ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি সম্প্রতি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল সফর করেছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর এটি তার প্রথম আফগানিস্তান সফর। সফরে তিনি আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ।
সীমান্ত, বাণিজ্য ও সম্পর্ক পুনর্গঠন
আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জাকির জালালি এই সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এটি দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলমান সমস্যাগুলো সমাধানে একটি বিস্তৃত সংলাপের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে। আফগানিস্তান ও ইরানের মধ্যে ১,০০০ কিলোমিটারের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা উভয় দেশের জন্যই কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জালালি আশা প্রকাশ করেন, এই সফর কাবুল-তেহরানের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বিশ্লেষকদের মতে, গত তিন বছরে ইরান তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন, বিশেষত সিরিয়া থেকে ইরানি সেনাদের প্রত্যাহার, দেশটিকে আফগানিস্তানের দিকে নতুন করে মনোযোগ দিতে বাধ্য করেছে।
কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের অগ্রগতি
আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ইতোপূর্বে ইরান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক পরিচালিত হতো ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের মাধ্যমে। কিন্তু এবার কূটনৈতিক উদ্যোগটি সরাসরি ইরানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সম্পাদিত হচ্ছে। সূত্রটি আরও জানায়, আব্বাস আরাকচি কাবুল সফরে ইরানি দূতাবাসের কূটনৈতিক দল পুনর্গঠন করেছেন। এছাড়া, আফগান ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ইরানের সর্বশেষ উচ্চপর্যায়ের সফর অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৭ সালে, যখন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাওয়াদ জারিফ আফগানিস্তানে যান। এরপর তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে ইরান কাবুলে নতুন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছে এবং তাদের কূটনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করেছে।
রাজনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক বিশ্লেষক আব্দুল করিম নাজার বলেন, ‘প্রথম তালেবান সরকারের সময় ইরান তাদের বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু এবার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ইরান তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার নীতি গ্রহণ করেছে।’
আফগানিস্তান ভৌগোলিকভাবে ইরানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার বাজারে প্রবেশের অন্যতম প্রধান পথ। একইভাবে, আফগানিস্তান ইরানের চাবাহার বন্দর ব্যবহার করে ভারতসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে।
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন গত দুই বছরে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। আফগান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুস সালাম জাওয়াদ জানিয়েছেন, গত বছরে আফগান রপ্তানি ১১৬ শতাংশ বেড়ে ৫৪ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, ইরানের রপ্তানি ৮৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩.১৪৩ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ, শরণার্থী এবং পানিবণ্টন ইস্যুতে কোনো সমাধান হয়নি। তালেবান সরকার সম্প্রতি হেরাত প্রদেশে ‘পাশদান’ বাঁধ নির্মাণ শুরু করলে ইরান তীব্র আপত্তি জানায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তান এই পানিবণ্টন ইস্যুকে কৌশলগত চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
তালেবান সরকারের মুখপাত্র হামিদুল্লাহ ফিতরাত বলেন, ‘আমরা ইরানের ক্ষতি করতে চাই না। বরং দুই দেশের মধ্যে চুক্তির আওতায় সমস্যার সমাধান চাই।’
সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ
ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই সফরকে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাব্য সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে। কূটনৈতিক সংলাপ, বাণিজ্যিক সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে দুই দেশ ভবিষ্যতে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। তবে শরণার্থী সংকট এবং পানিবণ্টনের মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো সমাধান করা না গেলে এই সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইরানের কাবুল সফর শুধুমাত্র কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন নয়, বরং আঞ্চলিক রাজনীতিতে নতুন কৌশলগত অগ্রগতিরও প্রতিফলন। আঞ্চলিক শান্তি এবং সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই সফর দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করতে পারে।
সূত্র: আল-জাজিরা