মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের একটি পুলিশ ফাঁড়িতে চার মাসের বেশি সময় আটকে রাখার পর ১৭টি রোহিঙ্গা পরিবারকে মুক্তি দিয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। তবে প্রতিজনের জন্য পরিবারগুলোকে গুনতে হয়েছে ২ কোটি কিয়াত (মিয়ানমারের মুদ্রা, ১ ডলার সমান প্রায় ২৩০০ কিয়াত)। মুক্তির পর তাদের জোর করে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, আটক থাকা অবস্থায় মোট ৭৮ জন রোহিঙ্গা—তাদের মধ্যে ৩৬ জন পুরুষ, ৪২ জন নারী ও শিশু—চরম মানবিক সংকটে ছিলেন। দিনে মাত্র এক বেলা খাবার পেতেন, চিকিৎসাসেবাও ছিল না। এ অবস্থায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
‘আরাকান নিউজ এজেন্সি’কে এক মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি জানান, ‘মুক্তি পেলেও আমাদের নিজেদের গ্রামে ফিরে যেতে দেওয়া হয়নি। বরং হুমকি দেওয়া হয়েছে, যদি আবার মংডু-তে দেখা যায়, তাহলে ৬ থেকে ৮ বছরের জেল হবে। মুক্ত থাকতে চাইলে আবার দিতে হবে বড় অঙ্কের টাকা—প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৫ কোটি কিয়াত, আর শিশুদের জন্য ২ কোটি ৩০ লাখ কিয়াত।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, মুক্তিপ্রাপ্তদের ‘হলাইং কুন গ্রুপ’ নামের এক পাচার চক্রের কাছে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই চক্রটি সরাসরি সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির সঙ্গে যুক্ত। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠাতে প্রতিজনের কাছ থেকে আরও ৭ লাখ কিয়াত করে নেওয়া হয়েছে।
নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য ‘লাদিয়ার’ দ্বীপের কাছাকাছি এলাকায় নৌকাগুলোকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের প্রতি এমন আচরণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এখন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে তাদের মুক্তি পর্যন্ত অর্থের বিনিময়ে কিনে নিতে হচ্ছে। এরপর আবার ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সীমান্তের ওপারে—বাংলাদেশের দিকে।
রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক দমন-পীড়ন সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির প্রকৃত চেহারা প্রকাশ করেছে। বিশ্লেষকদের মতে, আরাকান আর্মি এখন কার্যত এক সন্ত্রাসী দখলদার বাহিনীতে রূপ নিয়েছে। যার শাসনব্যবস্থা অনেকটাই মিয়ানমারের পুরোনো সামরিক জান্তার মতো—বৈষম্যমূলক ও দমননীতিনির্ভর। বরং তার চেয়েও আরও ভয়ংকর।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মংডু শহরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় আরাকান আর্মি। শহর দখলের পর হাজারো মানুষ ভয়, সহিংসতা ও দমনপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ পরে ফিরে এলেও, রোহিঙ্গাদের জন্য থেকে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের অনেকে আটক হন, আবার অনেককেই জোর করে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।
৮ ডিসেম্বর শহর নিয়ন্ত্রণের পর থেকেই সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের বাড়ি ভিত্তিহীন অভিযোগে তালাবদ্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, অনেকের বাড়িঘর দখল করে নেওয়া হয়েছে। মূল্যবান সম্পদ জব্দ করা হয়েছে, পরিবারগুলো গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। প্রতিটি রোহিঙ্গা গ্রামের প্রবেশ ও বাহিরপথে বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। গ্রাম থেকে গ্রামে যাতায়াতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি সেতু পার হতে গেলেও রোহিঙ্গা পথচারী ও মোটরসাইকেলচালকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভাষ্য, মংডু এখন রোহিঙ্গাদের জন্য এক উন্মুক্ত বন্দিশিবিরে পরিণত হয়েছে। অথচ, শুরুতে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি দাবি করেছিল, তারা রাখাইনের অধিকার বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য লড়ছে। বাস্তবে, রোহিঙ্গাদের ওপর তাদের আচরণ এখন আগের সেনাশাসনের চেয়েও নিপীড়নমূলক হয়ে উঠেছে।
২০২৩ সালের নভেম্বরে আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে রাখাইন রাজ্যের ১৪টি শহর দখল করে। এই সংঘর্ষে রোহিঙ্গারা উভয় পক্ষের সহিংসতা ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যতির শিকার হয়। এর আগেও ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালিয়ে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য করে।
সূত্র: এএনএ