মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

আহমদ আশ শারা কি ট্রাম্পের দাবিগুলো পূরণ করতে পারবে?

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—দামেস্ক যেন এমন একটি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি দেখায়, যা থেকে বোঝা যায়, সিরিয়া তার কথার প্রতি আন্তরিক এবং শারাকে একটি বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
আহমদ আশ শারা কি ট্রাম্পের দাবিগুলো পূরণ করতে পারবে?
আহমদ আশ শারা কি ট্রাম্পের দাবিগুলো পূরণ করতে পারবে?

২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর, সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের সঙ্গে এক প্রাথমিক বৈঠক শেষে ওয়াশিংটনে ফিরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বারবারা লিভ বলেছিলেন, তিনি আহমদ আশ-শারাকে একজন ‘বাস্তববাদী’ নেতা হিসেবে দেখেছেন। লিভের ভাষায়, শারার কথাবার্তায় এসেছে ‘অত্যন্ত পরিমিত ও বাস্তবমুখী’ মনোভাব। তিনি মনে করেন, সিরিয়ায় এখন দেশকে নতুনভাবে গড়ে তোলার এক বিরল সুযোগ এসেছে। এই সফরেই তিনি শারাকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার মাথার ওপর ঘোষিত এক কোটি ডলারের পুরস্কার তুলে নিচ্ছে—যে পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল শারা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে।

এর ঠিক পরদিনই, ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দিন, সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট শারা এক অভিনন্দন বার্তা পাঠান। সেখানে তিনি লেখেন, আরব সিরিয়া প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্ব ও জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। ওই বার্তায় ট্রাম্পকে নিয়ে খানিকটা অতিরিক্ত প্রশংসাও করেন তিনি। বলেন, ট্রাম্প এমন এক নেতা যিনি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনবেন এবং পুরো অঞ্চলটিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দেবেন। বার্তায় শারা আশা প্রকাশ করেন, দুই দেশের মধ্যে সংলাপ ও বোঝাপরার ভিত্তিতে সম্পর্ক উন্নয়ন সম্ভব এবং এমন একটি অংশীদারিত্ব গড়ে উঠতে পারে যা উভয় দেশের স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে প্রতিফলিত করবে।

তবে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে এ চিঠির কোনো জবাব আসেনি। বরং, নতুন সিরীয় সরকারের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের মনোভাব ছিল সতর্ক এবং খানিকটা দ্ব্যর্থপূর্ণ। কারণ তখনো ট্রাম্প প্রশাসন স্পষ্টভাবে ঠিক করে উঠতে পারেনি, সিরিয়া বিষয়ে তাদের কৌশল কী হবে। পাশাপাশি, ইসরায়েলের অবস্থান এবং তাদের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত উদ্বেগগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলেছে।

জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের একাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা—যেমন গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড এবং সন্ত্রাসবিরোধী শাখার প্রধান সেবাস্টিয়ান গোরগা—সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগের ঘোর বিরোধিতা করছেন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সিরিয়ার নতুন শাসকদের অতীত এখনও ‘হায়াত তাহরির আশ-শাম’ এবং অন্যান্য জিহাদি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ফলে তারা সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিকে এখনো সন্ত্রাসবাদের চশমায় দেখে যাচ্ছেন।

এই দ্বিধা আর অনিশ্চয়তার মধ্যেই প্রশ্ন উঠছে—আহমদ আশ-শারা কি পারবেন ট্রাম্প প্রশাসনের মন জুগিয়ে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া আদায় করতে?

যুক্তরাষ্ট্রের আট শর্তে সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা শিথিলের ইঙ্গিত

গত ১৮ মার্চ ব্রাসেলসে সিরিয়া বিষয়ক সম্মেলনের ফাঁকে, মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দপ্তরের সহকারী উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী নাতাশা ফ্রানচেস্কি একটি গুরুত্বপূর্ণ তালিকা তুলে দেন সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদ আশ-শাইবানির হাতে। একটি ব্যক্তিগত বৈঠকে দেওয়া ওই তালিকায় আটটি শর্তের কথা উল্লেখ ছিল—যেগুলো পূরণ হলে সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি দু’বছরের জন্য একটি বিশেষ লাইসেন্স দেওয়ার কথাও ছিল আলোচনায়।

এই আটটি শর্তে যা যা ছিল—

  • ফিলিস্তিনি সব গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর প্রকাশ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা
  • যুক্তরাষ্ট্র যাকে হুমকি মনে করবে, তাকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর স্বাধীনতা দেওয়া
  • ইরানের ‘রেভল্যুশনারি গার্ড’ ও লেবাননের ‘হিজবুল্লাহ’কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করা
  • সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্রের অবশিষ্ট মজুত ধ্বংসে আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করা
  • বিদেশিদের সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আসা ঠেকানো
  • আন্তর্জাতিক জোটের সঙ্গে যৌথভাবে আইএসবিরোধী লড়াইয়ে অংশ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি
  • সিরিয়ায় নিখোঁজ মার্কিন নাগরিকদের সন্ধানে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন
  • সিরিয়ার ভেতরে ‘হোল ক্যাম্পে’ থাকা আইএস পরিবারের সদস্যদের হেফাজতে নেওয়া

এই প্রস্তাবগুলো মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে সিরিয়ার আনুষ্ঠানিক সংলাপের সূচনা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও সিআইএ এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে। তাদের যুক্তি—ইরানের প্রভাব হ্রাস ও মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই এর মূল লক্ষ্য।

সিরিয়া এই প্রস্তাবের জবাব দিতে দেরি করেনি। ১৪ এপ্রিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাইবানির স্বাক্ষরে একটি চিঠি পাঠায় যুক্তরাষ্ট্রে, যাতে জানানো হয়—ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম নজরদারিতে রাখতে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে সিরিয়ার মাটিতে কাজ করতে দেওয়া হবে না বলেও জানানো হয়। চিঠিতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়ার ভেতর থেকে কোনো হামলা চালাতে না দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও ছিল। পাশাপাশি রাসায়নিক অস্ত্র ধ্বংসে অগ্রগতি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার কথাও জানানো হয়।

চিঠিতে কিছু শর্ত আংশিকভাবে মেনে নেওয়ার ইঙ্গিতও ছিল। যেমন, সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে বিদেশিদের আর কোনো পদোন্নতি বা নেতৃত্বের পদ না দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে কিছু বিষয়ে সার্বভৌমত্ব রক্ষার শর্তে সতর্কতা ছিল। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রকে সন্ত্রাসবিরোধী হামলার অনুমতি দেওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক জোটকে সিরিয়ার মাটিতে অবাধে চলাফেরার বিষয়গুলোতে সরাসরি সম্মতি দেয়নি দামেস্ক।

তবে যুক্তরাষ্ট্র এই চিঠিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবেই দেখেছে। তারা মনে করছে, নিষেধাজ্ঞা শিথিলের প্রক্রিয়ায় এটি একধাপ অগ্রগতি।

এই চিঠি পাঠানোর কিছুদিন পরই সিরিয়া ইসলামিক জিহাদের কয়েকজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ছিল শাইবানির নিউইয়র্ক সফরের প্রস্তুতির অংশ। ওই সফরে তিনি জাতিসংঘ ও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকও করেন।

ট্রাম্পের দাবিসমূহ

সিরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক মিত্রদের ব্যাপক তৎপরতার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দামেস্কের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ার ইঙ্গিত দেয়। দীর্ঘদিনের এই প্রচেষ্টা যখন প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন চলতি মে মাসের ১৩ তারিখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর থেকে সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। সিরীয় জনগণের জন্য এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যা তারা গভীর উচ্ছ্বাসে গ্রহণ করে।

এই ঘোষণা পরদিনই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট শারার সঙ্গে বৈঠক করেন সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত ছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। হোয়াইট হাউসের বিবৃতি অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট শারার প্রতি প্রশংসা জানিয়ে ট্রাম্প পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন—

১. ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তিতে সিরিয়ার যোগদান।
২. সিরিয়া থেকে সব বিদেশি সন্ত্রাসীকে বের করে দেওয়া।
৩. ফিলিস্তিনের প্রতিরোধকামীদের বিতাড়ন।
৪. ইসলামিক স্টেটের পুনরুত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা।
৫. উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আইএস সংশ্লিষ্ট বন্দিশিবিরগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ।

এই দাবিগুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, আগের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও জোরালো ও প্রত্যাশা-নির্ভর হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও দামেস্কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার মতো বড় সিদ্ধান্তের বিনিময়ে ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট শারার কাছ থেকে কিছু কৌশলগত প্রতিশ্রুতি আদায় করতে চায়—যা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ।

দাবিগুলোর একটি অংশ এসেছে সিরিয়ার পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে গড়িমসি ও অনিশ্চিত অবস্থানের প্রতিক্রিয়ায়। আরেক অংশের লক্ষ্য, ইরানের প্রভাব প্রতিহত করা এবং সন্ত্রাসবাদ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করা। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়টি হলো—ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর, যা মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন আনতে পারে।

ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর বহিষ্কার: কঠিন চাপে সিরিয়া

ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি কঠোর। মূলত হামাস, ইসলামিক জিহাদ এবং পিএফএলপি (পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন)-কে লক্ষ্য করেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, এবার তাদের সিরিয়া থেকে পুরোপুরি বের করে দেওয়ার বিষয়েও জোর দিচ্ছে ওয়াশিংটন।

সিরিয়া থেকে ইসরায়েলের ওপর যাতে কোনো হামলা না হয়—তা নিশ্চিত করতে আগে থেকেই একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি কাজ করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এতেই সন্তুষ্ট নয়। তারা চায়, সিরিয়ার ভেতর কোনো ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর কোনো রকম অস্তিত্বই যেন না থাকে। রাজনৈতিক শাখার হোক বা সামরিক, কেউই না।

এই পরিস্থিতিতে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আশ-শারার সামনে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা অর্জনের চেষ্টায় থাকা শারার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। কারণ, ফিলিস্তিন ইস্যুটি শুধু সিরিয়ার জনগণের আবেগের সঙ্গে নয়, শারার নিজের সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত। সিরিয়া বিপ্লব সফল হওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় সব সাক্ষাৎকারেই তিনি ফিলিস্তিনের কথা বলেছেন।

এর পাশাপাশি, ফিলিস্তিন প্রশ্নটি শুধু একটি রাজনৈতিক ইস্যু নয়—এটি আরব ও মুসলিম বিশ্বসহ সমগ্র মানবতার এক গভীর আবেগের অংশ। তাই দখলদারবিরোধী ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে ফিলিস্তিন ইস্যু থেকে আলাদা করে দেখা প্রায় অসম্ভব।

বিকল্প সংকীর্ণ, সম্ভাবনা কূটনীতিতে

শারার হাতে বিকল্প খুব বেশি নেই। এই সংকট থেকে সম্মানজনকভাবে বেরিয়ে আসতে হলে তাঁকে আবারও আঞ্চলিক মিত্রদের দ্বারস্থ হতে হবে। বিশেষ করে তুরস্ক ও কাতার—যারা অতীতেও ফিলিস্তিনি নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে।

গত কয়েক মাসে অনেক ফিলিস্তিনি নেতা সিরিয়া ছেড়ে গেছেন—কখনও ইসরায়েলি হামলার ভয়ে, কখনও সিরিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি না করার বাসনা থেকে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া যখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন এসব গোষ্ঠীর উপস্থিতি অনেক সময় তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

তবে আশার বিষয় হলো—এই গোষ্ঠীগুলোর লেবাননে এখনো অফিস আছে, এবং সেখানে তারা কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। ফলে ফিলিস্তিনের কাছাকাছি থেকেই নিজেদের কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার মতো একটি কৌশলগত সুযোগ এখনো তাদের সামনে খোলা আছে।

আব্রাহাম চুক্তিতে যোগদানের প্রতিশ্রুতি: কৌশলের মাঠে এক নতুন চাল

হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে যেসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে, তার মধ্যে শীর্ষে ছিল—ইসরায়েলের সঙ্গে আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষরের আহ্বান। এই চুক্তি মূলত একটি পূর্ণাঙ্গ শান্তি ও সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি, যেখানে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো কেবল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেই সম্মত হয় না, বরং একে অপরের বিরুদ্ধে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহারের সুযোগও বন্ধ করে দেয়।

বৈঠকে শারা ১৯৭৪ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন—এই তথ্য হোয়াইট হাউজের বিবৃতিতে ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি শারাকে স্পষ্টভাবে চাপ দেন যেন তিনি আব্রাহাম চুক্তিতে সই করার প্রতিশ্রুতি দেন। শারাও এতে সম্মত হন।

তবে চুক্তিতে সই করা এখনই সম্ভব এমনটা নয়। কারণ শারা এই মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান, যাঁর ক্ষমতা সীমিত, এবং তিনি নির্বাচিত নন। এমন গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির জন্য একটি নির্বাচিত পার্লামেন্টের উপস্থিতি প্রয়োজন। তাছাড়া দখলকৃত ভূখণ্ডের বিষয়টিও বড় এক বাধা। শারা এখনই এসব জমি ছাড় দেওয়ার অধিকার রাখেন না। এতে জনসমর্থনেও ভাটা পড়তে পারে। কারণ, গোলান মালভূমির প্রশ্নটা আগের আসাদ সরকারের বৈধতা নিয়ে বড় বিতর্ক তৈরি করেছিল।

তবে শারার প্রতিশ্রুতি নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমার সাথে নির্ধারিত নয়। ফলে একে কৌশলগতভাবে দেখার সুযোগ রয়েছে। দেশ স্থিতিশীল রাখা, নিজের অর্জিত রাজনৈতিক বৈধতা ধরে রাখা এবং ভবিষ্যতের জন্য দরজা খোলা রাখা—সব মিলিয়ে এই প্রতিশ্রুতি শারার জন্য একটা কৌশলগত চাল। রাজনীতিতে কখনও কখনও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়, কিন্তু সময় নির্ধারিত না থাকায় এই প্রতিশ্রুতি শারাকে খেলাটা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ দিচ্ছে।

ওয়াশিংটনও বুঝে, এটি একদিনে বাস্তবায়নের মতো কোনো সহজ বিষয় নয়—ইভেন শরা চাইলেও। এখন পর্যন্ত এটাকে একটি কৌশলগত অভিমুখ হিসেবে দেখাই বাস্তবসম্মত। এর ফলে অন্তত এমন ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে যাতে চুক্তি-পক্ষগুলো নিজেদের ভূখণ্ড অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে না দেয়।

ট্রাম্পের এই আগ্রহের পেছনে আরেকটি কারণও থাকতে পারে—সিরিয়ায় ইসরায়েলের লাগাতার বিমান হামলা বন্ধ করানো। সিরিয়া বহুবার দাবি করেছে, এসব অব্যাহত আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। এই দাবিতে শারার মিত্ররাও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করেছে। কারণ, নেতানিয়াহুকে থামানোর ক্ষমতা একমাত্র ওয়াশিংটনেরই আছে, বিশেষ করে যখন ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের টানাপোড়েন দেখা যাচ্ছে।

সব মিলিয়ে আব্রাহাম চুক্তি নিয়ে শারার প্রতিশ্রুতি এখনই বাস্তবায়নের দিকে যাচ্ছে না, তবে এটি একটি কৌশলগত অবস্থান, যার মাধ্যমে তিনি সময় নিচ্ছেন এবং দরকষাকষির জায়গাটা ধরে রাখছেন।

সন্ত্রাসবিরোধী তালিকাভুক্ত গোষ্ঠী : সিরিয়া থেকে বহিষ্কারের প্রশ্নে বাস্তবতা ও জটিলতা

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ‘সিরিয়া থেকে সব বিদেশি সন্ত্রাসীকে চলে যেতে হবে’ বলে মন্তব্য করেন, তখন তিনি মূলত এমন সব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কথা বলেছিলেন, যারা সিরীয় নয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী তালিকায় রয়েছে। এতে যেমন ইসলামিক স্টেট বা আইএস অন্তর্ভুক্ত, তেমনি ইরানি রেভল্যুশনারি গার্ডসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিলিশিয়া ও অন্য জিহাদি সংগঠনগুলোও পড়ে।

যেসব বিদেশি গোষ্ঠী বর্তমানে সিরিয়ায় অবস্থান করছে এবং সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত, তাদের বেশিরভাগই শুধু সিরীয় জনগণের প্রতি নয়, বরং নতুন সিরীয় নেতৃত্বেরও স্পষ্ট বিরোধিতা করে আসছে। এদের মূল লক্ষ্য—সিরিয়ায় নতুন নেতৃত্বকে ঠেকানো। এই তালিকায় রয়েছে আইএস, শিয়া মিলিশিয়ারা, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডস এবং হিজবুল্লাহ।

তবে সমস্যা তৈরি করেছে কয়েকটি ছোট গোষ্ঠী ও স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি, যারা এখনো সিরিয়ায় অবস্থান করছে এবং অতীতে আসাদবিরোধী যুদ্ধে সক্রিয় ছিল।

হায়াত তাহরির আশ-শাম নামের গোষ্ঠীর প্রায় ২,৫০০ বিদেশি যোদ্ধার সবাই কিন্তু সন্ত্রাসী তালিকায় নেই। এদের বেশিরভাগই চীনের উইঘুর মুসলিম—তুর্কিস্তানি বংশোদ্ভূত। ২০২০ সালেই তাদের সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

সম্ভাবনা রয়েছে, এই যোদ্ধাদের অনেককেই নাগরিকত্ব দিয়ে সিরীয় সমাজে একীভূত করা হবে। কারণ, গত এক দশকে তাদের অনেকেই সিরীয় পরিবারে বিয়ে করেছেন, সন্তান জন্ম দিয়েছেন এবং সিরিয়ায় বসবাস করছেন। তারা আসাদবিরোধী লড়াইয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, বিশেষ করে ‘রদউল উদওয়ান’ অভিযানে।

শারা নিশ্চয়ই তাঁর পুরোনো সহযোদ্ধাদের এত সহজে ছেড়ে দিতে চাইবেন না। বিষয়টি বিশেষ করে কিছু আরব ও বিদেশি যোদ্ধার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তবে তিনি চাইলে তাঁদেরকে প্রকাশ্যে না আসতে এবং সিরিয়ার ভেতর কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক কার্যকলাপে অংশ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য করতে পারেন। অর্থাৎ, সিরিয়াকে যেন তারা নিজেদের দেশের শাসকদের বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড চালানোর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার না করে।

যেসব গোষ্ঠীর সঙ্গে শারার সম্পর্ক আগে থেকেই খারাপ—যেমন চেচেন মিলিশিয়া—তাদের সিরিয়া ছাড়তে বলা তুলনামূলকভাবে সহজ হবে। তিনি চাইলে এই গোষ্ঠীগুলোকে স্পষ্ট করে জানাতে পারেন যে, সিরিয়ায় তাদের অবস্থান অগ্রহণযোগ্য।

আর কিছু ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রস্তাব দিতে পারেন, তবে শর্ত থাকবে—তারা সিরিয়া থেকে কোনো ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা চালাতে পারবে না। না মানলে তাদের দেশ ত্যাগের বিকল্প থাকবে।

এই ধরনের নমনীয় অবস্থান সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও গ্রহণযোগ্য হবে। কারণ, তারা জানে, বাস্তব রাজনীতিতে সবকিছু নিয়মের কড়াকড়ি মেনে চলা সবসময় সম্ভব হয় না।

এরই একটি উদাহরণ হলো—সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে বিদেশি নেতাদের কোনো নেতৃত্বের পদে না রাখার সিদ্ধান্ত। এতে বোঝা যায়, শারা পরিস্থিতি যেভাবে সামলাচ্ছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সন্তোষজনক। এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের পাঠানো জবাবপত্রেও উঠে এসেছে।

আইএস ও এসডিএফ

আইএস এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (কেসাদ)–এর সঙ্গে যুক্ত আট দফা দাবির পুনরাবৃত্ত পঞ্চম ধারায় এবং ট্রাম্পের দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখ ছিল—‘উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আইএস বন্দিশিবিরগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি।

এই অংশটি স্পষ্টভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ওই অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং সেখানকার স্বশাসিত প্রশাসন ভেঙে দেওয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে। এমন একটি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো এসডিএফ নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝোতা, যা ইতোমধ্যেই ‘নীতিগত সমঝোতা’ নামে একটি চুক্তির মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। এই চুক্তিটি মার্কিন মধ্যস্থতায় রাষ্ট্রপতি প্রাসাদে কেসাদ নেতা মাজলুম আবদি ও সিরিয়ার রাষ্ট্রপতি শারার মধ্যে সই হয়েছে।

এরপর থেকেই মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়েছে। স্বশাসিত প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলো এবং বিশেষ করে তেলক্ষেত্র ও বাঁধের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলো এখন কেন্দ্র সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। যদিও এসডিএফের কয়েকজন শীর্ষ নেতা এখনো এই প্রক্রিয়ায় বাধা দিচ্ছেন, তবু বাস্তবতা হলো—যদি কুর্দি গোষ্ঠী পিকেকে স্বেচ্ছায় ভেঙে ফেলা হয়, তাহলে এই চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নের পথ খুলে যাবে। এর ফলে দামেস্কের কেন্দ্রীয় সরকার ফের পূর্ণ ক্ষমতা হাতে পাবে, এবং পুরো সিরিয়ায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। এর আওতায় হোল ক্যাম্পসহ আইএস যোদ্ধাদের পরিবারের বন্দিশিবিরগুলোর দায়িত্বও দামেস্কের হাতে যাবে।

পরিস্থিতি এখন অনেকটাই দামেস্কের অনুকূলে। বন্দিশিবিরগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতি এসডিএফের জন্য এক ধরনের স্পষ্ট বার্তা—বিষয়টি এখন আর আলোচনার নয়, চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। একই সঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক মহলের উদ্দেশে একটি বার্তা যে, সন্ত্রাস দমন এখন সিরিয়ান সরকারের দায়িত্ব। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, দামেস্ককে এখন এই লড়াইয়ে অংশীদার হিসেবে মানতেই হবে। ফলে দামেস্কের অনুমতি ছাড়া আন্তর্জাতিক জোটের আর কোনো সামরিক অভিযান বৈধ হবে না। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে—এটা শুধু সিরিয়ার নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার সঙ্গেই গভীরভাবে জড়িত।

মোট কথা হল, যা বোঝা যাচ্ছে, দাবিগুলোর মধ্যে কিছু তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। তবে বেশিরভাগই দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত প্রকৃতির, যেগুলো বাস্তবায়নে একদিকে যেমন সময় লাগবে, অন্যদিকে দরকার হবে ধাপে ধাপে, নানা পন্থায় এগোনো—যাতে মূল লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হয়, যদিও সেটা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন না-ও হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—দামেস্ক যেন এমন একটি আন্তরিক প্রতিশ্রুতি দেখায়, যা থেকে বোঝা যায়, সিরিয়া তার কথার প্রতি আন্তরিক এবং শারাকে একটি বিশ্বাসযোগ্য মিত্র হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

অন্যদিকে, দামেস্কের দৃষ্টিতে সীমার মধ্যে থেকে বাস্তবসম্মত অঙ্গীকার পালন শুধু দেশটির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতেই সাহায্য করবে না, বরং এটা পশ্চিমা জোটের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার সুযোগও তৈরি করবে। পাশাপাশি, পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার দুঃসহ উত্তরাধিকার থেকে মুক্তি পাওয়াও সহজ হবে। এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করা যেতে পারে সংযত অবস্থান জোরদার করতে এবং বিলুপ্ত ‘হায়াত তাহরির আশ-শাম’-এর বিরুদ্ধে অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে।

সর্বশেষ