মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা

মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণে চীনের নীরব ভূমিকা

প্রকাশ্যে চীনের রাষ্ট্রদূতরা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বললেও, পর্দার আড়ালে চীনের অর্থনৈতিক ভূমিকা কার্যত এক ধরনের ‘নীরব সহযোগিতা’, যা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও অবৈধ শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার পক্ষে কাজ করছে।
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণে চীনের নীরব ভূমিকা

‘রাযান, চীন যেতে হবে না, হোয়ারায় চলে এসো, চীন তো এখানেই আছে।’ নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আমার বন্ধু আহমদের এই কথাটি প্রথমে মজা মনে হলেও, তার ভেতরে ছিল এক দুঃখজনক বাস্তবতা।

হোয়ারা, নাবলুসের কাছের একটি ছোট্ট ফিলিস্তিনি গ্রাম। চারপাশে ঘিরে আছে ইসরায়েলের কিছু ভয়ংকর চরমপন্থী বসতি, যেমন ইয়িৎসহার, যেখানে সহিংসতা ও ফিলিস্তিনবিদ্বেষ প্রায়ই চরম আকার ধারণ করে।

জিজ্ঞেস করায় আহমদ ব্যাখ্যা দিলেন, চীনা শ্রমিকেরা আশপাশের বসতিগুলোতে থাকে, কাজ করে। আমি নিয়মিতই তাদের দেখি, গ্রামের দোকানে বাজার করছে, রাস্তায় হাঁটছে।

এই কথাগুলো শুনে আমি বিষয়টি আরও গভীরভাবে খতিয়ে দেখা শুরু করি। দখলকৃত পশ্চিম তীরের নানা জায়গার ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথা বলি, শুনি তাদের অভিজ্ঞতা। রামাল্লার আলি জানান, আমি নিজ চোখে দেখেছি, চীনা শ্রমিকেরা বেতএল বসতিতে ঘরবাড়ি আর অবকাঠামো নির্মাণ করছে।

খালিলের বাসিন্দা সাঈদের ভাষায়, কোভিড-১৯ চলাকালে বসতির লোকজন চীনা শ্রমিকদের আলাদা নিরাত্তায় রেখেছিল, যেন তারা অন্যদের সংস্পর্শে না আসে।

এই সব অভিজ্ঞতা মিলিয়ে একটি স্পষ্ট তথ্য উঠে আসে—চীনা শ্রমিকেরা সরাসরি ইসরায়েলের বসতি নির্মাণে যুক্ত, এমনকি দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমিতেও।

এটা চীনের ঘোষিত নীতির সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এক দশক আগে চীন তাদের শ্রমিকদের ইসরায়েলি বসতিতে কাজ করতে নিষেধ করেছিল।

২০১৫ সালে ইসরায়েল-চীন শ্রমচুক্তিতে স্পষ্ট বলা ছিল, চীনা শ্রমিকেরা পশ্চিম তীরের কোনো বসতিতে কাজ করতে পারবে না। তবে এই শর্ত রাজনৈতিক বা নৈতিক বিবেচনায় নয়, বরং শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখেই দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু ২০১৬ সালে চীন ‘আহাভা’ নামে একটি কোম্পানি কিনে নেয়, যার সদর দফতর একটি ইসরায়েলি বসতিতে। এরপর ২০১৭ সালে আরও এক চুক্তি হয়, যাতে একই নিরাপত্তা শর্ত রেখে ৬ হাজার চীনা নির্মাণশ্রমিক ইসরায়েলে পাঠানোর কথা বলা হয়।

ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তখন বলেছিলেন, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই শর্ত রাখা হয়েছে। তবে চীনের কর্মকর্তারা পাল্টা বলেন, আসলে এটি ছিল বসতি নির্মাণের বিরোধিতা, নিরাপত্তা কেবল একটি অজুহাত।

কিন্তু নাবলুস থেকে রামাল্লা, খালিল পর্যন্ত যাদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তাদের বক্তব্য বলছে, চীনা শ্রমিকেরা এখনও দখলকৃত অঞ্চলে বসতি নির্মাণে সক্রিয়। ফলে প্রশ্ন উঠছেই— ইসরায়েলের বসতি নীতির বিরুদ্ধে চীনের অবস্থান কি সত্যিই আন্তরিক, নাকি তা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ?

আমাদের যুগের অগ্রদূতেরা

গাজায় চলমান গণহত্যার প্রেক্ষাপটে চীন একাধিকবার প্রকাশ্যে দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বাড়তে থাকা সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান এক বিবৃতিতে বলেন, ইসরায়েলের উচিত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ করা।

তবে একদিকে বেইজিং যখন সংযম ও মানবাধিকারের কথা বলছে, অন্যদিকে চীনা মালিকানাধীন কিছু কোম্পানি সরাসরি ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ও ঔপনিবেশিক বসতি প্রকল্পে সহায়তা করে চলেছে।

এর অন্যতম উদাহরণ হলো ‘আদামা এগ্রিকালচারাল সলিউশনস’—এক সময়ের একটি ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান, যা এখন চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি ‘কেমচায়না’-র শতভাগ মালিকানাধীন। গাজায় যুদ্ধ চলাকালে আদামা তার শ্রমিকদের আহ্বান জানায় দেশের কৃষকদের পাশে দাঁড়াতে। বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চল, গাজার কাছাকাছি বসতি ও উত্তরের বসতিগুলোর কৃষকদের পাশে।

জেরুজালেম পোস্ট-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আদামার এক প্রতিনিধি বলেন, দেশের কৃষকরা, বিশেষ করে গাজা ঘেঁষা বসতিগুলোর কৃষকেরা আমাদের সময়ের অগ্রদূত। তাদের কাজ চালিয়ে যাওয়া দেশের নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরও জানান, বর্তমানে তারা প্রচণ্ড মানসিক চাপ ও শ্রমিক সংকটের মধ্যেও নিজেদের জমিতে ফিরে চাষাবাদ শুরু করেছেন। আদামা সবসময় তাদের পাশে ছিল এবং সংকটকালে আরও দৃঢ়ভাবে তাদের পাশে দাঁড়াবে।

এখানেই থেমে থাকেনি প্রতিষ্ঠানটি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে তারা প্রায় ১০ লাখ শেকেল (প্রায় ২৭৫,০০০ মার্কিন ডলার) মূল্যের একটি বৃত্তি তহবিল চালু করে। এই অর্থ গাজা ঘেঁষা ও উত্তরের বসতিগুলোর বাসিন্দাদের কৃষিশিক্ষায় ব্যবহৃত হবে।

আদামার বসতি স্থাপন প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ইতিহাস বেশ পুরনো। তাদের কৃষি পণ্য ব্যবহৃত হয়েছে জর্দান উপত্যকার ইসরায়েলি বসতিগুলোতে পরিচালিত নানা পরীক্ষায়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আদামার তৈরি একটি আগাছানাশক ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক ঠিকাদার আকাশপথে ছিটিয়ে দেয়, যার ফলে গাজার সীমানা বরাবর উদ্ভিদবিচ্ছিন্ন এলাকা সৃষ্টি হয়।

চীন যখন নিজেকে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকটে নিরপেক্ষ বা সহানুভূতিশীল হিসেবে তুলে ধরছে, তখন আদামার মতো কোম্পানির মালিকানা তাকে সরাসরি যুক্ত করে ফেলছে সেইসব সামরিক তৎপরতায়, যা ফিলিস্তিনিদের জীবিকা ও কৃষিভিত্তিক জীবনব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে।

উপনিবেশবাদের ভিত শক্ত করার পেছনে চীনের নীরব ভূমিকা

এটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বরং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত এবং বেসরকারি কোম্পানি সরাসরি কিংবা ঘুরপথে ইসরায়েলের অবৈধ বসতিতে অথবা সেখানে কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ‘তানুফা’ নামের খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানি। যা অবৈধ ইসরায়েলি বসতিতে পণ্য তৈরি করে থাকে। কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক বয়কটের আহ্বান জানানো হচ্ছে। তবু ২০১৪ সালে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ‘ব্রাইট ফুড’ তানুফার ৫৬ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।

এরপর ২০২১ সালে তানুফা একটি টেন্ডারে জয়ী হয়ে পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের ১৬টি অবৈধ বসতিতে চলাচলকারী ২২টি বাস রুট পরিচালনার দায়িত্ব পায়। এই বাসগুলো কেবল যাতায়াতের বাহন নয়, বরং এগুলোর মাধ্যমে গড়ে তোলা হয়েছে এমন এক কাঠামো যা অবৈধ বসতি স্থাপনকে আরও টেকসই ও আরামদায়ক করে তুলছে—অর্থাৎ এক ধরনের উপনিবেশবাদের সহায়ক কাঠামো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ২০১৬ সালে চীনা কোম্পানি ‘ফোসুন’ কর্তৃক ‘আহাভা’ নামের প্রসাধনসামগ্রী প্রস্তুতকারক ব্র্যান্ড অধিগ্রহণ। আহাভার কারখানা অবস্থিত পশ্চিম তীরের ‘মিৎসপে শালেম’ বসতিতে। আন্তর্জাতিক বয়কট আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু এই কোম্পানিটিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অবৈধ বসতি প্রকল্পের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

অথচ একদিকে এসব বিনিয়োগ চলতে থাকে, আর অন্যদিকে চীনা কূটনীতিকরা প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে বসতি সম্প্রসারণ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে যান। ২০২৩ সালের শেষ দিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত চ্যাং জুন বলেন, আমরা ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরে বসতি-সংক্রান্ত সহিংসতা রোধে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানাই, যাতে এই অঞ্চল আরেকটি সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত না হয়। তাঁর উত্তরসূরি ফু কংও একই আহ্বান পুনরাবৃত্তি করেন এবং ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরে ‘অবৈধ বসতি স্থাপন’ বন্ধের অনুরোধ জানান।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—চীন নিজে যখন এসব বসতি প্রকল্পে অর্থনৈতিকভাবে জড়িত, তখন তাদের এই বার্তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর নিয়মিতভাবেই বসতি কার্যক্রমে জড়িত কোম্পানির নাম প্রকাশ করে; তবু চীনা কোম্পানিগুলো এই দখলদারি কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছে।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরায়েলের এসব বসতি জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাব অনুযায়ী অবৈধ ও জবরদখল হিসেবে বিবেচিত। অথচ চীন, একদিকে এসব বসতির বিরোধিতা করে, আবার অন্যদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঠিক রেখে সেই উপনিবেশবাদী কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করে তুলছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মূলত ফিলিস্তিনিরা।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো—এই বিনিয়োগগুলো অনেকাংশেই নজর আড়ালে চলছে। প্রকাশ্যে রাষ্ট্রদূতরা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের পক্ষে কথা বললেও, পর্দার আড়ালে চীনের অর্থনৈতিক ভূমিকা কার্যত এক ধরনের ‘নীরব সহযোগিতা’, যা ইসরায়েলের দখলদারিত্ব ও বৈষম্যমূলক শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করছে।

মধ্যপ্রাচ্য পত্রিকা