ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি কারাগারগুলো ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের নতুন প্রজন্মের নেতাদের গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই প্রজন্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নেতা হলেন ইয়াহইয়া সিনওয়ারা। যিনি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী।
ওয়াশিংটনে নিযুক্ত দ্য টাইমস-এর প্রতিবেদক জর্জ গ্রিলস লিখেছেন, সিনওয়ার ২০ বছরেরও বেশি সময় বন্দি থাকার পর ২০১১ সালে ইসরায়েলি সেনা গিলাত শালিতের বিনিময়ে মুক্তি পান। দীর্ঘ কারাবাসের সেই সময়টা তাঁকে বদলে দেয়, তিনি ইসরায়েলের ‘হাদারিম’ কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন এমন একজন নেতা হিসেবে, যিনি শত্রুকে গভীরভাবে বুঝতে শিখেছিলেন।
তবে সিনওয়ার মনে করতেন, সেই বন্দি বিনিময় চুক্তি অসম্পূর্ণ ছিল, কারণ এতে হাসান সালামা ও মাহমুদ ঈসার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বর্তমানে সালামা এখনও ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি, আর ঈসা দীর্ঘ কয়েক দশক বন্দিজীবন কাটিয়ে সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছেন।
কারাগারে থাকাকালীন সিনওয়ার হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন, ইহুদি ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন, এমনকি ইসরায়েলি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের লেখা বই আরবিতে অনুবাদ করেছেন। দ্য টাইমস-এর প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি সেই সময় গাজার সুড়ঙ্গ থেকে পরিচালিত জিহাদকে কেন্দ্র করে একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন। ( আশ শাওকু ওয়াল কারানফাল)
প্রতিবেদক জর্জ গ্রিলস জানান, ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মতে সিনওয়ার ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন কারাগারেই। সেই একই কারাগারে, যেটিকে বন্দিরা মজা করে ‘হাদারিম বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে ডাকত।
গ্রিলস আরও বলেন, ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরায়েল বন্দি বিনিময়ে এক ধরনের অসম নীতি অনুসরণ করে আসছে। এই নীতি ভিত্তি পেয়েছে একটি বাইবেলীয় বিশ্বাস থেকে, যেখানে মানবজীবন রক্ষা করা সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তব্য বলে বিবেচিত। এর ফলে ফিলিস্তিনি সংগঠনগুলোর কাছে ইসরায়েলিদের অপহরণ এক শক্তিশালী চাপের অস্ত্র হয়ে ওঠে।
কিন্তু ২০১১ সালের শালিত বিনিময় চুক্তি—যার আওতায় এক হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পেয়েছিলেন—ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের ভাষায় ‘একটি নিরাপত্তাজনিত বিপর্যয়’ হিসেবে দেখা দেয়। কারণ, এই চুক্তি হামাসের সামরিক নেতৃত্বকে পুনর্গঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল।
দ্য টাইমস আরও জানায়, একই ধরনের অভিজ্ঞতা হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমদ ইয়াসিন ও ইসমাইল হানিয়াহর ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই তাঁরা সংগঠনের নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে আসেন।

বর্তমানে ইসরায়েল আশঙ্কা করছে, সেই একই ভুল আবার না ঘটে। তাই মারওয়ান বারঘুতি ও আব্বাস সাইদের মতো প্রভাবশালী বন্দিদের মুক্তি না দিয়ে এখনও কারাগারে রেখেছে। পাশাপাশি, বন্দিদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করা হয়েছে, এবং কারাগারের ভেতরে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সব সুযোগ-সুবিধা বাতিল করা হয়েছে।
এই কঠোর নীতিগুলোর মানবিক মূল্য ছিল ভয়াবহ। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা—যার মধ্যে ‘বেতসেলেম’ ও রয়েছে—তাদের প্রতিবেদনে ৭ অক্টোবরের হামলার পর ইসরায়েলি কারাগারগুলোতে বন্দিদের ওপর নির্যাতন ও যৌন সহিংসতার একাধিক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন। তবে ইসরায়েল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তারা ‘আন্তর্জাতিক আইনের সীমার মধ্যে থেকেই’ কাজ করছে, তার বাইরে নয়। যদিও এই দাবি বাস্তবতা বহির্ভূত।
দ্য টাইমস জানায়, ইসরায়েলি কারাগার কর্তৃপক্ষের গোয়েন্দা শাখার সাবেক প্রধান ড. ইয়োয়াভ পেইটনের মতে, বর্তমান যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে শত শত বন্দিকে মুক্তি দেওয়া ‘একটি উচ্চমূল্যের হলেও অবশ্যম্ভাবী সিদ্ধান্ত’। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যেসব বন্দিকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে, তা গুরুতর ভুল, কারণ বিদেশে গেলে তাদের কার্যক্রমের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি রাখা সম্ভব হয় না।
যে কারাগারগুলোকে ইসরায়েল একসময় ভয় ও শাস্তির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেগুলোই সময়ের পরিক্রমায় শিক্ষা, যোগাযোগ ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে হামাসের সবচেয়ে প্রভাবশালী ও দৃঢ় নেতাদের গড়ে তোলার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এক প্রজন্ম কারাগারের ভেতরেই গড়ে উঠেছে, যারা শত্রুর ভাষা শিখেছে, তাকে গভীরভাবে বুঝেছে, এবং পরে সেই জ্ঞান দিয়েই তার মোকাবিলা করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীনে ইসরায়েল ১,৭০০ ফিলিস্তিনি আটক ব্যক্তি ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ২৫০ বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে। এদের মধ্যে ১৫৭ জন ফাতাহ আন্দোলনের সদস্য এবং ৬৫ জন হামাসের সদস্য। মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৫৪ জনকে মিসর, কাতার ও তুরস্কের মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো হয়েছে।
সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সতর্ক করেছেন যে, এই মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা বিদেশে গিয়ে আবারও সংগঠিত হতে পারেন, যেমনটি ঘটেছিল সালেহ আল আরুরির ক্ষেত্রে। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি হামাসের পশ্চিম তীর শাখার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী হিসেবে আবির্ভূত হন।
দ্য টাইমস প্রতিবেদনের শেষে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৈপরীত্যের দিকে ইঙ্গিত করেছে, যে কারাগারগুলোকে ইসরায়েল ভয় দেখানো ও দমননীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল, সেগুলোই পরিণত হয়েছে হামাসের সবচেয়ে দৃঢ়, সচেতন ও প্রভাবশালী নেতাদের গড়ে ওঠার প্রশিক্ষণকেন্দ্রে। এক প্রজন্ম, যারা কারাগারের দেয়ালের পেছন থেকে উঠে এসে শত্রুর ভাষা আয়ত্ত করেছে, তাকে বুঝেছে, এবং সেই জ্ঞান দিয়েই তার মুখোমুখি হয়েছে।
সূত্র: দ্য টাইমসের বরাতে আল জাজিরা











