মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

lost land : রোহিঙ্গা শিশুদের নিয়ে নির্মিত জাপানি নির্মাতার চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনি কি জানেন?

উদ্দেশ্য ছিল, বিস্মৃত রোহিঙ্গাদের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া, মানবিক দায়বদ্ধতার কথা নতুন করে জাগিয়ে তোলা।
‘Lost Land’: বিপদসংকুল পথে রোহিঙ্গা শিশুদের যাত্রা
‘Lost Land’: বিপদসংকুল পথে রোহিঙ্গা শিশুদের যাত্রা

রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্বের সহানুভূতি যে আপেক্ষিক, তা আজ স্পষ্ট। সংবাদের পট বদলালেই আগ্রহ হারায় রোহিঙ্গাদের আলোচনা, কমে আসে তহবিলও। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর একটি এই রোহিঙ্গাদের প্রতি ধীরে ধীরে নেমে আসে বিস্মৃতির পরদা।

এই ভুলে যাওয়ার সময়েই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ‘Lost Land’ বা হারানো ভূমি—রোহিঙ্গা ভাষায় যার নাম ‘হারা ওয়াতান’। ইস্তানবুলের ১৩তম বসফরাস চলচ্চিত্র উৎসবে সম্প্রতি দেখানো হয় চলচ্চিত্রটি। উদ্দেশ্য ছিল, বিস্মৃত রোহিঙ্গাদের কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া, মানবিক দায়বদ্ধতার কথা নতুন করে জাগিয়ে তোলা।

চলচিত্রটিতে দেখা যায় দুই রোহিঙ্গা শিশুর পথচলা। মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নাগরিকত্বহীনতার শিকার। এর উপর তারা মোকাবিলা করেছে ভয়াবহ সহিংসতা ও নিপীড়ন। এর ফলশ্রুতিতে লাখো রোহিঙ্গার মতো এই দুই শিশুও বাধ্য হয় দেশ ছাড়তে।

জাপানি নির্মাতা আকিও ফুজিমোতোর কাছে এ উৎসবে আসা ছিল এক বিশেষ অভিজ্ঞতা। TRT World-কে তিনি বলেন, বহুদিন ধরেই তুর্কি সিনেমা, বিশেষ করে সেমিহ কাপলানওগলুর কাজ তাঁর কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। তুরস্কে আসার ইচ্ছাও ছিল অনেকদিনের। ইস্তানবুলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, এখানে কাটানো সময় তাঁর জন্য ছিল ‘অত্যন্ত উপভোগ্য’।

তাঁর চলচ্চিত্রের গল্প অবশ্য এই সাংস্কৃতিক নগরীগুলোর আলো থেকে অনেক দূরের। জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি ও মালয়েশিয়ার যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ‘Lost Land’ রোহিঙ্গাদের গল্প তুলে ধরে সবচেয়ে অসহায়দের চোখ দিয়ে। শিশুদের দৃষ্টিকোণ থেকে।

দীর্ঘদিনের নির্যাতন

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ১২ বছরের কাজের পথচলা থেকেই ফুজিমোতোর এই প্রকল্পের সূচনা। তিনি বলেন, বিশেষ করে মিয়ানমারে কাজ করতে গিয়েই রোহিঙ্গাদের বাস্তবতা তাঁর চোখে ধরা পড়ে। যে জনগোষ্ঠী শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে সেখানে বসবাস করে আসছে, অথচ রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে আজ তাদের দেশছাড়া হতে হয়েছে।

TRT World–কে তিনি জানান, মিয়ানমারে যে অল্প কিছু রোহিঙ্গা রয়ে গিয়েছিলেন, তাদের নিয়ে ও তাদের উপর হওয়া নিপীড়ন নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা ছিল এক ধরনের ‘ট্যাবু’। তাই প্রথম দিকে তিনি চলচ্চিত্রটি নিয়ে কাজ শুরু করতে দ্বিধায় ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ভয় ছিল, এতে কাজও হারাতে পারি, বন্ধুরাও হারিয়ে যেতে পারে।’

কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের সংবাদ শুনতে শুনতে, তার পক্ষে আর নীরব থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেন, ‘তাদের কণ্ঠ উপেক্ষা করে যাওয়াটা আমার কাছে লজ্জার ছিল। ভীষণ অপরাধবোধে ভুগতাম।’ সেই অপরাধবোধই শেষ পর্যন্ত ‘Lost Land’–র পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।

ছবিটির গভীর বাস্তবতা তৈরি হয়েছে এর অভিনয়শিল্পীদের মাধ্যমে। ফুজিমোতো ২০০-র বেশি রোহিঙ্গাকে অভিনয়ে নিয়েছেন। এদের কেউই আগে অভিনয় করেননি। এটিই প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, যেখানে রোহিঙ্গা ভাষাই প্রধান ভাষা।

ফুজিমোতো বলেন, ‘রোহিঙ্গারা লিখিত ভাষায় যোগাযোগ করতে পারে না; শুটিংয়ের সব নির্দেশনা মৌখিকভাবেই দিতে হয়েছে।’ যদিও তিনি নিজে কেবল জাপানি ভাষাই জানতেন, তারপরও তাঁর ভাষায়, ‘প্রায় কোনো যোগাযোগ-জটিলতাই তৈরি হয়নি।’

গল্পটি এগিয়েছে দুই শিশুর পথচলা ধরে। নয় বছরের সমিরা আর তার চার বছরের ভাই শফির।

বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয় ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর পথে তারা মানবপাচারকারীদের হাতে পড়ে। থাইল্যান্ডে পাচারকারীরা তাদের ফেলে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গ হারিয়ে দুই ভাইবোনকে একাই পাড়ি দিতে হয় জঙ্গল, নদী আর অচেনা পথ। যাত্রাপথে কিছু অভিবাসী আর স্থানীয় মানুষের দয়ার ওপর ভরসা করে।

তাদের যাত্রা এক সূক্ষ্ম ভিজ্যুয়াল মোটিফে বাঁধা থাকে। সমিরার গেরুয়া রঙের অ্যাডিডাস জার্সি। পরে সেই রঙই প্রতিধ্বনিত হয় শফির নিজের গায়ে জড়িয়ে রাখা গেরুয়া রঙের কম্বলে।

জাতীয়তা ও নাগরিকত্বহীন মানুষ

ভেনিস বিয়েনালেতে দেওয়া পরিচালকের বিবৃতিতে ফুজিমোতো লিখেছেন, রোহিঙ্গাদের বাস্তবতা দেখানোর জন্যই এই যাত্রাপথ তুলে ধরা জরুরি ছিল। ‘জাতীয়তা ও নাগরিকত্বহীন মানুষ’ হিসেবে তারা যেখানেই যায়, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাঁচতে বাধ্য হয়। সত্যিকারের নিজের বলার মতো একটি জায়গার খোঁজে ঘুরে বেড়ায়।

এই রাষ্ট্রহীনতা শুধু ছবির থিম নয়—বাস্তব জীবনেও একই অবস্থা ছবির অভিনেতাদের। সমিরা ও শফির চরিত্রে অভিনয় করা বাস্তব জীবনের রোহিঙ্গা ভাইবোন শোমিরা রিয়াজ উদ্দিন ও মুহাম্মদ শফিক রিয়াজ উদ্দিন ফুজিমোতোর সঙ্গে ইস্তানবুলের বসফোরাস উৎসবে যেতে পারেননি।

কারণটি তাদের দুর্দশারই এক নির্মম সারসংক্ষেপ, ‘তাদের কোনো দেশই শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না… তারা অনিশ্চিত ও অস্থির অবস্থায় রয়ে গেছে,’ আর ভ্রমণের মতো কোনো পাসপোর্টও নেই।

ফুজিমোতো আশা করেন, তাঁর চলচ্চিত্র অন্তত সেই দূরত্ব কিছুটা কমিয়ে দিতে পারবে। তাঁর ভাষায়, ‘যদি সিনেমা একসঙ্গে থাকার রূপক হয়, তাহলে আমি চাই এই ছবির মাধ্যমে রোহিঙ্গারা, যারা অনেকের কাছেই দূরের বা অচেনা, তারা যেন আমাদের কাছাকাছি অনুভূত হয়, প্রতিবেশী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে।’

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন