মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার সুযোগে অর্থনৈতিকভাবে যেভাবে লাভবান হলো আফগানিস্তান

ফ্লাইট ট্র্যাকিং সাইট ‘ফ্লাইট রাডার ২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৩ জুন ২০২৫ থেকে আফগান আকাশসীমা দিয়ে দৈনিক ফ্লাইট চলাচল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ২৮০টিতে—যা প্রায় ৫০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি। আশা করা হচ্ছে, এই সংখ্যা দ্রুতই ৩৫০ ছাড়িয়ে যাবে।
ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার সুযোগে অর্থনৈতিকভাবে যেভাবে লাভবান হলো আফগানিস্তান
ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনার সুযোগে অর্থনৈতিকভাবে যেভাবে লাভবান হলো আফগানিস্তান। ছবি : আল জাজিরা

মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক উত্তেজনা বাড়ার পর আকাশপথে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলগুলো এড়িয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটগুলো আফগানিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহার শুরু করায় কেবল এই একটি খাত থেকেই আফগান সরকার মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে।

তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর আর্থিক সংকটে জর্জরিত আফগানিস্তান এইভাবে নিজের ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ জব্দ হয় এবং আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, যার ফলে অর্থনীতি চরম দুরবস্থায় পড়ে।

পাঁচগুণ বেশি ফ্লাইট

ফ্লাইট ট্র্যাকিং সাইট ‘ফ্লাইট রাডার ২৪’-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৩ জুন ২০২৫ থেকে আফগান আকাশসীমা দিয়ে দৈনিক ফ্লাইট চলাচল বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ২৮০টিতে—যা প্রায় ৫০০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি। আশা করা হচ্ছে, এই সংখ্যা দ্রুতই ৩৫০ ছাড়িয়ে যাবে।

আফগান পরিবহন ও বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হেকমতুল্লাহ আসাফি জানান, সম্প্রতি আমাদের আকাশপথ দিয়ে দৈনিক গড়ে ৩০০টি ফ্লাইট যাচ্ছে। যদিও সামান্য কমতি দেখা দিয়েছে, তবে আঞ্চলিক উত্তেজনা অব্যাহত থাকলে আবারও বাড়বে।

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আফগানিস্তানের আকাশসীমা অঞ্চলটির অন্যতম নিরাপদ রুট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বেসামরিক ফ্লাইটগুলোর জন্য এটি এখন এক গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প করিডর।

মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার কারণে ইরান, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন ও জর্ডানের আকাশপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, অনেক আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স তাদের রুট ঘুরিয়ে আফগানিস্তান ও সৌদি আরব হয়ে চালাতে বাধ্য হচ্ছে।

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর নিরাপত্তা শঙ্কায় অনেক বড় বড় এয়ারলাইন্স আফগান আকাশপথ এড়িয়ে চলত। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলে গেছে। আসাফি জানান, আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা অনেকটাই উন্নত হয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক রুটে আবারও আফগানিস্তানকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আমরা প্রযুক্তিগত ও দিকনির্দেশনামূলক সবধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।

মন্ত্রণালয়ের হিসেবে, ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ১০০-১২০টি ফ্লাইট আফগান আকাশপথ ব্যবহার করেছে। ২০২৩ সালে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হওয়ার পর থেকেই এই প্রবণতা বাড়তে থাকে।

আকাশপথে লাখো ডলার আয়: কীভাবে রাজস্ব তুলছে আফগান সরকার?

আফগান পরিবহন ও বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি বিমান থেকে নির্দিষ্ট হারে ৭০০ ডলার করে ফি আদায় করা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও সরকারি ব্যাংক হিসাব জব্দ থাকার কারণে এই টাকা সরাসরি সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। ফলে আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে টাকা আদায় করে প্রথমে একটি তৃতীয় পক্ষের হিসাবে জমা করা হয়, পরে তা আফগানিস্তানে পাঠানো হয়।

পরিবহনমন্ত্রী আসাফি বলেন, আমরা প্রক্রিয়া সহজ করেছি যাতে আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলো নিশ্চিন্তে আমাদের আকাশপথ ব্যবহার করে। এই রাজস্ব বেসামরিক বিমান চলাচলের অবকাঠামো উন্নয়ন ও জাতীয় অর্থনীতিকে সহায়তায় ব্যয় করা হয়।

আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (ICAO)-এর সঙ্গে সমন্বয় করে নির্ধারিত কিছু উচ্চমাত্রার বিমানপথ—যেমন P500 ও G500 ব্যবহার করা হয়, যা ৩০ থেকে ৪০ হাজার ফুট উচ্চতায় পার্বত্য অঞ্চল এড়িয়ে চলে। ২০২১ সালের পর থেকে আধুনিক এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সিস্টেম না থাকায়, উপগ্রহ প্রযুক্তি ও প্রতিবেশী দেশগুলো (যেমন পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান)-এর সহযোগিতায় বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়।

বর্তমানে আফগানিস্তান থেকে দুটি দেশীয় ও সাতটি বিদেশি এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট চালু রেখেছে, যা দেশটিকে একটি আঞ্চলিক বিমান চলাচলের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। 

বিশ্লেষকদের মতে, আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থাগুলোর আফগান আকাশসীমা ব্যবহার করা এক ধরনের ‘বাস্তব স্বীকৃতি’। যদিও তালেবান সরকারকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি, তবুও এই অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রমাণ করে—আন্তর্জাতিক স্বার্থ অনেক সময় রাজনৈতিক অবস্থানের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে।

আর্থিক লাভ : কত টাকা আসছে?

সরকারি হিসাব বলছে, ২০২৪ সালে প্রতিদিন ১০০-১২০টি ফ্লাইটের মাধ্যমে আনুমানিক ১ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। আর ২০২৫ সালের জুনে প্রতিদিন ২৮০ থেকে ৩৫০টি ফ্লাইট চলাচল করছে, যার থেকে প্রতি সপ্তাহে ১৩ লাখ ৭০ হাজার থেকে ১৭ লাখ ২০ হাজার ডলার পর্যন্ত আয় হচ্ছে। ফলে বাৎসরিক আয়ের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৩ থেকে ৩.৫ কোটি ডলারের মধ্যে।

পরিবহনমন্ত্রী আসাফি বলেন, এই অর্থ দেশের সংকটাপন্ন অর্থনীতির জন্য বড় সহায়তা, তবে জাতীয় চাহিদার তুলনায় তা এখনো খুবই সীমিত।

এই ডলারের মাধ্যমে খাদ্য, জ্বালানি ও ওষুধের মতো জরুরি আমদানি পণ্য কেনা হয়। কারণ ২০২১ সালের পর থেকে আফগানিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) কমেছে ২৬ শতাংশ, এবং প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের নিচে বসবাস করছে।

এর সঙ্গে রয়েছে আরও একটি বড় সমস্যা—আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৭ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ এখনো জব্দ। ফলে এই আকাশসীমা থেকে পাওয়া রাজস্ব দেশটির অর্থনীতিকে কিছুটা হলেও টিকে থাকতে সাহায্য করছে।

বিমান নেভিগেশন বিশ্লেষক আব্দুস সালাম আজিজ বলেন, এই আয়ের গুরুত্ব অনেক, কারণ এটা এখন আফগান অর্থনীতির জন্য আপাতকালীন অক্সিজেন। তবে এটাতে দেশের কাঠামোগত সংকট কাটবে না।

তিনি বলেন, যদি এই অর্থ দিয়ে কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আধুনিকায়ন, রাডার বসানো এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা যায়, তাহলে আফগানিস্তান আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে।

কতটা টেকসই হবে এই আয় 

আফগানিস্তানের আকাশপথ থেকে রাজস্ব আয় এখনো আঞ্চলিক উত্তেজনার ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতিবিদ আজিজ সতর্ক করে বলেন, যদি ইরানসহ আশপাশের দেশগুলোর আকাশপথে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটে, তাহলে আফগানিস্তানের কৌশলগত গুরুত্ব কমে যাবে। সংঘাতের ওপর নির্ভর করে আয় বাড়ানো কখনোই টেকসই কৌশল হতে পারে না।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আহমদ ফেরদৌস বহ্‌গজিনের মতে, আন্তর্জাতিক মানে বিমানবন্দরগুলো আধুনিকায়ন করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে আয় বাড়ানো সম্ভব। তার ভাষায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে পরিকল্পিত বাণিজ্যিক চুক্তি হলে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।

আল জাজিরা কে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, কাবুল ও কান্দাহার বিমানবন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে পারলে আফগান আকাশপথ একটি স্থায়ী আয়ের উৎসে পরিণত হতে পারে।

প্রশাসনিক জটিলতার কথাও উঠে এসেছে। আজিজ জানান, বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে লেনদেন হওয়ায় বিল পরিশোধে গড়ে ৬ থেকে ৮ মাস সময় লাগছে। ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই অর্থ বিনিয়োগেও সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে, কারিগরি দিক দিয়ে আফগান আকাশসীমায় এখনো নজরদারির অভাব রয়েছে। ফলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে, কারণ পাইলটদের নিজ উদ্যোগে একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়।

বর্তমানে আফগানিস্তানে ২৭টি বিমানবন্দর চালু রয়েছে, যার মধ্যে ৫টি আন্তর্জাতিক: কাবুল, হেরাত, মাজার-ই-শরীফ, কান্দাহার ও জালালাবাদ। এগুলো আফগানিস্তানের বিমান চলাচল সক্ষমতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন