আজকে একটা স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, গাজার পথে পথে হেঁটে বেড়াচ্ছি। হাজারে হাজারে মানুষ পথে। বাড়ি ফিরছে, আনন্দ করছে, নাগমায় সুর তুলছে। বাচ্চারা দৌড়োচ্ছে। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফোয়ারা বইছে যেন আনন্দের৷ বোম্বিং থেমেছে, গাজার পাখিরা ইকটু মুক্ত আকাশে উড়ে বেড়াতে পারছে তাই। গাজার আকাশ ইকটু ইতমিনানের নিশ্বাস ফেললো যেন।
গাজার মানুষদের দেখলাম অসম্ভব পরিপাটি। কী সুশৃঙ্খল! যুদ্ধ থেমেছে ২৪ ঘন্টাও হয়নি, তার মধ্যেই দেখলাম শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় মোতায়েন করা হয়েছে শয়ে শয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোন লুটতরাজ নেই। এই বিক্ষুব্ধ ক্ষুধাতেও ত্রাণ কার্যক্রম কী নিপুণভাবে সামলে নিচ্ছে ওরা।
শরণার্থী ক্যাম্প থেকে বাড়ি ফেরার পথে যাত্রাকে নির্বিঘ্ন করতে সে কী তোড়জোড়।
গাজাবাসীদের জীবন খুব সাজানো গোছানো। ওদের কাছে মউত এক তোহফা। ওরা তাঁবুর মধ্যে থাকে, কিন্তু তাঁবুর মধ্যে যুদ্ধকে ঢুকতে দেয় না। অল্প যা কিছু, তা দিয়েই পরিপাটি করে রেখেছে তাঁবুর সাম্রাজ্য। ছোট্ট একটা মেয়ের মা নেই। অথচ দেখলাম, ওর চুলগুলোও কী সুন্দর ঝুটি বাঁধা।
ওদের ইয়াকিন হয়ে গেছে, এই জীবনটা যেমন; শাহাদাতের ওপারের জিন্দেগীও তেমনই একটা জীবন। বরং এখানের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর। মৃত্যুর এই মিছিল তাই ওদের যাপিত জীবনের উসুলে তেমন কোন পরিবর্তনই আনতে পারে না। ওরা এই সবকিছুর মাঝেও খেলাধুলা করে, এক্সারসাইজ করে, হিফজ করে, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, প্রেমে পড়ে, বিয়ে করে; হায়াতের প্রতিটি মুহূর্ত ওরা উপভোগ করে বাঁচে।
সবার বিপরীতে হাঁটতে হাঁটতে রাফাহর তাল্লাস সুলতান মোড়ে এসে থামলাম। সবাই সোজা হেঁটে সমূদ্র তীরঘেঁষা আর রশিদ স্ট্রিটের দিকে যাচ্ছে। আমি ওদিক না গিয়ে ইকটু ভেতরের দিকে ঢুকে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে এসে থামলাম একটা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়ির সামনে। বাড়িটা ঐতিহাসিক। সিনওয়ার রাহি. এর শেষ দুর্গ ছিল এটা। বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। ভেঙে যাওয়া সোফার কিছু অংশ এখনো পড়ে আছে সেখানে৷ নিজেকে সিনওয়ার ভেবে শাহাদাতের আগের সেই ইহসাসটা ধরতে চেষ্টা করছিলাম।
হঠাৎ কেউ একজনের কন্ঠ শুনে চমকে উঠলাম। শুনলাম ভরাট কন্ঠে কেউ একজন বলছে—
سَلامُ اللَّهِ عَلَى غَزَّةَ، سَلامٌ عَلَى شَعْبِهَا الصَّامِدِ، سَلامٌ عَلَى مُجَاهِدِيهَا الشُّجْعَانِ، سَلامٌ عَلَى كُلِّ قَطْرَةِ دَمٍ نَزَفَتْ، سَلامٌ عَلَى كُلِّ دَمْعَةٍ ذَرَفَتْ، سَلامٌ عَلَى مَنْ جَاعَ وَعَطِشَ، سَلامٌ عَلَى مَنْ فَقَدَ وَعَاشَ الأَلَمَ، سَلامٌ لِأَرْوَاحِ الشُّهَدَاءِ، سَلامٌ لَكُمْ يَا أَهْلَ الشُّهَدَاءِ وَالْجَرْحَى وَالْأَسْرَى، سَلامٌ لِأَهْلِنَا فِي الْخِيَامِ، سَلامُ اللَّهِ عَلَى نُفُوسٍ أَبِيَّةٍ، وَقُلُوبٍ صَابِرَةٍ، وَشَعْبٍ حُرٍّ.
‘আল্লাহর সালাম বর্ষিত হোক গাজ্জার উপর। এর অবিচল জনগনের উপর। সালাম, এর প্রবাদতূল্য সাহসী মুজাহিদদের উপর। সালাম, ইনসাফের লড়াইয়ে এই জমিনে ঝরে পড়া প্রতি ফোঁটা রক্তের উপর। নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়া প্রতি ফোঁটা অশ্রুবিন্দুর প্রতি সালাম। সালাম তাদের প্রতি, যারা অসহনীয় ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় দিন গুজরান করেছে। তাদের প্রতি সালাম, যারা একেরপর এক সব হারিয়ে কেবল যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছে। সালাম, শহিদদের জান্নাতী রূহে। তোমাদের সবার প্রতি সালাম হে শহিদ, আহত, বন্দিদের আহল ও ইয়াল। ছেড়াফাটা তাঁবুতে দিনের পর দিন কাটালে তোমরা যারা, সবার প্রতি সালাম। আল্লাহর অবারিত সালাম বর্ষিত হোক, সেই মহিমান্বিত লোকগুলোর প্রতি, সেই পাহাড়তুল্য ধৈর্যশীল ক্বলবগুলোর প্রতি আর বর্ষিত হোক তাদের প্রতি—যারা চিরস্বাধীন জাতি!’
বলতে বলতে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন। ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমার। এ যে স্বয়ং সিনওয়ার! মহান সিনওয়ার! আমি তড়িঘড়ি কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কোনমতে সালাম দিতে দিতে হাত ধরে চুমু খাবো, ধরতেই ইকটু কঁকিয়ে উঠলেন। মুখে প্রশান্তির হাসি। কী দীপ্তি ছড়িয়ে আছে মুখ জুড়ে; ঠিক শাহাদাতের দিনের মত!
হাতের দিকে তাকাতেই দেখি, এখনো তাজা রক্ত ঝড়ছে সেখান থেকে। আমাকে দেখে কথা বলতে শুরু করলেন তিনি। কত কথা! গাজাবাসীদের কুরবানী, মুজাহিদদের ইস্তিকামাত, দীর্ঘ এ জিহাদের দাস্তান; উচ্ছ্বসিত হয়ে বলছিলেন সব কথা। লক্ষ্য পূরণের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হওয়ার আনন্দ খেলা করছিল তার সারা মুখজুড়ে।
সময় হয়ে যাচ্ছে। উনি চলে যাবেন। যাওয়ার আগে বললেন—‘আমার বড় আশা, আল্লাহ আমাকে সাহাবি খুবাইব ইবনু আদির সাথে হাশর করাবেন। আমরা সেদিন আমাদের কাঠগুলো সঙ্গে নিয়ে বীরদর্পে তার দরবারে হাজির হবো!’
তিনি ইকটু দূরে পড়ে থাকা লাঠিটা তুলে নিলেন; শাহাদাতের আগে পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে যেটা সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। শাহাদাতের আগে তার শেষ সঙ্গী ছিল এই এক টুকরো লাঠি। তিনি খুবাইব ইবনু আদির শাহাদাতের ঘটনার দিকে ইশারা করেছিলেন। খুবাইব রাদি. কে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যার আগে তিনি বড় তৃপ্তির সাথে গাইছিলেন—
وَلَسْتُ أُبَالِي حِينَ أُقْتَلُ مُسْلِمًا
عَلَى أَيِّ جَنْبٍ كَانَ لِلَّهِ مَصْرَعِي
وَذَاكَ فِي ذَاتِ الإِلَهِ وَإِنْ يَشَأْ
يُبَارِكْ عَلَى أَوْصَالِ شِلْوٍ مُمَزَّعِ
وَلَسْتُ بِمُبْدٍ لِلْعَدُوِّ تَخَشُّعًا
وَلَا جَزَعًا إِنِّي إِلَى اللَّهِ مَرْجِعِي
‘মুসলিম অবস্থায় যে মউত তাতে আমি পরোয়া করি না,
আল্লাহর পথে আমার দেহ পড়ে থাকুক দিগ্বিদিক।
আল্লাহর মানশায় বরকত বর্ষিত হোক আমার ছিন্নভিন্ন দেহেই।
শত্রুর ভয়ে আমি নত হই না, ব্যথায় কাঁদিও না—
কারণ দিনশেষে আমার প্রত্যাবর্তন তো আল্লাহর কাছেই।’
মহাকালের অজেয় কমান্ডার সিনওয়ারও হাজার বছর পরে এসে কবিতাটা আবৃত্তি করছেন, সেই একই তৃপ্তি-দীপ্তি ছড়িয়ে আছে তার সারা কন্ঠ জুড়ে। আমি যেন দিব্যচোক্ষে দেখতে পাচ্ছি, আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন খুবাইব, হামজা রাদিয়াল্লাহু আনহুম। কবিতাটা তখনো দূর থেকে হালকা আওয়াজে ভেসে আসছে। সিনওয়ার হাঁটতে হাঁটতে মিশে গেলেন বাড়ি ফেরা জনতার ভীড়ে। দূউউরে সমূদ্রের তীর ঘেষে হাঁটতে থাকা প্রতিটা যুবককে এখন আমার সিনওয়ার মনে হচ্ছে।











