মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা: পশ্চিমাদের প্রোপাগাণ্ডা বনাম বাস্তবতা

প্রশ্ন উঠছে-আফগান সরকার কি সত্যিই নারীদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে? নাকি এর পেছনে এমন কোন বাস্তবতা আছে, যেটা পাশ্চাত্য ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছে?
আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা পশ্চিমাদের প্রোপাগাণ্ডা বনাম বাস্তবতা
আফগানিস্তানে নারী শিক্ষা: পশ্চিমাদের প্রোপাগাণ্ডা বনাম বাস্তবতা। ছবি : Ai

তালেবান আফগানিস্তানের শাসনভার গ্রহণের পর থেকেই নারীদের শিক্ষার বিষয়ে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে আফগান নারীরা ও মেয়েরা জীবনের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এ রকম বক্তব্যে পশ্চিমাদের মাতাল মিডিয়া তোলপাড়। চলুন, এই লেখায় আমরা বাস্তবতা ও প্রোপাগাণ্ডার ফারাকটা খোঁজে দেখার চেষ্টা করি।

দাবি আর বাস্তবতার ফারাক

২০০১ সালের আগে-যখন তালেবান আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে সক্রিয় ছিল

তখনও তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিপীড়ন, সহিংসতা ও অপরাধের অভিযোগের অন্ত ছিলো না। কিন্তু দখলদার আমেরিকার হামলে পড়ার পর থেকে সেই নিপীড়ন নানামাত্রিকতায় রূপ নেয়। খুন-গুম, প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, নারীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা তখন নিত্যদিনের চিত্রে পরিণত হয়।

বিশেষ করে আফগানিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা অধিদপ্তরের কারাগারে আটক নারী বন্দিদের সঙ্গে যে আচরণ করা হতো, সেটা ছিলো মানবাধিকারের চরম ও স্পষ্ট লঙ্ঘন। এসব নির্যাতনের পেছনে ছিল সিআইএ-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও প্রশ্রয়।

এসব ঘটেছে আমেরিকা ও তার মিত্রদের চোখের সামনে, অনেক সময় তাদের পষ্ট সম্মতিতেই। ‘মুক্তির’ নামে তারা আফগান নারীদের উপহার দিয়োয়ে তারায়ান অবমাননা আর অন্ধকার ভবিষ্যৎ।

কিন্তু যখন বিদেশি দখলদাররা দেশ ছোড়ে পালিয়েছে, তালেবান সরকার গঠন করেছে এবং সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে নারীদের শিক্ষাকে সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে, তখনই আমেরিকা ও তার অনুসারীরা হঠাৎ করে নারীর অধিকারের নামে চিৎকার করা শুরু করেছে।

যারা এক সময় নারীর সম্মান ও মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করেছিল-ইরাকে হোক বা আফগানিস্তানে তারা আজ বড় গলায় কথা বলছে, নারী অধিকার নিয়ে। অথচ বাস্তবতা হলো, এই অধিকার রক্ষার দাবির পেছনে রয়েছে তাদের নিজেদের স্বার্থ ও রাজনৈতিক প্রচারণা।

প্রশ্ন উঠছে-আফগান সরকার কি সত্যিই নারীদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নিয়েছে? নাকি এর পেছনে এমন কোন বাস্তবতা আছে, যেটা পাশ্চাত্য ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করছে?

‘স্থগিত’ কখনোই ‘নিষেধ’ নয় না ভাষায়, না বাস্তবে, না ব্যাখ্যায়, না প্রয়োগে। শিক্ষা একটি স্বাভাবিক ও মৌলিক প্রয়োজন। তালেবান সরকার নারীদের শিক্ষায় কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি, বরং এমন কিছু বাস্তব পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, যেগুলো জনগণের ক্ষতির কারণ হতে পারত। তাই কিছু সময়ের জন্য তারা শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্বিন্যাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও স্থায়ী ও নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।

তালেবান যখন আফগানিস্তানে সরকার গঠন করে, তখন তারা এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়, যেখানে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল দখলদার শক্তির নোংরা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার একটি প্রধান মাধ্যম। শিক্ষা-যা একটি জাতির মেরুদণ্ড-তাকে ব্যবহার করা হচ্ছিল জনগণের সুস্থ চিন্তা-চেতনা পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে।

তালেবান বুঝেছিল, শিক্ষা একটি স্বাভাবিক, সহজাত ও অপরিহার্য বিষয়। কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে কিছু অগ্রাধিকার থাকে, কিছু করণীয় সামনে আসে, যেগুলো মেনে পথ চলতে হয়।

যখন আমেরিকা আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করে, তখন তাদের লক্ষ্য শুধু সামরিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই ছিল না বরং সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারও ছিলো তাদের টার্গেট। তারা সরকারের ক্ষমতা দখলের পাশাপাশি পাঠ্যক্রমেও হাত দেয়। পরিবর্তনের নামে বাদ দেওয়া হয় এমন সব বিষয়, যেগুলো আফগানদের ইসলামি পরিচয়, সংস্কৃতি ও প্রতিবোধচেতনার সঙ্গে জড়িত।

তার বদলে ঢোকানো হয় এমনসব ধারণা, যেগুলো ছিল দেশের সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ-যেমন বিকৃত নারীবাদ, লিঙ্গ সমতা নিয়ে অতিরঞ্জিত দৃষ্টিভঙ্গি, এমনকি এমন শিক্ষাও যা নারী-পুরুষের সহজাত পার্থক্য মুছে দিতে চায়।

এই ছিল দখলদারদের প্রকৃত যুদ্ধ-মানসিক দখলদারির যুদ্ধ। শুধু ভূখণ্ড নয়, তারা চেয়েছিল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তা, মূল্যবোধ, বিশ্বাস সবকিছু নিজেদের মত করে গড়ে তুলতে।

কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। আফগান জনগণ নিজেদের শিকড় এত দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরেছিল যে, বিদেশি চিন্তাধারার আগ্রাসন তাদের মনোজগতে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

ফলে তালেবান সরকার দায়িত্ব নিয়েই সিদ্ধান্ত নেয় পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর। আর তাই সাময়িকভাবে কিছু কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়, যেন ইসলামি মূল্যবোধ ও জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে একটি স্থায়ী, সুগঠিত পাঠ্যক্রম গড়ে তোলা যায়।

এটা কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়-এটা একটি গঠনমূলক প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো এটাকে ভুলভাবে তুলে ধরছে, ‘মানবাধিকার’ আর ‘নারীর স্বাধীনতা’র স্লোগানে।

তারা প্রশ্ন তোলে-মেয়েদের শিক্ষাই বন্ধ কেন? কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজও অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত নিয়মিত পড়াশোনা করছে।

আসলে সমস্যা শুধু ছেলেমেয়ের একসঙ্গে বসে পড়া নয়। বড় সমস্যা হলো সেই পাঠ্যক্রম, যা তাদের স্বভাবগত পার্থক্যকে অস্বীকার করে, তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিচয়ের সঙ্গে যায় না।

তালেবান এখন চেষ্টা করছে এই বিকৃত পাঠ্যক্রমকে সংস্কার করতে। এ কাজ সময়সাপেক্ষ, প্রয়োজন ধৈর্য ও বিস্তৃত পরিকল্পনার। ছোট ছোট মেয়েদের জন্য এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলাই এখন মূল লক্ষ্য, যা তাদের পরিচয় ও বিশ্বাসের সঙ্গে খাপ খায় এবং ভবিষ্যতে একটি সুস্থ ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে।

এই প্রক্রিয়াটিই এখন চলমান, আর এটাই সেই ‘স্থগিতাদেশ’-এর পেছনের প্রকৃত সত্য।

তরুণ-তরুণীদের একসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া নিয়ে যখন বিতর্ক তৈরি হয়, তখন বিষয়টি কেবল সামাজিক নয়-ধর্মীয় ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। শরিয়তের মূলনীতির আলোকে বহু মুসলিম দেশে ছেলেমেয়েদের জন্য পৃথক শিক্ষাব্যবস্থা চালু রয়েছে। মিশর এর অন্যতম উদাহরণ, যেখানে আল-আযহারের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা আলাদা পরিবেশে পড়াশোনা করে।

এই পৃথক শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি-ইসলামি মূল্যবোধ ও নৈতিকতা রক্ষা। বয়ঃসন্ধিকালে তরুণ-তরুণীরা যে সংবেদনশীল সময় পার করে, সেখানে মিশ্র শিক্ষাব্যবস্থা তাদের আত্মিক পরিশুদ্ধতা, আবেগ ও আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। ফলে আলাদা পরিবেশে শিক্ষা প্রদান কেবল ধর্মীয় নয়, মনস্তাত্ত্বিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন গবেষণাও এই ধারনাকে সমর্থন করেছে। জার্মানির বন শহরে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মিশ্র বিদ্যালয়ের তুলনায় পৃথক বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সৃজনশীলতা অপেক্ষাকৃত কম। আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে, মেয়েরা যখন ছেলেদের থেকে আলাদা থাকে, তখন তাদের মনোযোগ ও ফলাফল উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো হয়। এমনকি মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-ও এক প্রতিবেদনে স্বীকার করেছে, যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত একটি গবেষণায় পৃথক শিক্ষাব্যবস্থার ইতিবাচক দিক উঠে এসেছে।

এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে, যারা ইসলামি ব্যবস্থার বিরোধিতা করে, তারা কি সত্যিই বুক্তি ও বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে? ইসলাম যে সামাজিক ও মানসিক ভারসাম্য বজায় রেখে পৃথক শিক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়, তা কেবল একটি ধর্মীয় নির্দেশনা নয়, বরং মানবিক আচার-আচরণের গভীর অন্তর্দৃষ্টি থেকেও উৎসারিত।

আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি এর প্রমাণ। দেশটিতে এখন কয়েকটি নারী-বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে, যেখানে প্রায় তিন হাজারের বেশি ছাত্রী পড়ছে। এসব প্রতিষ্ঠান আফগান সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুসারে পরিচালিত হয়। তারা আমেরিকান বা পশ্চিমা কোনো শিক্ষামডেল অনুসরণ করে না। তালেবান সরকার বলছে, তারা এখন এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা গঠনের পথে এগোচ্ছে, যা সমাজের মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

নতুন সরকার গঠনের পর দেশটির প্রশাসন শিক্ষা, নিরাপত্তা, পররাষ্ট্র এবং অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে একযোগে কাজ করছে। মেয়েদের শিক্ষাকে আপাতত স্থগিত রাখা হলেও, দ্রুতই একটি পূর্ণাঙ্গ, সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে। যেখানে দক্ষ শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, কাঠামোগত প্রস্তুতি ও মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষাদানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

সরকার বলছে, অচিরেই মেয়েরা আবার স্কুলে ফিরবে এমন এক পাঠক্রমের আওতায়, যা তাদের ধর্মীয় জ্ঞান ও আধুনিক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা দুই-ই দেবে। শিক্ষা হবে এমন, যা তাদের মেধা ও মনন গঠনে সহায়ক হয়, একইসঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় বিভ্রান্তি থেকেও রক্ষা করে।

সবশেষে প্রশ্ন রয়ে যায়-যারা আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে এগিয়ে চলেছে, তারা কি কখনো কুরআনের সেই প্রথম আয়াত– أَقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ পড়ো, তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন -এর বিপরীত কাজ করবে? বরং তারা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়, যা ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষা করে মেয়েদের সত্যিকারের শিক্ষিত করে তুলবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো এই প্রচেষ্টার ফল স্পষ্ট হয়ে উঠবে, ইনশাআল্লাহ।

সর্বশেষ