গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধকে ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বলে আখ্যা দিয়েছেন দেশটির লেখক বেন কাসপিত।
ইসরায়েলি দৈনিক মা’রিভে প্রকাশিত নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, এত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও যুদ্ধের ফলাফল শুধু ‘চরম ব্যর্থতা’ই প্রমাণ করছে। তার মতে, ৯০০-র বেশি সেনা নিহত হলেও ইসরায়েল এখনো হামাসকে পরাজিত করতে পারেনি। অথচ হামাস ইসরায়েলের শত্রুদের মধ্যে সরঞ্জামের দিক থেকে তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে দুর্বল।
এই অচলাবস্থার জন্য প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকেই দায়ী করেন কাসপিত। তিনি মনে করেন, নেতানিয়াহু এখন অতিরিক্ত ডানপন্থি মন্ত্রী ইতমার বেন গাভির ও বেজালেল স্মোত্রিচের কাছে কার্যত বন্দি। এতে সেনাদের জীবন, যুদ্ধবন্দীদের ভাগ্য এবং ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক অবস্থান—সবকিছুই হুমকির মুখে পড়েছে।
সামরিক ও মানসিক পরাজয়
বেন কাসপি বলেন, গাজায় প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক ও মানসিক পরাজয় ঘটেছে। তার মতে, হামাসের মতো একটি অবরুদ্ধ ও সীমাবদ্ধ সংগঠনের বিরুদ্ধে ইসরায়েল এত বিশাল সামরিক শক্তি ব্যবহার করেও বিজয় অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে।
কাসপিত লিখেছেন, হামাসের না আছে বিমান বাহিনী, না আছে ভারী অস্ত্র বা সাঁজোয়া যান, নেই বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নৌবাহিনী কিংবা রাডার। তারা কার্যত এক সরু ও অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে বন্দি। ‘তবু যদি শক্তিশালী ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এমন একটি সংগঠনকেও পরাস্ত করতে না পারে, তবে এটিই এক কৌশলগত বিপর্যয়,’ মন্তব্য করেন তিনি।
তার ভাষায়, এ পর্যন্ত যা ঘটেছে তা এককথায় ‘পরাজয়’। হামাস হিজবুল্লাহর চেয়েও দুর্বল, ইরান বা সিরিয়ার সঙ্গে তুলনাই চলে না। তবুও ইসরায়েল তাদের সম্পূর্ণভাবে দমন করতে পারেনি।
সম্প্রতি নিহত সেনা আরিয়েল লুবলিনারের প্রসঙ্গ টেনে কাসপিত বলেন, তিনি এই যুদ্ধে নিহত ৯০০তম ইসরায়েলি সেনা। ‘এটি প্রমাণ করে, ইসরায়েল ভয়াবহ মূল্য দিচ্ছে, অথচ কোনো সাফল্য নেই,’ লিখেছেন তিনি।
তার মতে, এসব পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, নেতানিয়াহু ও তার সরকারের হাতে যুদ্ধটি এখন ‘অর্থহীন’ পর্যায়ে গড়িয়েছে। সেনারা হামাসের সামরিক কাঠামো ধ্বংস করেছে, হাজারো যোদ্ধা ও নেতাকে হত্যা করেছে। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের অভাবে বিজয় বাস্তবে রূপ নেয়নি।
কাসপিতের মতে, সমস্যা সেনাবাহিনীর সক্ষমতায় নয়, বরং নেতৃত্বের ব্যর্থতায়। তিনি অভিযোগ করেন, নেতানিয়াহু এখনো ‘চূড়ান্ত বিজয় আসেনি’ বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন—শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এবং দুর্নীতির মামলার মুখোমুখি হওয়া এড়াতে।

ইসরায়েল এখন একঘরে রাষ্ট্র
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক দাবি, ইসরায়েল এখন গাজা দখলের আন্তর্জাতিক বৈধতা পেয়েছে, তীব্রভাবে খণ্ডন করেছেন বেন কাসপিত। তার মতে, বাস্তবতা পুরোপুরি উল্টো। ইসরায়েল আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যার অবস্থান নেমে গেছে তলানিতে।
কাসপিত লিখেছেন, বিশ্বের প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। ‘এমনকি আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রেও পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। যেসব জায়গায় এত দিন ইসরায়েলি বা ইহুদি পরিচয়ে স্বস্তি নিয়ে চলাফেরা করা যেত, সেখানেও এখন অস্বস্তি বাড়ছে। এদিকে দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রক্রিয়া। দুনিয়া আমাদের দেখে ক্লান্ত,’ মন্তব্য করেন তিনি।
তার মতে, নতুন কোনো সামরিক অভিযান চালানো হলে ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক একঘরে অবস্থান আরও জটিল হবে। অথচ হামাসের হাতে আটক কয়েক ডজন বন্দিকে বাঁচাতে আংশিক বন্দি বিনিময় চুক্তি হলে অন্তত কিছুটা হলেও আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ফিরে পাওয়া সম্ভব ছিল।
কাসপিত অভিযোগ করেন, হামাসের হাতে আটক ইসরায়েলি বন্দিদের ভাগ্য নিয়েও খেলছেন নেতানিয়াহু। বন্দিদের জীবনকে তিনি নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে জিম্মি করে রেখেছেন, যেমনভাবে তিনি নিজেও চরমপন্থী মন্ত্রী ইতমার বেন গাভির ও বেজালেল স্মোত্রিচের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন।
নিজের নিবন্ধের শেষে কাসপিত লেখেন, ‘আমরা আজ নেতানিয়াহুর হাতে বন্দি, আমাদের মানুষ রয়েছে হামাসের হাতে। এই পরিস্থিতি যেন এক ধরনের বারমুডা ত্রিভুজ, যেখানে ২০২৫ সালের এই গ্রীষ্মে ইসরায়েল ভয়াবহ অচলাবস্থায় ডুবে গেছে।’
সূত্র: আল জাজিরা









