গাজা উপত্যকায় যুদ্ধ ফের শুরু হওয়ার পর কেটে গেছে প্রায় ২২ দিন। অথচ প্রতিরোধ বাহিনীর পক্ষ থেকে সেই পরিচিত তীব্র প্রতিরোধ কিংবা ধারাবাহিক হামলার কোনো চিহ্ন নেই। যুদ্ধবিরতির আগে যে টানা পনেরো মাস ধরে আমরা তাদের দুঃসাহসিক ও সংঘবদ্ধ অভিযান দেখে এসেছি, তা এখন যেন একদম স্তব্ধ। ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশ্ন উঠছে—এই নীরবতার কারণ কী? প্রতিরোধ বাহিনীর সক্ষমতা কি এতটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে? নাকি এটি কোনো পরিকল্পিত কৌশল?
এই নীরবতা আরও চোখে পড়ে যখন দেখা যায়, ইসরায়েল তাদের স্থল অভিযান জোরদার করেছে, তিনটি বড় সামরিক ডিভিশন (৩৬ দক্ষিণে, ২৫২ মাঝখানে, ১৬২ উত্তরে) মোতায়েন করেছে এবং রাফাহ ও খান ইউনুসের মাঝে একটি নতুন সামরিক সড়ক (মোরাগ) নির্মাণ শুরু করেছে। তাহলে এই পরিস্থিতিতেও কেন প্রতিরোধ বাহিনী সরাসরি মোকাবেলায় নামছে না?
এর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের আগে দুটো সামরিক ধারণা বুঝতে হবে: এক, ‘নমনীয় প্রতিরক্ষা’—যেখানে প্রতিরক্ষা নির্দিষ্ট অবস্থানে স্থির না থেকে চলমান ও অভিযোজ্য হয়। দুই, ‘শক্তির সাশ্রয়ী ব্যবহার’—যেখানে শক্তিকে অপ্রয়োজনে ক্ষয় না করে সঠিক সময় ও সঠিক স্থানে ব্যবহার করা হয়।
২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে ইসরায়েল স্থল অভিযান শুরু করার পর থেকেই প্রতিরোধ বাহিনী—তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো—প্রতিরক্ষার একদম সীমান্ত থেকেই সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা প্রতিটি রাস্তা, গলি ও মাঠে শত্রুকে প্রতিরোধ করে। প্রতিটি প্রতিরক্ষা স্তরে ইসরায়েলি বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে। উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা কাসসাম ব্রিগেডের ২৪টি ইউনিটের কোনো একটি পর্যন্ত পুরোপুরি ভাঙতে পারেনি শত্রু।
বিপরীতে, উত্তর ফ্রন্টের ১১৫ দিনের লড়াইয়ে প্রতিরোধ বাহিনী ইসরায়েলের ইতিহাসের অন্যতম বেশি ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়—৫৫ জন সেনা নিহত, যার মধ্যে ছিল একটি সাঁজোয়া ডিভিশনের কমান্ডার।
এই দীর্ঘ যুদ্ধে প্রতিরোধ বাহিনীর কৌশল পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, তারা যুদ্ধের প্রচলিত ধরন ছেড়ে দিয়েছে। তাদের লড়াই ছিল চতুর, বিচিত্র এবং তীক্ষ্ণ পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে। তারা আর স্থায়ী প্রতিরক্ষা ঘাঁটি রাখেনি—বরং এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সরে গিয়ে, সুযোগ বুঝে, সঠিক সময়ে আঘাত হানার কৌশল বেছে নিয়েছে।
এই কারণেই একজন ইসরায়েলি জেনারেল মন্তব্য করেছিলেন, ‘হামাস যুদ্ধ করে গিরগিটির মতো’—কারণ তারা বারবার নিজেদের রঙ ও রূপ বদলায়, কৌশল বদলায়, এবং শত্রুকে বিভ্রান্ত করে রাখে।
এই নমনীয়তা, কৌশলগত ধৈর্য আর স্মার্ট গেরিলা কৌশলই প্রতিরোধ বাহিনীর শক্তি। এতে তারা শত্রুকে অব্যাহতভাবে চাপে রাখে, আর নিজেরা সঠিক মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে—যেখানে একেকটি আঘাত হয় পরিকল্পিত, প্রাণঘাতী এবং প্রতিক্রিয়াহীন।
এই বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, যুদ্ধের শুরুতে যেসব প্রতিরক্ষা কৌশল কার্যকর ছিল, যুদ্ধ যতই দীর্ঘ হয়েছে, ততই সেগুলো কার্যকারিতা হারিয়েছে। গাজা ও উত্তর ব্রিগেড যেভাবে যুদ্ধ করেছে, খান ইউনিস ও রাফাহ ব্রিগেডে সেই কৌশলের সঙ্গে পার্থক্য দেখা গেছে। এমনকি একই ব্রিগেড বা একটি নির্দিষ্ট ব্যাটালিয়নের মধ্যেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৌশল পরিবর্তন হয়েছে শত্রুর অবস্থানের বিবেচনায়।
যদি জাবালিয়া অঞ্চলে সংঘটিত তিনটি প্রধান যুদ্ধ—প্রথমটি নভেম্বরে, দ্বিতীয়টি মে মাসে, এবং তৃতীয়টি অক্টোবরে সংঘটিত—এগুলোর তুলনা করা হয়, তাহলে এই কৌশলগত পরিবর্তনগুলো আরও পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ে।
প্রতিরক্ষা কৌশলের দিক থেকে দেখা যায়, দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো সাধারণত ‘নমনীয় প্রতিরক্ষা’ কৌশল অবলম্বন করে। এর বিপরীতে, নিয়মিত সেনাবাহিনীগুলো অনেক সময় ‘স্থায়ী প্রতিরক্ষা’ কৌশলে নির্ভর করে। নমনীয় প্রতিরক্ষা বলতে বোঝায়—যুদ্ধ পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রতিরক্ষাবাহিনীকে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া এবং তাদের এমনভাবে মোতায়েন করা যাতে শত্রুর দুর্বল জায়গায় প্রচণ্ড আঘাত হানা যায়। এতে অপ্রয়োজনীয় জায়গায় শক্তি অপচয় না হয়ে, তা কার্যকরভাবে ব্যবহার হয়।
‘শক্তির মিতব্যয়িতা’ বা ‘economy of force’ বলতে বোঝায়—যুদ্ধে সম্পদ ও বাহিনী যতটা সম্ভব সাশ্রয় করে ব্যবহার করা, যাতে দীর্ঘ সময় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। অস্ত্র, যোদ্ধা, অবকাঠামো—সবকিছুর সর্বনিম্ন ব্যবহার করে সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষামূলক ফল অর্জনই এই কৌশলের মূল লক্ষ্য।
প্রতিরোধ বাহিনীর সরবরাহ লাইন না থাকায়, তারা বাধ্য হয় এই কৌশলের প্রতি আরও বেশি নির্ভর করতে। উদাহরণস্বরূপ, খান ইউনিস ব্রিগেডে ইসরায়েলি ৯৮ নম্বর ডিভিশনের বিরুদ্ধে এবং রাফাহ ব্রিগেডে ১৬২ নম্বর ডিভিশনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাহিনী এই কৌশল প্রয়োগ করে। ইসরায়েলের একাধিক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, কাসসাম ব্রিগেড উভয় এলাকায় তিন-চতুর্থাংশ যোদ্ধা সরিয়ে নিয়ে যায় এবং বাকি এক-চতুর্থাংশকে প্রতিরক্ষার কাজে রেখে দেয়।
এই দীর্ঘ ও জটিল যুদ্ধে উভয় পক্ষই একে অপরকে নিঃশেষ করতে মরিয়া ছিল। প্রতিরোধ বাহিনী একাধিক মাস ধরে কৌশল উন্নয়ন করে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছে, বিপরীতে ইসরায়েল একাধিক ফ্রন্ট—লেবানন, সিরিয়া, পশ্চিম তীর—একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে বিশাল বাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হয়। এতে করে তাদের রিজার্ভ বাহিনী চাপে পড়ে এবং ক্লান্তির লক্ষণ দেখা দেয়।
ধারণা করা হয়েছিল, দীর্ঘ যুদ্ধবিরতির পরে হয়ত একটি স্থায়ী সমঝোতা বা অন্তত আরও দীর্ঘ যুদ্ধবিরতি আসবে। কিন্তু যুদ্ধ হঠাৎ আবার শুরু হলে রিজার্ভ ও নিয়মিত বাহিনীকে ফের যুদ্ধে নামতে হয়। তখন ইসরায়েল গাজায় একসঙ্গে তিনটি ডিভিশন পাঠাতে বাধ্য হয়—যা তাদের ছোট আকারের সেনাবাহিনীর জন্য বড় সিদ্ধান্ত।
রাফাহ’তে ইসরায়েলের ব্যাপক বাহিনী মোতায়েন, গোলাবারুদ ও কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যুদ্ধের ভার পুরোপুরি তাদের কাঁধে। অন্যদিকে, প্রতিরোধ বাহিনী তাদের সম্পদ, যোদ্ধা এবং সুড়ঙ্গগুলোকে সুরক্ষিত করে রেখেছে, যাতে সঠিক সময়ে পূর্ণ বা আংশিকভাবে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হতে পারে। তখন ক্ষয়ক্ষতির হিসাবে প্রতিরোধ বাহিনীর খাতা থাকবে প্রায় শূন্য, আর ইসরায়েলের জন্য সেই হিসাব হবে অনেক ভারী।
যুদ্ধ চলাকালে প্রতিরোধ বাহিনীর ক্ষমতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, বিশেষ করে ইসরায়েলের প্রচারণায় তাদের শক্তিকে ভেঙে পড়া বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হয়েছে একেবারে উল্টো। অনেক ঘটনাই সেই প্রচারণার ভুল প্রমাণ দিয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, যুদ্ধবিরতির ঠিক আগে মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বেইত হানুনে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রায় ১০ জন সদস্য নিহত হয়। অথচ এই অঞ্চলটিই ছিল ইসরায়েলের স্থল অভিযানের প্রথম নিশানা এবং যুদ্ধের ৪৭১ দিন পর, যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত টানা আক্রমণের শিকার হয়েছে।
পূর্ববর্তী বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, প্রতিরোধ বাহিনীর কৌশলগত নীরবতা আসলে একটি সচেতন প্রতিরক্ষামূলক কৌশলের অংশ—কোনো রকম দুর্বলতা বা অক্ষমতার প্রকাশ নয়। এই কৌশলের মূল লক্ষ্য হলো শত্রুপক্ষকে ধীরে ধীরে নিঃশেষ করা, যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকা নিশ্চিত করা এবং শত্রুর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মনোবল ভেঙে ফেলা।
যেসব প্রতিরক্ষা কৌশল যুদ্ধের প্রথম দিকগুলোতে কার্যকর ছিল, তা আর বর্তমানে প্রাসঙ্গিক নয়। এখন পরিস্থিতির দাবি—ভূমি দখল ধরে রাখার বদলে কৌশলগতভাবে পিছিয়ে গিয়ে প্রতিরক্ষা এলাকার গভীরে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করা। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যায়, অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শত্রুর ওপর বিধ্বংসী পাল্টা আঘাত হানা সম্ভব হয়।
এই কৌশল ব্যবহারে অস্ত্র ও জনশক্তির সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত হয়, ক্ষয়ক্ষতি কমে এবং দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা গড়ে ওঠে। যদি এই কৌশল সফল হয়, তবে তা কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, বরং রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলেও প্রতিরোধ বাহিনীকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে।
যখন প্রতিরক্ষা বাহিনী শুধু টিকে থাকেই না, বরং শত্রুর আক্রমণ সামলে পাল্টা আঘাত হানার মতো পরিকল্পিত উদ্যোগ নিতে পারে—তখন তারা প্রমাণ করে, কৌশলগত দিক থেকে তারাই প্রকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই ধরনের সক্রিয় প্রতিরক্ষা কৌশল শত্রুকে চাপে ফেলে এবং শক্তির ভারসাম্য নতুন করে গড়ে তোলে।
এ ছাড়া, এই কৌশল ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ জনমতেও বড় প্রভাব ফেলছে। যুদ্ধ যতই দীর্ঘ হচ্ছে, ততই সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে—এই যুদ্ধ আসলে কোনো জাতীয় স্বার্থ নয়, বরং নেতানিয়াহু ও ডানপন্থী রাজনীতির স্বার্থরক্ষায় পরিচালিত হচ্ছে। ফলে সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও জনমনে উদ্বেগ বেড়ে চলেছে।
এই বাস্তবতা মার্কিন অবস্থানেও প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, মার্কিন প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই মনে করে, কেবল অস্ত্রের জোরে এই যুদ্ধের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব নয়। একটি টেকসই রাজনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন একাধিকবার বলেছেন—গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সামরিক সাফল্য যদি রাজনৈতিক পথে রূপান্তরিত না হয়, তবে তা শুধু হারিয়ে যাবে না, বরং একটি বড় পরাজয়ে রূপ নিতে পারে।
সূত্র: আল জাজিরার বিশ্লেষক সাঈদ জিয়াদের প্রবন্ধ আলোকে লেখা











