি বিষয় সবচেয়ে জরুরি—প্রথমত, ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো যেন নিরাপদে গাজায় প্রবেশ করতে পারে; দ্বিতীয়ত, সেই ত্রাণ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর গুদামে সঠিকভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে লুটপাট ও চুরি রোধ করা যাবে এবং সাধারণ মানুষ ন্যায্য মূল্যে পণ্য পাবে।

Follow Us