মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

চার মাস পর ভিডিও বার্তায় আবু উবায়দা, যা বললেন

গাজায় চলমান এই প্রতিরোধ যুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বিদ্যালয়। যার থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।
চার মাস পর ভিডিও বার্তায় আবু উবায়দা, যা বললেন
হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়দা। ছবি : আল জাজিরা

দীর্ঘ কয়েক মাস পর আবারও হামাসের সামরিক শাখা ইজ্জুদিন আল-কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবায়াদা একটি ভিডিও বার্তায় হাজির হয়ে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছেন। একইসাথে ভিডিও বার্তায় তিনি মুসলিম ও আরব বিশ্বের শাসক ও নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা করেন এবং জানান, গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা  এখন দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ

আবু উবায়াদা বলেন, ‘চার মাস আগে ইসরায়েল যুদ্ধ বিরতি লঙ্ঘন করে পুনরায় হামলা শুরু করে। কিন্তু এই চার মাসে আমাদের প্রতিরোধশক্তি শত শত ইসরায়েলি সেনাকে হতাহত করেছে এবং হাজারো ইসরায়েলি সেনাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে।

তিনি আরও জানান, দীর্ঘতম প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাসসাম যোদ্ধারা এখন নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করছে এবং সেই কৌশলের ভিত্তিতে গত কয়েক সপ্তাহে একাধিকবার ইসরায়েলি সেনা বন্দি করার চেষ্টা করেছে।

প্রতিরোধের কৌশল: আক্রমণ, ধ্বংস, গ্রেপ্তার

আবু উবায়দা বলেন, বর্তমানে কাসসাম ব্রিগেড যে কৌশলে চলছে, তা তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে—শত্রুপক্ষকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে ফেলা, বিশেষ অভিযান পরিচালনা এবং বেশি বেশি ইসরায়েলি সেনা বন্দি করার চেষ্টা করা।

তিনি বলেন,গাজায় চলমান এই প্রতিরোধ যুদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বিদ্যালয়। যার থেকে শেখার অনেক কিছু আছে।

আবু উবায়দা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন ‘ইসরায়েল যদি গণহত্যা চালিয়ে যায়, তাহলে তাদের সময় সেনা ও কমান্ডারদের জানাজা পড়তে পড়তেই চলে যাবে।’

মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা

মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা করে বলেন ‘ইসরায়েল ভয়ংকর সব আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থন পাচ্ছে, অথচ আমাদের মুসলিম জাতির নেতারা রয়েছে কেবল নিরব দর্শকের ভূমিকায়। তারা শুধু দেখছে—তাদের ভাইদের হত্যা করা হচ্ছে, অনাহারে রাখা হচ্ছে, চিকিৎসাবঞ্চিত করা হচ্ছে।”

তিনি সরাসরি সাধারণ মুসলিম, আরব বিশ্বের শাসক, বুদ্ধিজীবী, ধর্মীয় নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেন, ‘তাদের কাঁধে পড়ে আছে হাজার হাজার নিরপরাধ শহিদের রক্তের দায়। কারণ তারা নীরব থেকে এই বৈশ্বিক প্রতারণায় সহায়তা করেছে। এর দায় কেউ এড়াতে পারবে না। যারা কোনোভাবে প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে, তারা প্রত্যেকে এর জন্য দায়ী।

ইয়েমেনি হুথি যোদ্ধাদের প্রশংসা

কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি আবু উবায়দা ধন্যবাদ দিয়েছেন ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ’কে। তিনি বলেন, তারা (হুথিরা) ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি সক্রিয় ফ্রন্ট খুলে আমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। তারা বসে থাকেনি, বরং কিছু করে দেখিয়েছে।

আবু উবায়দা আরও বলেন, আমরা বিশ্বের সব স্বাধীনতাকামীদের কৃতজ্ঞতা জানাই, যারা নানা উপায়ে গাজাবাসীদের ওপর আরোপ করা অবরোধ ভাঙার চেষ্টা করছেন, প্রতিবাদ করছেন। তাদের এই সংগ্রাম প্রশংসনীয়।

বন্দি বিনিময় ও চলমান আলোচনার বিষয়

আবু উবায়দা বলেন, চলমান পরোক্ষ আলোচনার প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। একইসাথে আবু উবায়দা গত কয়েক মাসে একাধিকবার গাজার প্রতিরোধশক্তির একটি পূর্ণাঙ্গ চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সব বন্দিকে একসঙ্গে ফিরিয়ে দেওয়ার সেই প্রস্তাবের কথাও উল্লেখ করেন, যা নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এবং ইসরায়েল যে বন্দিদের ব্যাপারে দায়মুক্ত হতে চাচ্ছে ইসরায়েলি জনগণকে সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন।

পাশাপাশি চুক্তির ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে আবু উবায়দা বলেন, আমরা আশা করি চলমান পরোক্ষ আলোচনায় এমন একটি কার্যকর মানবিক চুক্তি হবে, যাতে গণহত্যা থেমে যাবে। ইসরায়েলি সেনারা গাজা থেকে সরে যাবে। এবং আমাদের জনগণের জন্য ত্রাণ সরবরাহ নিশ্চিত হবে। তবে যদি ইসরায়েল আলোচনায় অনমনীয় থাকে, তাহলে আংশিক বন্দি বিনিময় বা ১০ জনকে মুক্তি প্রদানের মতো চুক্তিতে আর ফেরা হবে না বলে হুশিয়ারিও দেন তিনি।

বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি হুঁশিয়ারি

বক্তব্যের শেষে আবু উবায়দা গাজায় অবস্থানরত ইসরায়েলি দালাল ও সহযোগীদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের এখনই তওবা করে নিজের জনগণের কাছে ফিরে আসা উচিত। অন্যথায় এরপর আর সুযোগ পাবে না। তখন শুধু অনুশোচনায় পুড়বে।

তিনি প্রশংসা করেন সেইসব পরিবার ও গোত্রের, যারা নিজেদের থেকে এই বিশ্বাসঘাতকদের আলাদা করে নিয়েছে।

 আবু উবায়দা বলেন, আরব নামধারী কিছু ভাড়াটে গুপ্তচরের ব্যবহার মূলত ইসরায়েলের ব্যর্থতা এবং নিশ্চিত নৈতিক পরাজয়েরই প্রকাশ।

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, শত্রুর এজেন্টরা আমাদের জনগণের চোখে ধুলো দিতে পারবে না। তারা হচ্ছে জ্বলন্ত পাতা, যাকে বাতাস উড়িয়ে নিয়ে যায়।

সবশেষে তিনি বলেন, “আমাদের জনগণের স্থিতিশীলতা, আত্মত্যাগ, সংগ্রাম, ধৈর্য—এসবই শত্রুর জন্য সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা।

আগের বক্তব্য: মার্চ মাসের বার্তা

এর আগে আবু উবায়দা মার্চ মাসে দেওয়া আগের ভিডিও বার্তায় বলেছিলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির ও বন্দিবিনিময়ের শর্তে আমরা সম্মত হয়েছিলাম। কিন্তু ইসরায়েল সেই চুক্তি ভেঙে ফের আগ্রাসন চালিয়েছে। তারা মার্কিন সমর্থন চেয়েছে নতুন হামলার জন্য।

ওই ভিডিওতে আবু উবায়দা একটি মঞ্চে দাঁড়িয়ে ছিলেন, পাশে ছিল আল-আকসা মসজিদ ও কুব্বাতুস সাখরার ছবি এবং কুরআনের সূরা ফাতির-এর দশম আয়াত থেকে উদ্ধৃতি: আর তাদের ষড়যন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে।

তখন তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর হুমকির জবাবে বলেছিলেন, আমরা সব সময় প্রস্তুত। প্রতিরোধশক্তির হাতে এমন কিছু আছে, যা শত্রুকে আঘাত করতে পারে। শত্রুর হুমকি আমাদের ভয় দেখাতে পারবে না বরং এটি আমাদের আরও শক্তি জোগাবে।

তিনি আরও বলেন, যা যুদ্ধ দিয়ে নিতে পারেনি, তা কখনো হুমকি বা চাতুরী দিয়ে নিতে পারবে না। আর নতুন করে হামলা হলে শত্রুর বন্দিরা মারা পড়তে পারে, এর দায় ইসরায়েলকেই নিতে হবে।

চুক্তিই একমাত্র সমাধানের পথ

এদিকে হামাস বিবৃতিতে জানিয়েছে, ইসরায়েল যদিও গাজাবাসীকে দুর্ভিক্ষ ও অবরোধের মাধ্যমে কাবু করতে চায়, কিন্তু আমাদের কার্যকর প্রতিরোধ কৌশল ও অটল অবস্থানের কারণে ইসরায়েল এখন পুরোপুরিভাবে বন্দিদের মুক্ত করতে ব্যর্থ।  ইসরায়েলের সামনে একটাই রাস্তা খোলা— আমাদের শর্ত ও ইচ্ছামতো একটি চুক্তি।

অর্থাৎ হামাসের মতে, “এই যুদ্ধ এখন ইসরায়েলের জন্য এক ব্যর্থতার প্রতীক এবং ভবিষ্যৎ ইতিহাসের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেই অধ্যায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দখলদার ইসরায়েলের নৃশংসতা ও গণহত্যার বিবরণ তুলে ধরবে।’

সর্বশেষ