সম্প্রতি গত জুনের ২২ তারিখ সিরিয়ার ‘মার ইলিয়াস’ গির্জায় ভয়াবহ বোমা হামলায় ২৫ খ্রিস্টান নাগরিক নিহত হওয়ার পর জড়িত আইএসের একটি গোপন সেলকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে সিরিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একইসাথে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃত সেলটির নেতৃত্বে ছিলেন ‘ওয়ালিউস সাহরা’ বা মরুভূমির নেতা হিসেবে খ্যাত আইএস কমান্ডার আব্দুল ইলাহ জুমাইলি। যার বসবাস দামেশকের গ্রামাঞ্চল ‘হাজরুল আসওয়াদে’।
মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সেলটি দামেশকের গ্রামাঞ্চল ‘সাইয়েদা যাইনাবের’ পবিত্র মাজার লক্ষ্য করে নতুন হামলা করতে যাচ্ছিল। তবে সেলটিকে গ্রেপ্তার করে সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিয়েছে সিরিয়া প্রসাশন ।
এই ঘটনা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আইএস সিরিয়ায় আরও হামলার পরিকল্পনা করছে। যাতে কেবল গির্জাই নয়, বরং এর অংশ হতে পারে সিরিয়ার বিস্তির্ণ অঞ্চল। কারণ, এর আগে আইএস কতৃক হিমস ও সুয়েইদা প্রদেশে সরকারি বাহিনীর ওপরও হামলার ঘটনাও ঘটেছে।
শহরাঞ্চলে বাড়ছে আইএস-এর কার্যক্রম
সিরিয়ার নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের শুরু থেকেই আইএস একটি কৌশলগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। এবং সেই লক্ষ্যে তারা দেশটির বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চল ছেড়ে বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। বিশেষত দেইর আয-জোর, হোমস, আলেপ্পো এবং দামেস্কের গ্রামীণ এলাকায়। এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ ছিল—সিরিয়ান সরকারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তৈরি হওয়া শূন্যতা, যেটাকে আইএস তাদের সংগঠনের পুনর্গঠনের জন্য একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে।
তাছাড়া শহরাঞ্চলে উপস্থিতি তাদের জন্য একাধিক সুবিধা বয়ে আনছে, যেমন—আন্তর্জাতিক জোটের বিমান হামলার আওতার বাইরে থাকা (যা মূলত বেদুইন অঞ্চলগুলোতেই সীমাবদ্ধ), এবং জনবহুল এলাকার নিকটে থেকে জনসাধারণ-বিশেষত যুবকদের মধ্যে প্রচারণা ও সদস্য সংগ্রহ করা। এক্ষেত্রে আসাদ সরকারের সকল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়াকে কেন্দ্র করে যুবকদের মনে জমা হওয়া অসন্তোসকে কাজে লাগাচ্ছে আইএস। যেই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ২০২৫ সালের জুন মাসে হামা শহরের একাধিক বিক্ষোভে।
সঙ্কটের আরেক কারণ আল-হোল শিবির
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি অনুযায়ী, দামেস্কের মার এলিয়াস গির্জায় বিস্ফোরণ ঘটানো দলটি এসেছিল সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস (এসডিএফ) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হাসাকা প্রদেশের বিখ্যাত আল-হোল শরণার্থী শিবির থেকে। উল্লেখ্য, বহু আগে থেকেই এই শিবিরটিতে শত শত প্রাক্তন আইএস সদস্য ও তাদের পরিবার রয়েছে। যদিও ২০২৫ সালের জুন মাসে একটি প্রাথমিক চুক্তির মাধ্যমে এই শিবির সিরিয়ান সরকারের হাতে হস্তান্তরের পরিকল্পনা হয়েছিল, যা আন্তর্জাতিক জোটের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল, তারপরও এসডিএফ এখনো শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি।
তাছাড়া এর আগে মে মাসে আলেপ্পো শহরে যে সেলটি ধরা পড়েছিল, তার সদস্যরাও এসেছিল সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে।
ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে বাড়ছে নিরাপত্তা শঙ্কা
এদিকে ২০২৫ সালের মার্চ মাস থেকে
ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কারণ, ইরাক আশঙ্কা করছে যে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার নিরাপত্তা দুর্বলতার সুযোগে আইএস সদস্যরা তাদের দেশে প্রবেশ করতে পারে। এই কারণেই ইরাক সম্প্রতি সিরিয়ার সঙ্গে নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়িয়েছে। আর ইরাকি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান হামিদ আল-শাতিকে প্রথমে এবং পরে রাজনৈতিক প্রতিনিধি ইজ্জত আল-শাবান্দার-কে সিরিয়ায় পাঠানো ছিল তারই একটি অংশ।
একই সময়ে ইরাক সরকার আল-হোল শিবিরে আটক থাকা ১৫,০০০ এর বেশি ইরাকি নাগরিককে ফেরত আনার চেষ্টা করছে, যাদের বেশিরভাগই আইএস-এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
কারাগারেও চলছে আইএসের পুনর্গঠন
অপরদিকে আইএস সদস্যদের অনেকেই এখনো এসডিএফ-এর কারাগারে বন্দী থাকলেও যুক্ত রয়েছে তারা সংগঠনের সঙ্গে। গবেষক সুবহি ফারাঞ্জিয়ার প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বন্দী এইসকল আইএস সদস্যরা কারাগারে অবস্থানকালে নিজেদের পুরনো কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করছে এবং ভবিষ্যতের জন্য নতুন কৌশল তৈরি করছে। তাদের মূল লক্ষ্য এখন সিরিয়ার সরকারকে টার্গেট করা। তারা মনে করে, সরকার পশ্চিমা দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এবং পূর্ণাঙ্গ শরিয়া পালন করছে না। একইসাথে তরুণদের মধ্যেও বিশেষভাবে চালিয়ে যাচ্ছে এর প্রচারণা।
উল্লেখ্য, বর্তমানে সিরিয়ায় এসডিএফ পরিচালিত ২৬টি কারাগারে ১০,০০০ এরও বেশি বন্দী আছে। এবং এসব বন্দীদের বেশগিরভাগই হচ্ছে সিরিয়া, ইরাকসহ বিভিন্ন আরব ও পশ্চিমাদেশের নাগরিক। অভিযোগ আছে এসব কারাগারে বন্দীদের উপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি রয়েছে বাইরে যোগাযোগের সুযোগ।
তবে সম্প্রতি মার এলিয়াস গির্জায় হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সরকার জোর দিয়ে বলেছে—এই ধরনের হামলা প্রতিরোধ করতে হলে, সিরিয়ান সরকারের হাতে কারাগারগুলোর নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, শুধুমাত্র এসডিএফ-এর হাতে বন্দীদের রাখা নিরাপদ নয়।
সামনে রয়েছে আরও হামলার শঙ্কা
সিরিয়া ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জুসুর স্টাডিজ সেন্টার-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এই হামলা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি হতে পারে বড় ধরনের একটি ধারাবাহিক হামলার সূচনা। উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ২০১২ সালে ইরাকে একদিনে সংঘটিত ৩০টি হামলার উদাহরণ দিয়েছে—যার মধ্যে অনেকগুলোর লক্ষ্য ছিল গির্জা ও বিভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়।
প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, এই ধরনের হামলার লক্ষ্য হলো—জনমনে আতঙ্ক তৈরি করে সরকারি স্থিতিশীলতা নস্যাৎ করা, জনগণের আস্থা নষ্ট করা এবং সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক দুর্বল করা।
উল্লেখ্য, মে মাসে আইএস-এর একটি মুখপত্রে সরকারবিরোধী হুমকি প্রকাশ পায়। ফলশ্রুতিতে তখন থেকেই সিরিয়া এক আঞ্চলিক সমন্বয় কাঠামোতে যোগ দেয়, যেখানে তুরস্ক, ইরাক, লেবানন, জর্ডান এবং যুক্তরাষ্ট্রও অংশ নিচ্ছে। যা আইএস-এর চরমপন্থী অবস্থানকে আরও উত্তেজিত করেছে।
কৌশল পুনর্গঠন করছে আইএস
সম্প্রতি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষক সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ তাদের এক বিশ্লেষণে বলেছে—২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে আইএস-এর হামলার সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসলেও এটি মূলত কোন দুর্বলতার প্রতীক নয়—বরং আইএস আসলে নতুনকরে কৌশল সাজাচ্ছে।
অন্যান্য বিশ্লেষকদের মতেও ২০২৪ সালের শেষ দিকে আসাদের পতনের পর আইএস আবারও সক্রিয় হয়েছে। তাদের কিছু সেল এখন সাইলেন্সার যুক্ত রাইফেল, স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি বিস্ফোরক ব্যবহার করে টার্গেট নির্ধারণ করছে। ধারণা করা হয়, তারা পতিত আসাদ বাহিনীর কিছু অস্ত্রও হাতিয়ে নিয়েছে।
সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাকে পুঁজি বানাচ্ছে আইএস
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও ধর্মীয় অবমাননার ঘটনাকে প্রচারণার কাজে লাগাতে চাইছে আইএস। যেমন, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে উপকূলীয় এলাকায় একটি হামলার পর সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন, সিরিয়ান জনগণ এখন দীর্ঘ যুদ্ধ ও সংকটে ক্লান্ত। তারা স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও দেশ পুনর্গঠনে বেশি জন্য আগ্রহী—যা আইএসের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
সূত্র: আল জাজিরা