২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর পর থেকেই বিশ্বজুড়ে বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর বিরুদ্ধে শুরু হয় বয়কট আন্দোলন। আরব ও মুসলিম দেশগুলোতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি হলেও, তা শুধু এই দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।
বিশ্বের খ্যাতনামা বহু কোম্পানি ইতোমধ্যে এ আন্দোলনের কারণে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এ ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে কয়েক বিলিয়ন ডলারে।
প্রায় দুইশ’ কোটি মানুষের বাজার হিসেবে মুসলিম বিশ্ব ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এই ভোক্তারা এখন নিজেদের ক্রয়ক্ষমতার গুরুত্ব বুঝতে শিখেছেন। সেই ক্রয়ক্ষমতাই পরিণত হয়েছে অর্থনৈতিক চাপের অস্ত্রে, যা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তাদের নীতি ও অবস্থান পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করছে।

তবে এ আন্দোলনে কেবল মুসলিমরা নন, বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ যুক্ত হয়েছেন। ভিন্ন জাতি ও ধর্মবিশ্বাসের হলেও তারা একত্র হয়েছেন ফিলিস্তিনের ন্যায্য অধিকার ও স্বাধীনতার দাবির পক্ষে।
এ সংহতির পেছনে রয়েছে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাফল্যের মতো উদাহরণ দেখিয়ে দিচ্ছে, বয়কট দেন, বিনিয়োগ প্রত্যাহার ও নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ বড় ধরনের বৈশ্বিক চাপ তৈরি করতে পারে। ফলে ব্যক্তি ও সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগেই তৈরি হচ্ছে বড় অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা।
বয়কট আন্দোলনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ব্র্যান্ডগুলোর একটি হলো স্টারবাকস।
আরব ও মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশে কফিশপ চেইনটি বয়কটের মুখে পড়েছে। মালয়েশিয়ায় এর প্রভাব সবচেয়ে স্পষ্ট। সেখানে স্টারবাকসের ফ্র্যাঞ্চাইজি পরিচালনা করে ভিনসেন্ট টানের মালিকানাধীন বারজায়া ফুড। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ভোক্তাদের বয়কটের কারণে তারা রেকর্ড পরিমাণ ক্ষতির মুখে পড়েছে।
কোম্পানির হিসাব অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে তাদের নিট ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ২৯২ মিলিয়ন রিঙ্গিত (৬৯ মিলিয়ন ডলার), যা আগের বছরেরও ণতুলনায় তিন গুণের বেশি। একই সময়ে তাদের আয়ে ধস নেমেছে ৬৪ শতাংশ, যা নেমে এসেছে ৪৭৭ মিলিয়ন রিঙ্গিতে। ফোর্বসের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। কোম্পানিটি বলছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ঘিরে তৈরি হওয়া আবেগ বাজার ও ভোক্তাদের খরচের ধরনে বড় প্রভাব ফেলেছে।’
যুক্তরাজ্যেও স্টারবাকসের বিক্রি কমেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরে তাদের ক্ষতি হয়েছে ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড। বিক্রি কমেছে ৪ শতাংশ, নেমে এসেছে ৫২৫.৬ মিলিয়ন পাউন্ডে—গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী বয়কট ও বিক্রি কমে যাওয়ার ফলে স্টারবাকসের বাজারমূল্য কমে গেছে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মোট বাজারমূল্যের প্রায় ৯ দশমিক ৪ শতাংশ—এমন তথ্য জানিয়েছে বিজনেস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস রিসোর্স সেন্টার।
ম্যাকডোনাল্ডস
ফাস্টফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডসের বিরুদ্ধে বয়কট শুরু হয় ফিলিস্তিনে তাদের এক শাখার ঘোষণার পর। শাখাটি ইসরায়েলি সেনাদের জন্য হাজারো ফ্রি খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নেয়। বিষয়টি সামনে আসতেই আরব ও মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়। ফলে ভোক্তারা দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেন এই ব্র্যান্ড থেকে।
২০২৩ সালে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়। প্রায় চার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো কোম্পানির ত্রৈমাসিক বিক্রি কমে যায়। রয়টার্স জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুর্বল পারফরম্যান্স এবং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ছিল এ পতনের প্রধান কারণ।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে এক আলোচনায় ম্যাকডোনাল্ডসের প্রধান নির্বাহী ক্রিস কেম্পজিনস্কি বলেন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফ্রান্সসহ নানা দেশে তাদের বিক্রি কমেছে। তবে সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে মধ্যপ্রাচ্যে। তাঁর ভাষায়, ‘যতদিন এ যুদ্ধ চলবে, এসব বাজারে বড় কোনো উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না।’
২০২৫ সালেও পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিক্রি কমেছে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, মধ্যপ্রাচ্যে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বৈশ্বিকভাবে ১ শতাংশ।
রাজস্ব কমেছে ৩ শতাংশ। ২০২৪ সালে যেখানে আয় ছিল ৬ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার, তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৯৬ বিলিয়নে। নিট মুনাফাও একই হারে কমে দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৮৬৮ বিলিয়ন ডলারে।
আমেরিকানা: কেএফসি ও ক্রিসপি ক্রিমের ফ্র্যাঞ্চাইজি
মধ্যপ্রাচ্যে ফাস্টফুড ফ্র্যাঞ্চাইজের সবচেয়ে বড় অপারেটর আমেরিকানা সরাসরি বর্জনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেএফসি ও ক্রিসপি ক্রিমের মতো মার্কিন ব্র্যান্ডকে কেন্দ্র করে হওয়া এ বর্জন তাদের ব্যবসায় বড় ধাক্কা দিয়েছে।
২০২৪ সালে কোম্পানির নিট মুনাফা প্রায় ৪০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৫৯ মিলিয়ন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসব রেস্তোরাঁ থেকে ক্রেতাদের সরে যাওয়ার কারণেই এ পতন ঘটেছে।
ফাইন্যানশিয়াল টাইমস-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আল-আবার বলেন, “মানুষের আবেগের জন্য আমি কাউকে দোষ দিই না।” তিনি জানান, ক্ষতি সামাল দিতে কোম্পানিকে খরচ কমাতে হয়েছে এবং স্থানীয় পর্যায়ে নতুন ব্যবসায়িক সুযোগ খুঁজতে হচ্ছে।
কোকা-কোলা ও পেপসি
দশকের পর দশক ধরে মুসলিম বিশ্বের বাজারে নিজেদের শেকড় গেড়ে বসেছে কোকা-কোলা ও পেপসি। কিন্তু গাজায় আগ্রাসনের পর শুরু হওয়া বর্জন আন্দোলন বাজারের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে।
মিসরে ২০২৪ সালে কোকা-কোলার বিক্রি কমে গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। অন্যদিকে স্থানীয় ব্র্যান্ড ভি৭–এর রপ্তানি মধ্যপ্রাচ্যে তিন গুণ বেড়েছে। জর্ডানের ম্যাট্রিক্স কোলার বিক্রিও ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
নিলসেন আইকিউ–এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে পশ্চিমা কোমল পানীয় ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রি মোট ৭ শতাংশ কমেছে। অথচ এই সময় মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কোমল পানীয়ের বাজারের আকার ছিল ২১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৩২ সালের মধ্যে এ বাজারের আকার বাড়বে ২৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে।
কারফুর
ফরাসি খুচরা বিপণি কারফুর আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্জনের মুখে তাদের উপস্থিতি পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়েছে।
জর্ডানে কারফুরের আঞ্চলিক ফ্র্যাঞ্চাইজি মাজিদ আল ফুতাইম ২০২৪ সালের নভেম্বরে সব শাখা বন্ধ করে দেয়। পরে নতুন নামে হাইপার ম্যাক্স হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে। অন্যদিকে, ওমানে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে কারফুরের সব কার্যক্রম স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে।
ক্রোনিকল অব প্যালেস্টাইন–এর তথ্যমতে, কারফুরের নিট মুনাফা ১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ইউরো থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭২৩ মিলিয়ন ইউরোতে। অর্থাৎ প্রায় ৯৩৭ মিলিয়ন ইউরো লোকসান, যা ৫০ শতাংশেরও বেশি পতন।
ইন্টেল
প্রযুক্তি খাতেও একই ধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট ইন্টেল বর্জনের কারণে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। মিনা নিউজ–এর হিসাবে, শুধু এ অঞ্চলের বাজারেই তাদের বার্ষিক ক্ষতি প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার।
২০২৪ সালের জুনে ইন্টেল ঘোষণা দেয়, তারা ইসরায়েলের কিরিয়াত গাত শহরে ২৫ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা স্থগিত করেছে। বর্জন আন্দোলনের কর্মীরা একে তাদের ‘সবচেয়ে বড় বিজয়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
যদিও কোনো আনুষ্ঠানিক আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ প্রকল্প স্থগিত হওয়ার ফলে ইন্টেলের বিনিয়োগ ক্ষতি কয়েক বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে।
ডমিনোজ পিজ্জা
ইসরায়েলি সেনাদের সরাসরি সহায়তা দেওয়ার অভিযোগে এশিয়ায় সুনাম হারিয়েছে ডমিনোজ পিজ্জা। এর প্রভাব পড়েছে তাদের ব্যবসায়ও।
২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে মালয়েশিয়ায় কোম্পানির বিক্রি কমেছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডমিনোজের শেয়ারের দর পড়ে গিয়ে বাজারমূল্যে ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি।
মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, বর্জনের চাপে এশিয়ার বেশ কিছু দোকান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েক দশক পর প্রথমবারের মতো বার্ষিক লোকসান দেখল কোম্পানিটি। ২০২৫ সালের জুনে তাদের ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, যা প্রায় ২ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
সূত্র: আল–জাজিরা











