মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

কাশ্মীরে কিভাবে ইসলামের আগমন ঘটল?

কাশ্মীর, এক সময়ের শান্ত ও মনোরম উপত্যকা, আজ বিশ্বের অন্যতম বিতর্কিত অঞ্চল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম, পাকিস্তানের উত্তর-পূর্ব এবং চীনের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানায় অবস্থিত এই ভূখণ্ডের ইতিহাস যেমন সমৃদ্ধ, তেমনি ঘটনাবহুল। কিন্তু কীভাবে ইসলাম এই তুলনামূলক বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করল? কাদের হাত ধরে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ল কাশ্মীরের পাহাড়ি উপত্যকায়?

ইসলামের প্রথম প্রবেশ

ঐতিহাসিকদের মতে, কাশ্মীরে ইসলামের প্রবেশ ঘটে ১৪শ শতকের শুরুতে। অনেকের মতে, ইসলাম প্রচারের প্রথম কাজটি করেন এক সুফি সাধক বুলবুল শাহ। তিনি কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু রাজা রিঞ্চন শাহকে ইসলামে দীক্ষিত করেন। ইসলাম গ্রহণের পর রাজা নতুন নাম নেন সদরউদ্দিন। এই ঘটনা কাশ্মীরে ইসলামের প্রসারে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দেয়।

তবে কাশ্মীরের সমাজ মূলত সুফি মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে সুফিদের অবদান ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৩৮৮ সালে ইরানের হামদান থেকে একদল সুফি সাধক কাশ্মীরে আসেন, যারা ‘সাদাত’ নামে পরিচিত ছিলেন। তারা মূলত তৈমুর লঙের অত্যাচার থেকে বাঁচতে কাশ্মীরে আশ্রয় নেন। এই সুফি দলটির নেতৃত্বে ছিলেন সাইয়্যেদ আলী হামদানি, যিনি কাশ্মীরের ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

মসজিদ ও ইসলামের স্থাপত্যিক বিস্তার

কাশ্মীরে ইসলাম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মসজিদ ও ধর্মীয় স্থাপত্যেরও বিকাশ ঘটে। শ্রীনগরের জামে মসজিদ এই অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ হিসেবে পরিচিত। সুলতান ইস্কান্দার শাহ মীর ১৩৯৪ সালে মসজিদটির নির্মাণ শুরু করেন এবং তাঁর পুত্র জাইনুল আবেদিন ১৪০২ সালে এর কাজ শেষ করেন।

এই মসজিদটি ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। বিশাল আঙ্গিনা, উঁচু মিনার, লাল ইট ও চুনাপাথরের মসজিদটি মুসলিম ঐতিহ্যের সাক্ষী বহন করছে। মসজিদের ভেতরের খোদাই করা স্তম্ভ ও কারুকার্যপূর্ণ নকশা ইসলামী শিল্পকলার উজ্জ্বল নিদর্শন। মসজিদ চত্বরের একটি মনোরম বাগান রয়েছে, যা সুফি সাধক সাইয়্যেদ আলী হামদানির নামে নামকরণ করা হয়েছে।

কাশ্মীরের মুসলিম শাসন ও পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

ইসলাম কাশ্মীরে শাসনব্যবস্থারও পরিবর্তন ঘটায়। বিভিন্ন সুলতান মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক ছিলেন। ঐতিহাসিক হুসাইন মোনিস উল্লেখ করেন কাশ্মীরের সুলতানদের মধ্যে ইসলামচর্চার প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশেষ করে সুলতান ইস্কান্দার, যিনি হিন্দু মন্দির ও মূর্তি ভেঙে ফেলার জন্য ‘বুতশিকান’ (মূর্তিনাশক) উপাধি লাভ করেন।

বর্তমান পরিস্থিতি: সংকটে কাশ্মীরের মুসলমানরা

কাশ্মীরের ইতিহাসে ইসলামের প্রবেশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বর্তমান প্রেক্ষাপটও তেমনই উদ্বেগজনক। কাশ্মীরের মুসলমানরা বর্তমানে নানা বিধিনিষেধ ও দমন-পীড়নের শিকার। ভারত সরকারের কঠোর নীতির ফলে মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংকুচিত হচ্ছে।

২০২১ সালের শেষ দিকে ভারত সরকার শ্রীনগরের জামে মসজিদ বন্ধ করে দেয়। এমনকি ২০২২ সালের ঈদুল ফিতরের দিনও মসজিদটিতে ঈদের নামাজ আদায়ের অনুমতি দেওয়া হয়নি। মুসলমানদের শুধু সকাল ৭টার আগে পর্যন্ত মসজিদে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে ওঠা কাশ্মীরের এই ভূখণ্ডে ইসলামের পথচলা যেমন সংগ্রামের, তেমনি টিকে থাকারও। অতীতের ঐতিহ্য আজও জেগে আছে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের জন্য কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা