উইঘুরদের ওপর চীন সরকারের দমন-পীড়ন ও নিধনের ঘটনা নতুন নয়। দীর্ঘদিন ধরে ইস্ট তুর্কিস্তান বা বর্তমান শিনজিয়াং প্রদেশে চলছে এই নির্যাতন, যা আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে চীন সরকার ‘রি-এডুকেশন ক্যাম্প’ নামে লাখ লাখ উইঘুর মুসলমানকে বন্দী করে রেখেছে। এই ক্যাম্পগুলোতে চলছে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, জোরপূর্বক বন্ধ্যাত্ব করণ, অঙ্গ কেটে নেওয়া (অর্গান হার্ভেস্টিং) এবং গণহত্যার মতো ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধ। চীন এসব কার্যক্রমকে তথাকথিত ‘চরমপন্থা প্রতিরোধের উদ্যোগ’ বলে দাবি করলেও, বিভিন্ন প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন তার বিপরীত চিত্রই তুলে ধরছে।

এখন পর্যন্ত প্রকাশিত আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্ট, সংবাদ ও সোশ্যাল মিডিয়ার নানা দলিলেও স্পষ্ট হয়েছে। শিনজিয়াং অঞ্চলে চীনা কর্তৃপক্ষ এখনো একই ধরনের নীতি ও দমনচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে।
শিনজিয়াং অঞ্চলে এসব রি-এডুকেশন ক্যাম্পে আটক ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর ভোগান্তির যেন কোনো শেষ নেই। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন প্রকাশের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি।
২০২২ সালের ৩১ আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, উইঘুর অঞ্চলে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ’। এর আগেই ২০২১ সালের প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি বলেছিল, উইঘুর অঞ্চলে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর প্রতি চীনের আচরণ মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
তবু এতদিনে কোনো বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যায়নি। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেউই এসব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। বরং চীনা সরকার এখনো ভুক্তভোগীদের পরিবারকে ভয় দেখাচ্ছে, চুপ থাকতে বাধ্য করছে এবং শিনজিয়াং অঞ্চলে তাদের দমনমূলক আইন ও নীতি আগের মতোই চালিয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে শিনজিয়াং অঞ্চলে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চীনকে অভিযুক্ত করার তিন বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, এটিকে ‘লজ্জাজনক নীরবতা’ বলে মন্তব্য করেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের চীনবিষয়ক পরিচালক সারাহ ব্রুকস।
তিনি বলেন, ‘চীনা কর্তৃপক্ষের লাগাতার নির্মমতায় অসংখ্য মানুষের জীবন ধ্বংস হয়েছে, পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়েছে, পুরো সম্প্রদায় ভেঙে পড়েছে। আজও আটক ব্যক্তিদের পরিবার সত্য, ন্যায়বিচার ও প্রিয়জনের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে।’
ব্রুকস আরও বলেন, ‘আরেকটি বছর চলে গেল কোনো পদক্ষেপ ছাড়াই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখনই উচিত বেঁচে থাকা ভুক্তভোগীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শিনজিয়াং অঞ্চলে চলমান দমননীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দীর্ঘদিন ধরে নথিভুক্ত করে আসছে শিনজিয়াংয়ে উইঘুর, কাজাখ ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চীনা সরকারের কঠোর দমননীতি।
২০২১ সালে সংস্থাটি একটি বৈশ্বিক স্বাক্ষর অভিযান চালায়। এতে ১৮৪টি দেশ ও অঞ্চল থেকে ৩ লাখ ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ যুক্ত হন। তাঁরা দাবি জানান, শিনজিয়াং অঞ্চলে বিচারবহির্ভূতভাবে আটক লাখো মুসলিম নারী-পুরুষকে মুক্তি দিতে হবে এবং গণআটক, নির্যাতন ও নিপীড়নের জন্য দায়ীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের ‘#FreeXinjiangDetainees’ অভিযানে অন্তর্ভুক্ত ১২৬ জন ব্যক্তির পরিবারের সদস্য ও সংশ্লিষ্ট সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সংস্থাটির প্রাপ্ত প্রতিক্রিয়াগুলোতে স্পষ্ট হয়েছে, শিনজিয়াং অঞ্চলে মানবাধিকার লঙ্ঘন এখনো চলছে এবং এর প্রভাব পরিবারগুলোর জীবনে গভীরভাবে রয়ে গেছে।
পাতিমে (ছদ্মনাম) নামের এক নারী জানান, তাঁর এক আত্মীয় আটক অবস্থায় মারা গেছেন, আরেকজন এখনো বন্দিশিবিরে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের প্রতিবেদন প্রকাশের পর পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এই আশাটুকুও এখন আর নেই। প্রতিবেদন ঘিরে যে বৈশ্বিক মনোযোগ তৈরি হয়েছিল, তা হারিয়ে গেছে। চীনও এর তেমন কোনো প্রশ্নের মুখে পড়েনি। আমাদের মতো উইঘুরদের জন্য প্রতিটি নিষ্ক্রিয় দিনের মানে হচ্ছে আরও একটি পরিবার ভেঙে যাওয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, প্রতিবেদন প্রকাশের পর বাস্তব পদক্ষেপ দেখা যাবে। নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক চাপ, অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনা হবে। মনে হয়েছিল, ‘জাতিসংঘ যখন আনুষ্ঠানিকভাবে এই নৃশংসতা স্বীকার করবে, তখন বিশ্ব আরও দৃঢ়ভাবে এগিয়ে আসবে… কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এই প্রতিবেদনও হয়তো তাকের এক ভুলে যাওয়া ফাইল হয়ে থাকবে।’
বন্দিশিবিরে থাকা আত্মীয়ের বিষয়ে পাতিমে বলেন, ‘২০১৮ সালের জুন থেকে তাঁর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। একবারও কথা বলতে পারিনি, কোনো চিঠি বা বার্তা পাইনি… এই নীরবতা শুধু কষ্টদায়ক নয়, আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভীষণভাবে ভেঙে দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে বেঁচে থাকা যেন এক ধরনের নির্যাতনেরই সমান।’
মামাতজান জুমা, যার ভাই আহমেতজান এখনো কারাগারে বন্দি, বলেন, সংবাদ না পাওয়ায় প্রতিদিনের জীবন যেন অসহনীয় হয়ে উঠেছে। এটা এমন এক ক্ষতের মতো, যা কখনো সারে না। কারণ আমি জানি না, সে নিরাপদে আছে কি না, সুস্থ আছে কি না, এমনকি বেঁচে আছে কি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাঁর ছেলে বাবার উপস্থিতি ছাড়াই বড় হয়েছে। আমরা সবাই এমন এক স্থায়ী শূন্যতা নিয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়েছি, যা আমাদের জীবনের রূপটাই বদলে দিয়েছে।’
অনেক পরিবারই জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে চীনের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানোর দাবি তুলেছে, যাতে শিনজিয়াং অঞ্চলে নির্বিচারে আটক সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মেদিনে নাজিমি নামে একজন গত তিন বছরের স্থবিরতায় তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সরকার, নাগরিক সমাজ ও সাধারণ মানুষ চীনের এই অপরাধগুলোকে কেবল ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হিসেবে দেখা বন্ধ করতে হবে। উইঘুরদের সঙ্গে যা ঘটছে, তা কোনো দেশীয় ইস্যু নয়; এটি মানবাধিকার সংকট, মানবতাবিরোধী অপরাধ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হলো চীনের বন্দিশিবির ও কারাগারে আটক মানুষগুলো যেন একদিন আলো দেখতে পায়, পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারে, আর যত দ্রুত সম্ভব সেই চার দেওয়ালের নরক থেকে মুক্তি পায়।’
শিনজিয়াংয়ে উইঘুর ও অন্যান্য মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নিপীড়ন এখনো আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ প্রকাশের তিন বছর পরও বিশ্ব সম্প্রদায়ের নীরবতা শুধু চীনকেই নয়, মানবতার শত্রুদেরকে আরও সাহসী করে তুলেছে।
বছরের পর বছর প্রিয়জনের কোনো খোঁজ না পেয়ে অনিশ্চয়তা, ভয় আর যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন অসংখ্য পরিবার। তাদের এই আর্তি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি এক সরাসরি আহ্বান—মানবাধিকারের প্রশ্নে আর সময় নষ্ট করা নয়, এখনই বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।
চীনের বন্দিশিবিরে যারা এখনো স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত, তাদের মুক্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা শুধু রাজনৈতিক দায়িত্ব নয়, এটি মানবতার প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতার প্রকাশ।
সূত্র: অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল











