রাজনীতি মূলত এমনই। যেখানে একসময়ের শত্রুরাই আজ বসে পড়ে একই টেবিলে, স্বার্থ আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনার হিসাব মেলাতে। চলতি মাসের ১৭ তারিখ প্রেসিডেন্ট আাহমাদ আশ শারাকে ক্রেমলিন প্রাসাদে স্বাগত জানিয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। রাজনীতি এভাবেই পৃথিবীর তাবৎ বন্ধুতা-শত্রুতার হিসাব-নিকাশ পাল্টে দেয়।
রাশিয়ার যুদ্ধস্মৃতি এখনো খুব পুরোনো নয়। যে দেশ একসময় ইদলিবসহ সিরিয়ার নানা প্রদেশে বোমা ফেলেছিল আসাদ শাসনকে টিকিয়ে রাখতে, সেই রাশিয়ার সঙ্গেই এখন নতুন সমীকরণ গড়ে তুলছে দামেস্ক। বাস্তবতা আর কূটনীতির সংমিশ্রণে সিরিয়ার সরকার এখন বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী শক্তির সঙ্গে সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাইছে।
এই প্রক্রিয়ার শুরু ২০২৫ সালের গোড়ার দিকে, যখন রুশ উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী দামেস্ক সফর করেন। এরপর জুলাইয়ের শেষে সিরীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর নেতৃত্বে এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল মস্কোয় গিয়ে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করে। সেপ্টেম্বরে দামেস্কে রুশ উপরাষ্ট্রপতির সফরে দুই দেশের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়।
রুশ-আরব সম্মেলনের অংশ হিসেবে অক্টোবর মাসে মস্কো সফরের আমন্ত্রণ পান সিরিয়া প্রেসিডেন্ট আহমাদ আশ শারা। সম্মেলনটি স্থগিত হলেও তাঁর সফরের আহ্বান বহাল ছিল। অবশেষে তিনি মস্কোয় পৌঁছেছেন এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল নিয়ে। এই দলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, গোয়েন্দা প্রধান ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরের মহাসচিব।
এখনই রুশ অস্ত্র ছাড়তে পারছে না সিরিয়া
বছরের পর বছরের যুদ্ধ সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে প্রায় নিঃস্ব করে দিয়েছে। অস্ত্রভাণ্ডারের বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, আর যা টিকে ছিল, তার বেশির ভাগই ইসরায়েলি হামলায় নিশ্চিহ্ন। তবু অবশিষ্ট সামরিক সরঞ্জামগুলো মেরামত ও পুনর্গঠনের বিকল্প নেই দামেস্কের সামনে। সেই কাজে এখন রাশিয়াই তাদের একমাত্র ভরসা।
সিরীয় সরকার নতুন করে সাজাচ্ছে সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে। অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবিলা থেকে শুরু করে সীমান্ত ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা, সব দিকেই তাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। এজন্য দরকার নতুন অস্ত্র ও গোলাবারুদ, পুরোনোগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণ। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আর পশ্চিমা শর্তের বেড়াজাল এড়িয়ে এই সহায়তা দিতে পারে কেবল রাশিয়া। পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক সহায়তার সম্ভাবনা এখনো অনেক দূরে, ইসরায়েলি প্রভাব সেখানে বড় বাধা।
রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশ বাদ দিলে এখনই সিরিয়ার পক্ষে রুশ অস্ত্র ছেড়ে পশ্চিমা সরঞ্জামে সরে আসা প্রায় অসম্ভব। শুধু আগের সরকারই নয়, ২০১১ সালে যে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো আসাদবিরোধী লড়াইয়ে নেমেছিল, তারাও ব্যবহার করেছে রুশ অস্ত্রই। আজ ক্ষমতায় এসে সেই একই অস্ত্রের ব্যবহারে আগ্রহী তারা।
আহমদ আশ শারা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বৈঠকে ইতিমধ্যে রুশ অস্ত্র ও সামরিক সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দামেস্ক ও মস্কো উভয় জায়গাতেই সিরীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে রুশ প্রতিনিধিদের একাধিক বৈঠক হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, দুই দেশের সম্পর্কের জটিল অঙ্কে এই সামরিক সহযোগিতার ইস্যুটিই হতে পারে সবচেয়ে সহজ ও বাস্তবসম্মত ক্ষেত্র।
ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি টিকিয়ে রাখতে চায় রাশিয়া
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সরকারকে এত দিন ধরে টিকিয়ে রেখেছিল মস্কো। আসাদ সরকারের মাধ্যমেই দীর্ঘদিন নিরাপদ ছিল সিরিয়ায় রুশ স্বার্থ। তবে সময়ের সাথে সাথে আসাদ শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে সেটিই বোঝা হয়ে দাঁড়ায় রাশিয়ার জন্য। ফলে মস্কো বিকল্প পথ খুঁজতে থাকে। বিশেষ করে ‘প্রতিরোধ অভিযান’ শুরুর পর এবং আলেপ্পোতে আসাদ বাহিনী বড় ধাক্কা খাওয়ার পর থেকে রাশিয়া নতুন করে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে।
এখন মস্কোর মূল লক্ষ্য সিরিয়ায় নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা, বিশেষ করে তারতুস নৌঘাঁটি ও হামিমিম বিমানঘাঁটি। এ উদ্দেশ্যে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দোহায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাশিয়া প্রস্তাব দেয়, আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়া হোক। এর পরপরই হোমস পর্যন্ত যুদ্ধ থেমে যায় এবং বিদ্রোহীরা কোনো বড় সংঘর্ষ ছাড়াই রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করে।
বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার নতুন সরকার রুশ স্বার্থ রক্ষায় বাধ্য থাকবে। তবে এই সমর্থন রাশিয়া বিনা মূল্যে দেবে না। সিরিয়ার স্থিতিশীলতা এখন অনেকটাই রাশিয়ার হাতে। যেখানে অস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানি, গমসহ নানা ধরনের সহায়তা মস্কো দিতে পারে। একই সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও রাশিয়ার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং দেশটিকে সন্ত্রাসবাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার প্রশ্নে মস্কো একধরনের কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিকভাবে রাশিয়া যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তবে নেতানিয়াহুর সরকারের পিছু হটার সম্ভাবনাও বাড়বে, যা সিরিয়ার স্থিতিশীলতার পথ খুলে দিতে পারে।
তবে মস্কো চাইলে নেতিবাচক ভূমিকাও নিতে পারে। পুরোনো আসাদপন্থী গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সক্রিয় করে অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে কিংবা কুর্দি নেতৃত্বাধীন ‘সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্স’ (কেএসডি) ও সরকারের মধ্যে বিরোধ আরও তীব্র করতে পারে। এসব ঝুঁকি সম্পর্কে সিরিয়ার সরকার সচেতন এবং মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক এমনভাবে রাখছে, যাতে রাশিয়া দেশের ঐক্য ও স্থিতিশীলতার পক্ষে থাকে।
রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ হলো ভূমধ্যসাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিগুলো। বিশেষ করে তারতুস নৌঘাঁটি। এই ঘাঁটিই রাশিয়ার জন্য ভূমধ্যসাগর, উত্তর আফ্রিকা ও আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলে সামরিক ও লজিস্টিক সহায়তার কেন্দ্র। এই ঘাঁটি হারালে প্রাক্তন সোভিয়েত প্রভাবের বাইরে রাশিয়ার উপস্থিতি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, রাশিয়া ও সিরিয়ার মধ্যে তারতুস ঘাঁটি নিয়ে একটি নতুন সমঝোতা হতে পারে। এতে উভয় পক্ষেরই লাভ। রাশিয়া পাবে স্থায়ী ঘাঁটি, আর সিরিয়া পাবে খাদ্য, জ্বালানি ও নিরাপত্তা সহায়তা। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় এই চুক্তি ভূমিকা রাখবে, যাতে সিরিয়া আর কখনো পরাশক্তিগুলোর প্রভাব-প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত না হয়।
রাশিয়া–সিরিয়া সম্পর্কের ভবিষ্যৎ
সিরিয়ার সরকারের জন্য এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ নয়। কারণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে যে তীব্র মেরুকরণ চলছে, সিরিয়া সেই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতেই অবস্থান করছে।
অভ্যন্তরীণভাবে সিরিয়া এখনো পুরো দেশজুড়ে সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, নিরাপত্তা ও সামরিক কাঠামো গঠনের কাজও এখনো শেষ হয়নি। এসব সীমাবদ্ধতা রাশিয়ার মতো শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে সমানভাবে আলোচনার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।
আন্তর্জাতিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য এখন বড় ধরনের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ‘তুফানুল আকসা’ অভিযান এবং এর পরবর্তী যুদ্ধ পরিস্থিতি অঞ্চলটির চিত্রই বদলে দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে সিরিয়াতেও। লেবানন থেকে শুরু হওয়া সংঘাত এখন সিরিয়ায় পৌঁছেছে। ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে ইরাকেও। একই সঙ্গে ইরানের ওপরও নতুন করে চাপ বাড়ছে।
এই প্রেক্ষাপটে এখনই সিরিয়া ও রাশিয়ার সম্পর্ক কোন দিকে যাবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। কারণ, গোটা অঞ্চলই এখনো নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে আছে। স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো একে–অপরের সঙ্গে জটিলভাবে জড়িত।
তবে একটা বিষয় স্পষ্ট—সিরিয়ার স্থিতিশীলতা মানে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা। এই বাস্তবতা বুঝেই উপসাগরীয় দেশগুলো, তুরস্ক ও রাশিয়ার মতো রাষ্ট্রগুলো সিরিয়ায় শান্তি ও ভারসাম্য বজায় রাখতে আগ্রহী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখানে ভিন্ন। ওয়াশিংটনের নীতি এখনো গভীরভাবে প্রভাবিত ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গিতে, যা আসলে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন অতিদক্ষিণপন্থী সরকারের অবস্থানের প্রতিফলন।
অদ্ভুতভাবে, ইরানও একই সূত্রে গাঁথা। তারাও মনে করে, সিরিয়ার ভেতরে যদি অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা বজায় থাকে, তাহলে তাদের আঞ্চলিক প্রভাব আরও শক্তিশালী থাকবে। অর্থাৎ, দুই বিপরীত শিবিরই, ওয়াশিংটন ও তেহরান, নিজ নিজ স্বার্থে সিরিয়ার শান্তি ফেরার পথকে জটিল করে তুলছে।
এই নতুন বাস্তবতায়, যেখানে পশ্চিমা অবস্থান এখনো অস্পষ্ট, দামেস্ক ও মস্কোর সামনে সুযোগ রয়েছে নতুন এক অধ্যায় শুরু করার। এমন এক সম্পর্কের, যেখানে অতীতের রক্ত ও অশ্রু মুছে পারস্পরিক স্বার্থই হবে ভবিষ্যতের ভিত্তি।
সূত্র: আল জাজিরা









