গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ ও পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে যখন বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে, ঠিক তখনই দিল্লিতে বসেছে ভারত-ইসরায়েল সামরিক বৈঠক। বৈঠকে দুই দেশের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তারা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি করার অঙ্গীকার করেছেন।
দিল্লিতে বৈঠকে অংশ নেন ভারতের প্রতিরক্ষা সচিব রাজেশ কুমার সিংহ এবং ইসরায়েলের উপপ্রধান সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল আমির বারাম। এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে এমন বার্তা স্পষ্ট হলো যে, পশ্চিমা অনেক দেশ যখন গাজায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ইসরায়েল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তখনও ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে বদ্ধপরিকর।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি শহিদ হয়েছেন। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই অভিযানকে ‘গণহত্যা’ বলেও অভিহিত করেছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে অপুষ্টি ও খাদ্যসংকটে মারা গেছেন আরও ১১৫ জন, যাঁদের মধ্যে ৮০ জনই শিশু। কেবল গত সোমবারেই অপুষ্টিতে মারা যান ১৫ জন।
এমন পরিস্থিতিতে যখন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ২০টির বেশি দেশ গাজায় বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা এবং ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেওয়ার প্রতিবাদ জানিয়েছে, তখনই দিল্লিতে উচ্চপর্যায়ের সামরিক বৈঠকটি হয়।
ভারতের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর (PIB) এক বিবৃতিতে বলা হয়, ৭ অক্টোবরের হামলাকে ভারত সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে বিবেচনা করে এবং সব জিম্মির মুক্তির পক্ষে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে ইসরায়েলের পাশে ভারতের অবস্থানও সেখানে পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তার ভারত সফর দুই দেশের প্রতিরক্ষা অংশীদারত্বের জন্য একটি ‘গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত’, যা কৌশলগত সহযোগিতা আরও মজবুত করবে।
কূটনৈতিক সম্পর্কেও জোর
সামরিক সহযোগিতার পাশাপাশি কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ভারত-ইসরায়েলের যোগাযোগ বাড়ছে। বুধবার দিল্লির মেয়র রাজা ইকবাল সিংহ রাজধানীতে ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রেউভেন আজারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, এই কঠিন সময়ে ভারত ইসরায়েলের পাশে রয়েছে।
তিনি বলেন, ভারত-ইসরায়েল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে আস্থা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে। এ সময় তাঁরা দিল্লির স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পার্ক ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ইসরায়েলি প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা করেন।
তবে মেয়রের এই বক্তব্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। দিল্লিভিত্তিক অধিকারকর্মীরা একে ‘নিষ্ঠুর ও অমানবিক’ বলে অভিহিত করেছেন।
এক খোলা চিঠিতে তাঁরা লিখেছেন, মেয়র যখন বলেন, তিনি ‘ইসরায়েলের পাশে আছেন’, তখন সেটা ফিলিস্তিনিদের রক্তের স্রোতের সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা মাথায় বলা এক নিষ্ঠুর রসিকতা।
তাঁদের ভাষ্য, এই মুহূর্তে ‘কঠিন সময়’ পার করছে ফিলিস্তিনিরাই। হাসপাতাল, স্কুল, ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে, খাদ্য ও চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে ইসরায়েল এক ভয়াবহ গণহত্যা চালাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবিক নীতিমালার সম্পূর্ণ লঙ্ঘন।
বিনিয়োগ নিরাপত্তা চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত একটি বিষয় হলো ভারত-ইসরায়েল ইনভেস্টমেন্ট প্রোটেকশন অ্যাগ্রিমেন্ট (IPA)। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ইসরায়েল জানায়, তারা ভারতের সঙ্গে এই চুক্তি চূড়ান্ত করতে যাচ্ছে।
এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ আরও নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈশ্বিক অস্থিরতা, যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের সময় এই উদ্যোগকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফিলিস্তিনি গবেষক ও লেখক আব্দুল্লাহ মুয়াসওয়াস বলেন, ভারত সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করতে চায়। কারণ, দেশটির একটি বড় ভোটব্যাংকে ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে।
বর্তমানে ভারত ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র আমদানিকারক। পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে যৌথভাবে ইসরায়েলি অস্ত্র উৎপাদনেও সক্রিয় অংশীদার। সম্প্রতি ভারতের পক্ষ থেকে ইসরায়েলে যুদ্ধ ড্রোন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর অস্ত্র সরবরাহের তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর দেশটির নাগরিক সমাজ সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয় এবং অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার দাবি তোলে।
তবে গত ডিসেম্বরে ভারত সরকার জানায়, ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ‘জাতীয় স্বার্থ’ বিবেচনায় নিয়েই পরিচালিত হবে।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই