মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে যে সকল দেশ 

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার পর বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইসরায়েলকে আর কোনো সামরিক সহায়তা না দেয়ার দাবি উঠেছে। কারণ এই সহায়তাই হচ্ছে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রধান উৎস। 
গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে যে সকল দেশ 
গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে যে সকল দেশ । ছবি : Ai

বিশ্বের অন্যতম বড় অস্ত্র উৎপাদক দেশ হওয়া সত্ত্বেও গাজা উপত্যকায় চলমান গণহত্যা চালিয়ে যেতে ইসরায়েল মূলত নির্ভর করছে পশ্চিমা বিশ্বের ওপরই। এ যুদ্ধে ৫০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি শহিদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য। মাটির সাথে মিশে গেছে অসংখ্য বসতবাড়ি, পুরো একটি জনপদ। 

ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্য—এই দেশগুলো রয়েছে সবার শীর্ষে। তারা ইসরায়েলকে সরবরাহ করছে যুদ্ধবিমান, স্মার্ট বোমা, ও নিখুঁত লক্ষ্যভেদী মিসাইল। এসব আধুনিক অস্ত্র ছাড়া ইসরায়েলি বাহিনীর পক্ষে গাজায় এমন বিধ্বংসী হামলা চালানো সম্ভব হতো না। কারণ, এখনো ইসরায়েলের নিজস্ব প্রতিরক্ষা শিল্প এতসব উন্নত প্রযুক্তির সমমানের কিছু তৈরি করতে পারেনি।

কিছুদিন আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি মন্তব্য করে চমকে দেন দেশটির প্রতিরক্ষা মহলকে। তিনি বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিবছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা পাই। তবে আমি বিশ্বাস করি, একসময় এমন দিন আসবে, যখন আমরা এই সামরিক সহায়তা ছাড়াই চলতে পারবো—যেমনটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমরা করেছি।

তার এই বক্তব্যে বিস্মিত হন নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা খাতের শীর্ষ কর্মকর্তারা। কারণ বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের পেছনে মূল চালিকা শক্তিই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোর অস্ত্র ও গোলাবারুদ।

এদিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের চলমান গণহত্যার পর বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিবাদ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইসরায়েলকে আর কোনো সামরিক সহায়তা না দেয়ার দাবি উঠেছে। কারণ এই সহায়তাই হচ্ছে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রধান উৎস। 

আমরা এই প্রতিবেদনে ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করার বিস্তারিত পরিসংখ্যান দেখব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

ইসরায়েলেকে সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ওয়াশিংটন যে পরিমাণ সামরিক সহায়তা দিয়েছে, তা অন্য কোনো দেশ ইসরায়েলকে দেয়নি।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্যমতে, ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সবচে বেশি ব্যবহৃত ইসরায়েলের প্রধান অস্ত্রগুলোর ৬৯ শতাংশই সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছরই তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সহায়তা দিয়েছে ইসরায়েলকে, যা দশ বছর মেয়াদি এক চুক্তির আওতায় প্রদান করা হচ্ছে। এই সহায়তার উদ্দেশ্য হলো—ইসরায়েল যেন তার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় প্রযুক্তিগত ও সামরিকভাবে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারে।

এই সহায়তার মধ্যে প্রতি বছর ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য। এর আওতায় রয়েছে যৌথভাবে উন্নত আয়রন ডোম, অ্যারো এবং ডেভিড’স স্লিং-এর মতো ডিফেন্স সিস্টেম।

এছাড়া ১৯৯০-এর দশক থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে নিজস্ব অস্ত্রের মজুত রাখছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের ঘটনার পর সেখান থেকে কিছু গোলাবারুদ সরাসরি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য আনা হয়।

গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র তেলআবিবকে ব্যাপক সামরিক সহায়তা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে শতাধিক অস্ত্র বিক্রয় চুক্তি, কয়েক হাজার নির্ভুল নিশানার গোলাবারুদ, ছোট ব্যাসের বোমা, বাংকার ভেদকারী বোমা, ছোট অস্ত্রসহ নানা ধরণের প্রাণঘাতী সরঞ্জাম।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গাজা গণহত্যায় ব্যাপকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে ইসরায়েল।

ইসরায়েল বিশ্বের প্রথম দেশ যারা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক যুদ্ধবিমান এফ-৩৫ ব্যবহার করেছে। ২০২৩ সালে দেশটি ৭৫টি এফ-৩৫ কেনার অর্ডার দেয়, যার মধ্যে ৩৬টি ইতোমধ্যে হাতে পেয়েছে।

গাজা যুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব প্রধান অস্ত্র কোম্পানি ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে— লকহিড মার্টিন, আরটিআইএক্স, নর্থরপ গ্রুম্যান, বোয়িং, জেনারেল ডায়নামিক্স, হানিওয়েল ইন্টারন্যাশনাল এবং জেনারেল ইলেকট্রিক।

জার্মানি 

ইসরায়েলেকে দ্বিতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ হলো জার্মানি। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটি ইসরায়েলকে মোট অস্ত্র আমদানির ৩০ শতাংশ সরবরাহ করেছে। এ তথ্য দিয়েছে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ  ইনস্টিটিউট।

জার্মানি সাধারণত ইসরায়েলকে যেসব সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করে, তার মধ্যে রয়েছে ডুবোজাহাজ, যুদ্ধজাহাজ, স্থল ও নৌযানের ইঞ্জিন, বিমানযানের যন্ত্রাংশ। এছাড়াও রয়েছে ডুবোজাহাজের জন্য টর্পেডো।

২০২২ সালে ইসরায়েল জার্মানির সঙ্গে ৩.৩ বিলিয়ন ডলারের একটি বড় চুক্তি করে, যার আওতায় তারা তিনটি উন্নত ডাকার মডেলের ডিজেলচালিত ডুবোজাহাজ কিনেছে। এই ডুবোজাহাজগুলো ২০৩১ সালের মধ্যে ইসরায়েলের হাতে পৌঁছাবে এবং বর্তমানে ব্যবহৃত জার্মান-নির্মিত ডলফিন ডুবোজাহাজের জায়গা নেবে।

২০২৩ সালে, জার্মানি ইসরায়েলের কাছে যেসব অস্ত্র বিক্রি করেছে, তার মোট মূল্য ছিল ৩৬১ মিলিয়ন ডলার—যা আগের বছরের তুলনায় ১০ গুণ বেশি। উল্লেখ্য, এই অস্ত্র রপ্তানির বেশিরভাগ অনুমতি ৭ অক্টোবরের পরেই দেয়া হয়।

জার্মান বার্তা সংস্থা জানায়, এসব সরঞ্জামের মধ্যে ছিল ৩,০০০টি কাঁধে বহনযোগ্য ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র এবং ৫ লাখ রাউন্ড গুলি, যা স্বয়ংক্রিয় বা আধা-স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য ব্যবহৃত হয়। অধিকাংশ রপ্তানি অনুমতি দেয়া হয়েছিল স্থলযান, অস্ত্র সংযোজন, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের প্রযুক্তির জন্য।

গাজায় চলমান যুদ্ধের সময় ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহকারী শীর্ষ জার্মান কোম্পানির মধ্যে অন্যতম ছিল রাইনমেটাল ও থিসেনক্রুপ।

এদিকে, ২০২৪ সালে নিকারাগুয়া জার্মানির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে অভিযোগ দায়ের করে, যাতে তারা ইসরায়েলকে সামরিক সহায়তা বন্ধের নির্দেশ দেয়ার অনুরোধ জানায়। তবে আদালত সেই অনুরোধ খারিজ করে দেয়।

ইতালি

ইসরায়েলকে তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ হলো ইতালি। তবে স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটি ইসরায়েলের মোট অস্ত্র আমদানির ০.৯ শতাংশ জোগান দিয়েছে।

এই সময়ে ইতালি থেকে ইসরায়েল যেসব অস্ত্র আমদানি করেছে তার মধ্যে ছিল হেলিকপ্টার ও নৌবাহিনীর জন্য কামান। এছাড়া, ইতালি F-35 যুদ্ধবিমান নির্মাণ প্রকল্পের অংশীদার, এবং বিমানটির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ তৈরিতেও দেশটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক অস্ত্র বাণিজ্যবিরোধী সংস্থা CAAT-এর তথ্য মতে, ২০২২ সালে ইতালি থেকে ইসরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম ও লাইসেন্স রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮.৮ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২৩ সালে ‘অস্ত্র ও গোলাবারুদ’ বিক্রি হয়েছে প্রায় ১৫.৭ মিলিয়ন ডলারের, যা ইতালির জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর ISTAT-এর বরাতে প্রকাশ করেছে Altreconomia ম্যাগাজিন।

যুদ্ধরত বা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্রে অস্ত্র রপ্তানি নিষিদ্ধ—এমন একটি আইনের কথা উল্লেখ করে ইতালির সরকার দাবি করেছি,  তারা ইসরায়েলে রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। তবুও, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর ২০২৩-এর মধ্যে ২.৩৫ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

২০২৪ সালের মার্চ মাসে ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুয়িদো ক্রোসেট্টো পার্লামেন্টে জানান, বিদ্যমান সব চুক্তি পর্যালোচনা করে দেখার পরই রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে, কোনো অস্ত্রই যেন বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী না হয়।

গাজায় চলমান যুদ্ধের সময়, ইতালির অন্যতম বড় অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লিওনার্দো ইসরায়েলকে সরবরাহ করেছে বেশ কিছু অস্ত্র। কোম্পানিটি তৈরি করে Oto Melara 76/62 Super Rapid 76mm কামান, যা ইসরায়েলি নৌবাহিনীর ‘সাআর’ যুদ্ধজাহাজে ব্যবহৃত হয়। ২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর এই কামান ব্যবহার করে গাজায় প্রথমবারের মতো হামলা চালানো হয়।

এরপর, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩-এ, লিওনার্দোর মার্কিন সহযোগী প্রতিষ্ঠান DRS Sustainment Systems ইসরায়েলের জন্য ভারী ট্যাংক পরিবহন ট্রেইলার তৈরির একটি ১৫.৪ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি অর্জন করে।

যুক্তরাজ্য

২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ সরকার জানায়, ইসরায়েলে তাদের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে অল্প—২০২২ সালে যা ছিল ৫৫ মিলিয়ন ডলার।

ব্রিটেনের ব্যবসা ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এই অঙ্কটি ২০২৩ সালে কমে দাঁড়ায় মাত্র ২৪.২ মিলিয়ন ডলারে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৩১ মে পর্যন্ত সময়কালে, ব্রিটেন ইসরায়েলে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির জন্য ৪২টি লাইসেন্স ইস্যু করে। বর্তমানে মোট ৩৪৫টি লাইসেন্স সক্রিয় রয়েছে। এসব লাইসেন্সের আওতায় সামরিক বিমান, সাঁজোয়া যান ও যুদ্ধজাহাজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ রপ্তানি করা হয়।

অস্ত্র বাণিজ্যের বিরোধী একটি সংগঠন জানায়, ২০০৮ সাল থেকে যুক্তরাজ্য ইসরায়েলকে মোট ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দিয়েছে। বেশিরভাগ লাইসেন্স ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশের জন্য, যেগুলো পরবর্তীতে ইসরায়েলের হাতে পৌঁছেছে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি ঘোষণা দেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে ব্যবহৃত কিছু উপকরণ রপ্তানির প্রায় ৩০টি লাইসেন্স তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

কিন্তু ২০২৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, লাইসেন্স স্থগিতের পরেও ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো ইসরায়েলে বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জাম—এমনকি গোলাবারুদও—রপ্তানি করেছে। 

এই প্রতিবেদন থেকে প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাজ্য কি তাদের পূর্বঘোষিত নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে সরাসরি ইসরায়েলে F-35 যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ পাঠিয়েছে? যদিও সরকার বলেছিল, এসব যন্ত্রাংশ শুধুমাত্র মার্কিন কোম্পানি লকহিড মার্টিনের মাধ্যমেই যাবে, যাতে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা এবং ন্যাটোর নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়।

গাজা যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহকারী শীর্ষ ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল BAE Systems এবং Rolls-Royce। রোলস-রয়েসের মালিকানাধীন জার্মান প্রতিষ্ঠান MTU তৈরি করেছে ইসরায়েলের মারকাভা ৪ ও ৫ (বারাক) ট্যাংকের ইঞ্জিন।

এই মারকাভা ট্যাংকগুলোই ইসরায়েল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে গাজার বিভিন্ন অভিযানে। বিশেষ করে ২০২৩ সালের নভেম্বরে শিফা হাসপাতাল এবং ইন্দোনেশীয় হাসপাতালের ওপর চালানো হামলায়। 

ফ্রান্স

ইসরায়েলের কাছে ফরাসি অস্ত্র রপ্তানি সব সময়ই গভীর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে হয়। ফরাসি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে অস্ত্র রপ্তানি নিয়ে অস্বচ্ছতা বা গোপনীয়তা বজায় রাখে, যাতে ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের সামরিক বাণিজ্যের তথ্যাদি প্রকাশ্যে না আসে। 

যদিও এই সম্পর্ক নিয়ে সরকারিভাবে খুব কম তথ্য পাওয়া যায়, তবে গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে।

২০২৩ সালে ফ্রান্স ইসরায়েলকে প্রায় ৩৩ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সরবরাহ করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

ফ্রান্সের আংশিক রাষ্ট্রায়ত্ত সামরিক প্রযুক্তি কোম্পানি তালেস, তাদের লাভাল কারখানায় তৈরি করে ড্রোন ‘হারমিস ৯০০’-এর জন্য অত্যাধুনিক ট্রান্সমিটার ও রিসিভার। ২০২৪ সালে এসব যন্ত্রপাতির অন্তত দুটি ইসরায়েলের কাছে পাঠানো হয়।

তালেসের সঙ্গে ইসরায়েলের সামরিক প্রযুক্তি নির্মাতা এলবিট সিস্টেমস-এর ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব রয়েছে। এই দুই কোম্পানি মিলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য ‘Watchkeeper’ ড্রোন তৈরির প্রকল্পেও কাজ করেছে।

২০২৪ সালের মার্চে, ফরাসি অনুসন্ধানী সংবাদমাধ্যম Disclose ও Marsactu একটি চাঞ্চল্যকর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে, যা ফ্রান্সজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। রিপোর্টে বলা হয়, মার্সেই-ভিত্তিক কোম্পানি ইউরোলিংক্স ইসরায়েলের কাছে এম ২৭ নামের ধাতব সংযোগযন্ত্র সরবরাহ করেছে, যা মেশিনগানের গুলির বেল্টে কার্তুজ জোড়ার কাজে ব্যবহৃত হয়।

এদের দাবি, এসব অস্ত্র ও যন্ত্রাংশ সম্ভবত গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে।

বেলজিয়াম

বেলজিয়াম বিশ্বের ২২তম বৃহৎ অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। ২০২৪ সালের মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতিত্বের সময়, দেশটি ইসরায়েলের প্রতি অস্ত্র রপ্তানিতে ইউনিয়নজুড়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানায়।

কিন্তু এই অবস্থান সত্ত্বেও গাজায় চলমান গণহত্যার সময় ইসরায়েলে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি অব্যাহত ছিল। এমনকি কিছু ইসরায়েলি সামরিক কোম্পানি তাদের প্রধান কার্যালয় হিসেবে বেলজিয়ামকেই বেছে নিয়েছে।

২০২১ সালে বেলজিয়াম ইসরায়েলের উদ্দেশে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ ডলারের অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দেয়।

২০২৩ সালের নভেম্বরে বেলজিয়ামের বিখ্যাত কোম্পানি বিপি ক্লেয়ারমন্ট ইসরায়েলে ১৬ টন বারুদ পাঠায়, যা অ্যান্টওয়ার্প বন্দর হয়ে পৌঁছায়। এরপর ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলজিয়াম সরকার এসব রপ্তানির লাইসেন্স সাময়িকভাবে স্থগিত করে।

২০২৩ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৪ মার্চ পর্যন্ত, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, বেলজিয়ামের লিয়েজ বিমানবন্দর হয়ে ১০টি সামরিক কার্গো ফ্লাইট ইসরায়েলের নেভাটিম বিমানঘাঁটিতে গিয়েছে।

এই ফ্লাইটগুলো পরিচালনা করে ইসরায়েলি মালবাহী বিমানসংস্থা চ্যালেঞ্জ এয়ারলাইন্স।

সবশেষে, ২০২৪ সালের মে মাসে বেলজিয়াম সরকার কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসরায়েলে অস্ত্র পরিবহন এবং পুনঃরপ্তানিসহ সকল ধরনের অস্ত্র ট্রানজিট তাদের ভূখণ্ডে সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

ভারত

ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অস্ত্র বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে ভারত অন্যতম। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে, ইসরায়েলের সামরিক রপ্তানির ৩৭ শতাংশই গিয়েছে ভারতে। 

শুধু তাই নয়, ভারতের সামরিক শিল্প ইসরায়েলের ইলবিট সিস্টেমস, রাফায়েল ও ইসরায়েলি এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের মতো বড় প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ও উপকরণ সরবরাহ করে—এর মধ্যে বিস্ফোরকসহ নানা ধরনের সামগ্রী রয়েছে।

২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে একাধিক প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করছে, সেটি একটি ভারতীয় প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই অস্ত্র-ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘আর্বেল’।

২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সময়ে ভারত থেকে ইসরায়েলে সামরিক পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ২৫৮.১১ মিলিয়ন ডলার।

এই রপ্তানির তালিকায় ছিল এয়ার রাইফেলের গুলি, বন্দুকের কার্তুজের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, গোলাবারুদ ও ক্ষেপণাস্ত্রসহ আরও অনেক সামরিক সরঞ্জাম।

স্পেন

২০২৩ সালের নভেম্বর মাসে স্পেন ইসরায়েলে এক মিলিয়ন ডলারের গোলাবারুদ পাঠায়। এ তথ্য দিয়েছে ডেলাস সেন্টারের করা একটি গবেষণা।

অস্ত্র বাণিজ্যবিরোধী একটি প্রচারণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে স্পেন থেকে ইসরায়েলে মোট ১১১ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল গোলাবারুদ, সাঁজোয়া যান ও ট্যাংক, এবং বিস্ফোরক সরঞ্জাম।

২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে, রয়টার্সকে এক সরকারি সূত্র জানায়, স্পেন সরকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য একটি ইসরায়েলি কোম্পানি থেকে গোলাবারুদ কেনার চুক্তি বাতিল করেছে। ক্ষমতাসীন জোটের ছোট অংশীদার ‘সোমার’-এর চাপেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এরপর ২০ মে ২০২৫, স্পেনের পার্লামেন্টে ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার একটি প্রস্তাব আলোচনার জন্য অনুমোদিত হয়।

স্পেন দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের নীতির কড়া সমালোচক। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে গাজায় যুদ্ধ শুরু হলে স্পেন ঘোষণা দেয়, তারা আর ইসরায়েলকে অস্ত্র বিক্রি করবে না। পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্তের আওতা বাড়িয়ে অস্ত্র কেনাকাটাও বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয় তারা।

কানাডা

কানাডা সরকার আগেই জানিয়েছিল, তারা ইসরায়েলের কাছে সব ধরনের অস্ত্র রপ্তানি বন্ধ করে দেবে। কারণ, ইসরায়েল কানাডার রপ্তানি নীতিমালা পুরোপুরি মেনে চলছে—এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়।

তবে পরে জানা যায়, এই নিষেধাজ্ঞা শুধুমাত্র নতুন রপ্তানি অনুমতিগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যেগুলো তখনও অনুমোদন পায়নি।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর সরকার ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের কাছে নতুন করে ২৮.৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে।

এর মধ্যে, ৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর প্রথম দুই মাসেই ১৮.৪ মিলিয়ন ডলারের যন্ত্রপাতি ‘ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। বাকি ৯.২ মিলিয়ন ডলারের অনুমতিতে ছিল বিমান, ড্রোন ও অন্যান্য বিমান-সংশ্লিষ্ট যন্ত্র ও উপকরণ।

সার্বিয়া

সার্বিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত বৃহত্তম অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউগোইমপোর্ট–এসডিপিআর ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ইসরায়েলে প্রায় ১.৫ কোটি ডলারের অস্ত্র রপ্তানি করেছে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। 

বলকান ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং নেটওয়ার্ক (BIRN)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশে দুই দফায় বড় অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান পাঠানো হয়েছে, তবে এসব চুক্তি চরম গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে।

এর আগেও, ২০২৩ সালের মার্চ ও এপ্রিল মাসে সার্বিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের উজিতসেতে অবস্থিত সরকারি গোলাবারুদ কারখানা ‘প্রভি পার্টিজান’ থেকে ৮.৮৩ লাখ ডলারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ ইসরায়েলে রপ্তানি করা হয়েছিল।

২০২৪ সালের মার্চে তথ্য জানার অধিকার আইনে আবেদন করেছিল BIRN। তবে সার্বিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে জানায়, সংশ্লিষ্ট তথ্য ‘চরম গোপনীয়’ এবং প্রকাশযোগ্য নয়।

সুইডেন

২০১৪ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সুইডেন ইসরায়েলের কাছে যে পরিমাণ অস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স দিয়েছে, তার মোট মূল্য প্রায় ১৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার। এই রপ্তানির বড় অংশই ছিল অস্ত্র নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

সুইডেনের অস্ত্র পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘সফেনস্কা ফ্রিডস’ বলছে, ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলে সুইডেনের অস্ত্র রপ্তানির পরিমাণ ছিল কম। তবে ২০২২ সালে এতে চোখে পড়ার মতো বৃদ্ধি ঘটে। সে বছর রপ্তানির মূল্য ৪ লাখ ৫০ হাজার ডলারের বেশি ছিল।

২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে সুইডেনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম অধিদপ্তর ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি এলবিট সিস্টেমসের সঙ্গে ১০ বছরের একটি চুক্তি করে, যার মোট মূল্য প্রায় ১৭ কোটি ডলার।

ডেনমার্ক

অস্ত্র বাণিজ্যবিরোধী একটি প্রচারাভিযানের নথিপত্রে দেখা গেছে, ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ডেনমার্ক থেকে ইসরায়েলের উদ্দেশে রপ্তানি করা অস্ত্রের লাইসেন্সের মোট মূল্য এক মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।

ডেনমার্কভিত্তিক অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠান ড্যানওয়াচ জানিয়েছে, ডেনমার্কে তৈরি কিছু যন্ত্রাংশ ইসরায়েলি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরির কাজে এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওই যুদ্ধবিমানগুলোই গাজায় বোমা হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

২০২৪ সালের মার্চে, অক্সফাম, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ফিলিস্তিনের মানবাধিকার সংস্থা আল-হাক-এর ডেনিশ শাখাসহ কয়েকটি এনজিও ডেনমার্ক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র রপ্তানির মাধ্যমে ডেনমার্ক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনে সহায়তা করছে।

সর্বশেষ