যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ যখন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পায়, তখন কেবল বিনিয়োগের দরজাই খোলে না, উঠে দাঁড়ায় কিছু গভীর ও জটিল প্রশ্নও। দশ বছর ধরে চলা ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়াকে কীভাবে পুনর্গঠন করা সম্ভব? আর তা এমনভাবে যাতে অতীতের ভুলগুলি আর কখনও পুনরাবৃত্তি না হয়?
সিরিয়ার আজ শুধু রাস্তা, সেতু বা ভবন পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন নেই, প্রয়োজন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো, যা একটি আধুনিক রাষ্ট্রের ভিত্তি তৈরি করবে।
জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, রুয়ান্ডা বা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস বলে যে পুনর্গঠনের কোনো সহজ সমাধান নেই। কিন্তু তারা প্রমাণ করেছে ধ্বংসস্তূপ থেকেও আবার উঠে দাঁড়ানো সম্ভব, যদি জনগণের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছাশক্তি থাকে এবং নেতৃত্বের কাছে সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। আসল পুনর্গঠন শুধু অর্থ দিয়ে শুরু হয় না, এটি শুরু হয় সংস্কার, শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গঠন এবং জাতীয় ঐকমত্য দিয়ে।
ব্যর্থতার গল্প: বিভক্তি, দুর্নীতি ও ভুল নীতির ফল
ইরাক: অর্থ থাকলেও পুনর্গঠন হয়নি
২০০৩ সালে মার্কিন আক্রমণের পর ইরাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রকৃত পুনর্গঠন কখনই সম্ভব হয়নি। জাতীয় ঐক্যের অভাব, শিয়া-সুন্নি বিভেদ এবং বিদেশি মিলিশিয়াদের প্রভাব ইরাককে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। দুর্নীতি ও জবাবদিহিতার অভাব প্রশাসনকে দুর্বল করে দেয়। ফলে পুনর্গঠনের নামে যা করা হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত দেশকে আরও বিভক্ত করেছিল।
লেবানন: উন্নয়নের চেয়ে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বড় হয়ে দাঁড়ায়
লেবাননের গৃহযুদ্ধের পর প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির নেতৃত্বে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে লেবাননের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় সিরিয়ার গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যাপক হস্তক্ষেপ ছিল। হারিরি অবকাঠামো নির্মাণে জোর দিয়েছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হন। ফলে লেবাননের পুনর্গঠন প্রকল্প শেষ পর্যন্ত টেকসই হয়নি, এবং দেশটি আবারও সংকটে পড়ে।
এই উদাহরণগুলো থেকে স্পষ্ট, ন্যায়বিচার, জবাবদিহি এবং জাতীয় ঐক্য ছাড়া পুনর্গঠন প্রকল্প কখনই স্থায়ী হয় না।
সাফল্যের গল্প: ঐক্য, নেতৃত্ব ও জনগণের শক্তি
রুয়ান্ডা: গণহত্যার পরেও আবার উঠে দাঁড়ানো
১৯৯৪ সালের ভয়াবহ গণহত্যার পর রুয়ান্ডা প্রতিশোধের পথে না গিয়ে পুনর্মিলনের পথ বেছে নেয়। তারা স্থানীয় ‘গাচাচা’ আদালত ব্যবস্থা তৈরি করে, যার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনা হয়। শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করে রুয়ান্ডা আজ আফ্রিকার অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে।
জার্মানি: যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে অর্থনৈতিক শক্তিতে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি মার্শাল প্ল্যানের সহায়তা পেয়েছিল, কিন্তু সত্যিকারের সাফল্য এসেছিল জার্মান নেতৃত্বের সঠিক পরিকল্পনা ও সংস্কারের কারণে। স্থানীয় সরকারগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, একটি দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল এবং জনগণকে উন্নয়নের কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল।
দক্ষিণ কোরিয়া: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে বিশ্বশক্তি
১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধের পর দক্ষিণ কোরিয়া ছিল ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু শিক্ষা, প্রযুক্তি ও রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের মাধ্যমে তারা আজ বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। তাদের সাফল্যের মূল ছিল জনগণের দক্ষতা উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
এই দেশগুলো প্রমাণ করেছে—বাইরের সাহায্য কখনই স্থায়ী সমাধান নয়। সত্যিকারের উন্নয়ন আসে অভ্যন্তরীণ সংস্কার, সুশাসন এবং জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের আস্থার সম্পর্ক থেকে।
সিরিয়ার জন্য পুনর্গঠনের রোডম্যাপ
সিরিয়া যদি জার্মানি বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সাফল্য পেতে চায়, তাহলে চারটি মূল স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে এগোতে হবে:
১. একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী পুনর্গঠন কর্তৃপক্ষ
একটি স্বাধীন সংস্থা গঠন করতে হবে, যার হাতে থাকবে পূর্ণ নির্বাহী ক্ষমতা। এটি অবশ্যই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে, যাতে পুনর্গঠনের তহবিল সঠিকভাবে ব্যয় হয়।
২. জাতীয় ঐক্য ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা
গৃহযুদ্ধের ক্ষত শুকাতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ প্রয়োজন। সব গোষ্ঠী ও ভুক্তভোগীদের অংশগ্রহণে একটি ন্যায়বিচারভিত্তিক প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।
৩. উৎপাদনমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কৃষি সংস্কার এবং কারিগরি শিক্ষায় বিনিয়োগ করে টেকসই অর্থনৈতিক ভিত্তি তৈরি করতে হবে।
৪. সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে বৈদেশিক সহায়তা নেওয়া
বিদেশি বিনিয়োগ ও সাহায্য গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা যেন সিরিয়ার স্বাধীনতাকে প্রভাবিত না করে। রাষ্ট্রীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
সিরিয়ার সামনে দুটি পথ
সিরিয়া আজ একটি ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে। একদিকে রয়েছে রুয়ান্ডা, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো সাফল্যের গল্প—যেখানে যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব হয়েছে। অন্যদিকে রয়েছে ইরাক ও লেবাননের মতো ব্যর্থতার উদাহরণ—যেখানে পুনর্গঠনের নামে শুধু বিভক্তি ও অস্থিতিশীলতা বেড়েছে।
ইতিমধ্যে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা শিথিল হচ্ছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ এখনও বাকি:
- উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার পূর্ণ পুনর্গঠন
- সামরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সংস্কার
- একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ সংসদ প্রতিষ্ঠা
এগুলোই জাতীয় স্থিতিশীলতার মূল ভিত্তি। এখন প্রশ্ন হলো—সিরিয়ার নেতৃত্ব কি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পারবে? বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ শারা কি এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবেন?
এটি কেবল ধ্বংসস্তূপ সারানোর সময় নয়—এটি ইতিহাসকে নতুন করে লেখার সুযোগ। পুনর্গঠন মানে শুধু ভবন তৈরি নয়—এটি একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার সাহসিকতা।
সূত্র: আল জাজিরা