মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে যেভাবে অস্ত্র তৈরি করে হামাস 

কাসসাম ব্রিগেডের নৌ ইউনিট গাজার উপকূল থেকে গভীর সমুদ্রে পৌঁছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবে যাওয়া দুটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়।
হামাস
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ডুবে যাওয়া জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে যেভাবে অস্ত্র তৈরি করছে হামাস। ছবি : আল জাজিরা

দীর্ঘদিনের অবরোধে বিধ্বস্ত গাজা উপত্যকায় কীভাবে প্রতিরোধযোদ্ধারা অস্ত্র সংগ্রহ ও  উৎপাদন করছে সম্প্রতি ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর হামলা বেড়ে যাওয়ায় সেই প্রশ্ন নতুন করে সামনে এসেছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে ঐতিহাসিক হামলার পর হামাস বলেছিলো,তারা এখন এক ধরনের ‘ক্ষয়যুদ্ধ’ চালিয়ে যাচ্ছে।এখনকার  যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকেই স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, কোন সহায়তা ছাড়াই গাজার প্রতিরোধযোদ্ধারা কীভাবে অস্ত্র জোগান নিশ্চিত করছে এবং তা ব্যবহার করে মোকাবিলা করছে ইসরায়েলি বাহিনীর।

আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে হামাসের সামরিক শাখা কাসসাম ব্রিগেডের এক শীর্ষ নেতা বলেন, বহু আগেই মিশর সীমান্ত হয়ে আসা অস্ত্রের চালান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বছরের পর বছর ধরে তাঁরা নিজেদের প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করেই অস্ত্র উৎপাদন করে আসছেন।

এই বক্তব্যের পর আবার সামনে এসছে সেই পুরনো প্রশ্ন—চারদিক থেকে অবরুদ্ধ গাজার মতো একটি সংকটাপন্ন এলাকায় এত অস্ত্র আসে কোথা থেকে ? আর কীভাবেই বা সেই অস্ত্র হয়ে উঠছে ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য হুমকি ?

সাক্ষাৎকারে কাসসাম নেতার দাবি, ইসরায়েলের তরফে রাফাহ শহরকে অস্ত্র চালান ও গুদামজাত করার কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করার যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার। তাঁর ভাষায়, ‘তুফানুল আকসা’ অভিযানে গাজাবাসীর স্বনির্ভর অস্ত্রশক্তির সক্ষমতা পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

আল জাজিরার অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে এমন কিছু চিত্র, যা থেকে বুঝা যায়—গাজার ভেতরেই প্রতিরোধ যোদ্ধারা তৈরি করছে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র। এবং সেগুলো দিয়েই তারা ধারাবাহিকভাবে রুখে দিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনীর অগ্রগতি।

দীর্ঘ অবরোধ আর বাইরের সরবরাহ বন্ধ থাকার পরও গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা নির্মাণ করেছেন ‘স্বনির্ভর অস্ত্র উন্নয়নের’ একটি নিজস্ব অবকাঠামো। আল জাজিরার ইনভেস্টিগেটিভ প্রোগ্রাম ‘মা খাফিয়া আ’যম’-এর একটি পর্বে দেখানো হয়, কাসসাম ব্রিগেডের কারিগরি ইউনিট ২০১৪ সালের যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি বাহিনীর ফেলে যাওয়া গোলাবারুদের অংশ সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে নতুন রকেট তৈরি করছে।

গোপন আস্তানায় তৈরি করা হয় ‘ইয়াসিন ১০৫’ নামের একটি শক্তিশালী রকেট লাঞ্চার, যা সরাসরি ব্যবহৃত হয়েছে ‘তুফানুল আকসা’ অভিযানে। এই লাঞ্চার ব্যবহার করে ধ্বংস করা হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর শত শত সাঁজোয়া যান।

অবরোধ, আগ্রাসন ও সীমিত আনুকূল্যের মাঝেও গাজার প্রতিরোধ আন্দোলনের অস্ত্র  উন্নয়নের এই সংগ্রাম এখন আর শুধুই একটি সামরিক প্রয়াস নয়—বরং তা হয়ে উঠেছে এক কৌশলগত বার্তা। এই বার্তা স্পষ্ট; নিয়ন্ত্রিত পরিবেশেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব, আর সেটিই ফিলিস্তিনিদের সক্ষমতার প্রতীকে রূপ নিয়েছে। 

ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার গোপন রহস্য

গাজায় প্রতিরোধযোদ্ধাদের অস্ত্রভাণ্ডারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে স্থানীয়ভাবে তৈরি নানা ধরনের বিস্ফোরক। এর মধ্যে ‘শোয়াজ’ নামের শক্তিশালী বিস্ফোরক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলো তৈরি হয়েছে গাজার ভেতরে সহজলভ্য উপকরণ—ধাতব পাইপ, তামার পাত ইত্যাদি দিয়ে। এমনভাবে নকশা করা হয়েছে, যাতে তা ইসরায়েলি সামরিক যানবাহনের বর্ম ভেদে সক্ষম হয়।

এই কাঁচামাল থেকেই কাসসাম ব্রিগেড তৈরি করেছে ‘আল-গুল’ নামের একটি স্নাইপার রাইফেল, যা বর্তমানে গাজায় প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। দুই হাজার মিটার পাল্লার এই রাইফেল বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট এমনকি হালকা বর্মও ভেদ করতে পারে।

প্রতিরোধযোদ্ধারা যেসব ধাতব উপাদান ব্যবহার করছে, তার বড় একটি অংশ এসেছে গাজার পানির পাইপলাইনের ধ্বংসাবশেষ থেকে। এক সময় ইসরায়েল এসব বিশাল পাইপ ব্যবহার করত গাজার পানি সরিয়ে নিতে। ২০১৭ সালে কাসসাম ব্রিগেড সেগুলোর সন্ধান পায় এবং অস্ত্র তৈরির উপাদান হিসেবে কাজে লাগায়।

আল জাজিরার অনুসন্ধানী সাংবাদিক জাফর সালামাত ‘মা খাফিয়া আ’যম’ প্রোগ্রামে তুলে ধরেন কাসসাম রকেটের ধ্বংসাত্মক শক্তির পেছনের বাস্তবতা। কাসসাম ব্রিগেডের নৌ ইউনিট গাজার উপকূল থেকে গভীর সমুদ্রে পৌঁছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ডুবে যাওয়া দুটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। ওই জাহাজের ভেতরে থাকা সংরক্ষিত বিস্ফোরক থেকে সংগৃহীত উপাদান ব্যবহার করেই তারা রকেটের ওয়ারহেড আরও শক্তিশালী করে, যা দিয়ে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে হামলা চালানো হয়।

তবে এই স্বনির্ভরতা কেবল অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তিতে সীমিত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে গোয়েন্দা কর্মকাণ্ডেও। কাসসাম ব্রিগেড জানায়, যুদ্ধের সময় ইসরায়েলি বাহিনী গাজার বিভিন্ন স্থানে ট্র্যকিং ও নজরদারি ডিভাইস পুঁতে রেখেছিল। যুদ্ধশেষে ধ্বংসস্তূপ থেকে সেগুলো উদ্ধার করে নিজেরাই তা ব্যবহার করেছে শত্রুপক্ষের গতিবিধি নজরদারিতে।

একটি অবরুদ্ধ, সংকুচিত ও নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে দাঁড়িয়ে গাজার প্রতিরোধযোদ্ধারা দখলদারদের ফেলে যাওয়া ধ্বংসাবশেষ, ধাতব সামগ্রী ও অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করে তা পুনঃব্যবহার করছে অস্ত্র তৈরিতে। এই স্বনির্ভরতা শুধু প্রযুক্তিগত সাফল্য নয়, বরং ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের একটি ঐতিহাসিক মাইলফলকও। 

সর্বশেষ