মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

হলিউডের পর্দায় ইসরায়েলের পরাজয়, দৃশ্যপটে ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্র

No Other Land প্রথম আরব গল্প হিসেবে অস্কার জিতেছে। ২.৫ মিলিয়ন ডলারের বক্স অফিস আয় এটিকে উত্তর আমেরিকায় সর্বোচ্চ আয় করা আরব সিনেমা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।
হলিউডে ইসরাযেলের পরাজয়। ছবি : এআই
হলিউডে ইসরাযেলের পরাজয়। ছবি : এআই

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পরের দুই বছরে গাজা যুদ্ধের নানারকম ভয়াবহ দৃশ্য—ক্ষুধার্ত শিশু, কাটা অঙ্গ কিংবা ধ্বংসস্তূপ—সবই মানুষ দেখেছে। কিন্তু এসবের থেকেও যে ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল, সেটি ছিল একেবারে ভিন্ন ধরনের।

দ্য গার্ডিয়ান–এর সাংবাদিক ম্যাথিউ ক্যাসেল গত গ্রীষ্মে তেল আবিবে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন, যা প্রকাশিত হয় গত মাসে। প্রতিবেদনে দেখা যায়, ইসরায়েলিরা রোদতপ্ত সৈকতে হাঁটছেন, লোকারণ্য বাজারে কেনাকাটা করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন আধুনিক ক্যাফেতে বসে।

সৈকতে হাঁটতে হাঁটতে একসময় ক্যাসেল একটি যুদ্ধবিরোধী আড্ডায় গিয়ে পৌঁছেন। কিন্তু আড্ডায় ফিলিস্তিনের কোনো উল্লেখই প্রায় নেই। এক প্রবীণ ইসরায়েলি চিৎকার করে বলেন, ‘ইউরোপীয় আর অস্ট্রেলীয়রা বোকার মতো আচরণ করছে। তারা বুঝতে পারছে না, ইসলাম একদিন তাদের কাছেও পৌঁছে যাবে।’

সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া সব ইসরায়েলিই ৭ অক্টোবরের পর থেকে নিহত বা অনাহারে থাকা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সামান্য সহানুভূতিও দেখাননি। বরং গাজা থেকে আসা ছবিগুলোর সত্যতা নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

এক তরুণী বলেন, ওই ছবিগুলোর ৮০ শতাংশই ‘সাজানো’।

তিনি ‘গাজাউড’ নামের একটি শব্দ ব্যবহার করেন, যা অপমানজনক ‘প্যালিউড’-এর অনুকরণে তৈরি। এর মাধ্যমে বোঝানো হয়, ফিলিস্তিন ও গাজা থেকে প্রচারিত বেশির ভাগ ছবিই নাকি সহানুভূতি আদায়ের জন্য বানানো।

অসংখ্য মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন, যেগুলো ইসরায়েলের প্রোপাগান্ডা খণ্ডন করে ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তির বাস্তবতা তুলে ধরেছে, সেগুলোর কোনো উল্লেখই সেখানে নেই।

একজন সাক্ষাৎকারদাতাও এই সত্যটিও স্বীকার করেননি,  ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ঘোষিত হিসাবেই যে বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন।

এক সৈনিক তো বলেছে, তথাকথিত ‘নীতিবান ইসরায়েলি সেনাবাহিনী’ নির্দোষ। আর সবকিছুর শুরু নাকি ৭ অক্টোবর থেকে। কিন্তু সত্যিই কি সেখান থেকেই শুরু? এই প্রশ্নটিই এখন পশ্চিমা সাংস্কৃতিক বলয়ে ব্যাপক আলোচনার বিষয়। 

ব্যর্থতা থেকেই জন্ম নেয় শয়তান 

গত কয়েক বছরে গাজা প্রসঙ্গে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে জোনাথন গ্লেজারের চলচ্চিত্র ‘দ্য জোন অব ইন্টারেস্ট’

হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের পাশেই এক সাধারণ পরিবারের নিস্তরঙ্গ জীবনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভয়াবহ উদাসীনতার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের গাজা-উদাসীনতার তুলনা টানতে সমালোচকেরা আগে বেশ সতর্কই ছিলেন, যতক্ষণ না গ্লেজার ২০২৪ সালের অস্কারে তাঁর বিখ্যাত বক্তৃতা দেন।

পোলিশ-আমেরিকান ইহুদি ধর্মতত্ত্ববিদ আব্রাহাম জোশুয়া হেশেল একবার লিখেছিলেন, ‘জুলুমের প্রতি উদাসীনতা নিজ জুলুমের চেয়েও বেশি ভয়াবহ; কারণ তা সমাজে জুলুমকে নীরবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে।’

৭ অক্টোবর যে বাস্তবতা উন্মোচন করেছে, তা শুধু অশুভের প্রতি উদাসীনতা নয়; বরং এটাও দেখিয়েছে যে, ‘পরবর্তী-সত্যের’ (post-truth) এই যুগে অশুভই হয়ে উঠেছে এমন এক বয়ান, যা মানুষ ব্যবহার করছে নিজের উদাসীনতা, পক্ষপাত আর সুবিধাবাদকে যুক্তিসঙ্গত করে দেখাতে।

দার্শনিক হান্না আরেন্ট একবার বলেছিলেন, ‘অশুভ আসে চিন্তার ব্যর্থতা থেকে… কারণ যখন চিন্তা অশুভকে বুঝতে চায়, তার ভিত্তি ও উৎস খুঁজে বের করতে চায়, তখনই ব্যর্থ হয়। কারণ সেখানে কিছুই থাকে না। এটাকেই বলে অশুভের স্বাভাবিকতা।’

যুদ্ধ-পরবর্তী সময় প্রমাণ করেছে, এখনো এমন মানুষ আছেন, যারা ভাবতে চান, পুরোনো ও অচল ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে চান, কথা বলতে, বিতর্ক করতে এবং ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে চান। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে ছিল শিল্প।

৭ অক্টোবরের পরের সময়টা ছিল একজন আরব লেখক ও চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে আমার জীবনের সবচেয়ে দমবন্ধ করা অধ্যায়।

৭ অক্টোবরের পর হঠাৎই দেখা গেল, এই বিষয়ে কথা বলার ভাষা ভীষণভাবে সীমিত হয়ে এসেছে। সামান্য শব্দচয়নের ভুল বা অস্পষ্ট কোনো বাক্যই কারও কর্মজীবন শেষ করে দিতে পারে সেই তথাকথিত ‘মুক্তচিন্তার পশ্চিমে’।

নিজেদের নৈতিকতার প্রমাণ দিতে আমাদের প্রতিটি বক্তব্য শুরু করতে হতো হামাসকে নিন্দা জানিয়ে। এটা প্রমাণ করতে যে,  আমরা মানবতা হারাইনি, যদিও আমাদের প্রজন্ম বড় হয়েছে প্রচণ্ড অবিচার ও নিপীড়নের সাক্ষী হয়ে।

পশ্চিমে প্রতিটি আরবকে সন্দেহভাজন ধরা হতো, যতক্ষণ না সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতো।

সেই প্রথম দিনগুলোতে, প্রতিটি শিল্পী ও লেখক কথা বলার জন্য নিজের ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে ফেলেছেন।

সেন্সরশিপ থেকে সংহতিতে

৭ অক্টোবরের ঘটনার পর পশ্চিমা শিল্প ও বিনোদনজগত ফিলিস্তিনের প্রতি যে আচরণ করেছে, তা ছিল ইউক্রেনের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত।

ইসরায়েলের প্রতি সংহতি জানাতে হলিউড তৎক্ষণাৎ সরব হয়ে ওঠে; ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলা শিল্পীদের নিষিদ্ধ করে দেয় নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বইমেলা। এবং চলচ্চিত্র উৎসবগুলোও এ বিষয়ে নীরবতাকেই বেছে নেয়।

আরব বিশ্বের বাইরের প্রেক্ষাপটে এটিই ছিল লেখকের দেখা সবচেয়ে বড় সেন্সরশিপ অভিযান।

যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা পশ্চিম বরাবরই গর্বের সঙ্গে প্রচার করেছে, তা আসলে এক মিথ্যে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়। আর সেই মুখোশ উন্মোচিত হয়েছিল ট্রাম্পের আগেই, যিনি পরে সেন্সরশিপকে উত্তর গোলার্ধের নতুন স্বাভাবিকতায় পরিণত করেন।

সেই সময়, তথাকথিত বৈচিত্র্যেময় রাজনীতির আড়ালে চেপে থাকা বর্ণবাদ যেন এক অজুহাত পেয়ে তার আসল রূপে বিস্ফোরিত হলো।

যুদ্ধের প্রথম দিকের সপ্তাহগুলোতে পশ্চিমা বিনোদনজগতে প্রকাশিত নানা লেখায় পরোক্ষে এই ধারণাই ছড়িয়ে পড়েছিল—এটা নাকি সভ্য ইসরায়েলিদের সঙ্গে বর্বর আরবদের লড়াই; প্রগতিশীল ইহুদিদের সঙ্গে তাদের পশ্চাৎপদ আরব প্রতিবেশীদের সংঘাত।

কিন্তু ফিলিস্তিনে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকায়, আর তাদের বাস্তব পরিস্থিতি ও অধিকারবঞ্চনার চিত্র বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট হতে থাকায়, জনমতও ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করে।

এই পুরো সময়জুড়ে একটি প্রশ্নই প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল, এত নিরীহ মানুষের প্রাণহানির পরই কি বিশ্বকে শেখাতে হলো, আসলে কী ঘটছে ফিলিস্তিনে?

তার মধ্যেও কিছু শিল্পী ও লেখক প্রথম থেকেই গাজার মানুষের পাশে দাঁড়ান। যেমন, মার্ক রাফালো, হাভিয়ের বারদেম, সুসান সার‍্যান্ডন, মেলিসা বারেরা, বেলা হাদিদ, দোয়া লিপা, ন্যান গোল্ডিন ও অ্যানি আর্নো তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

গাজায় ইসরায়েলি হামলাকে যখন মানবাধিকার সংস্থা ও বিভিন্ন রাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা করল, তখনই বহু তারকা সেই আন্দোলনে যুক্ত হন। অর্থাৎ, যখন আগ্রাসনকে আর কোনোভাবেই ন্যায্য বলা সম্ভব ছিল না।

এই তারকাদের অবস্থান জনমতকে কতটা প্রভাবিত করেছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে এতে সন্দেহ নেই যে, তাঁদের সম্পৃক্ততা ফিলিস্তিন ইস্যুকে এমনভাবে বৈশ্বিক আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছে, যা গত পঞ্চাশ বছরে দেখা যায়নি।

১৯৭৮ সালের অস্কার মঞ্চে অভিনেত্রী ভ্যানেসা রেডগ্রেভ ছিলেন একক কণ্ঠস্বর, সে সময় তিনি নির্ভয়ে ‘জায়নিস্ট গুন্ডাদের’ ভয়ভীতি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

আরব কণ্ঠের জন্য নতুন পরিসর

৯/১১–এর পর পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আরব ও ফিলিস্তিনিদের উপস্থাপনের ধরন বদলে যায়।

সে সময় সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে আরবদের যেভাবে ভয়ঙ্কর বা বিচিত্র এক জাতি হিসেবে দেখানো হতো, গত দুই দশকে সেই প্রবণতা অনেকটাই কমেছে। এখন বরং তাদের গল্প, তাদের অভিজ্ঞতা বোঝার জন্য নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে।

ফিলিস্তিনের গল্পও ক্রমে আমেরিকান ও ইউরোপীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। টেলিভিশনে Mo ও Ramy–এর মতো সিরিজ ফিলিস্তিনিদের বাস্তবতা ও সংগ্রামের চিত্র আরও বড় পরিসরে দর্শকদের সামনে তুলে ধরছে।

স্বাধীন ফিলিস্তিনি চলচ্চিত্র এখন ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে এবং বিশ্বের বড় বড় চলচ্চিত্র উৎসবেও জায়গা করে নিচ্ছে।

ফিলিস্তিনের লেখক, সংগীতশিল্পী ও চিত্রশিল্পীরা এখন যে কোনো সাংস্কৃতিক পরিসরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছেন।

৭ অক্টোবরের ঘটনার পর প্রথম বছরটা ফিলিস্তিনি শিল্পীদের জন্য ছিল বিপর্যয়ের, কিন্তু ২০২৫ সালের অক্টোবরে এসে চিত্রটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। ক্রমশ আরও বেশি শিল্পী, সংগীতশিল্পী ও তারকা প্রকাশ্যে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন।

ফিলিস্তিনি লেখকরা যেমন, ইয়াসমিন জাহের, বাসিম খানদাকজি, মুসআব আবু তোহা ও লিনা খালাফ তুফাহা, বিশ্বের মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্যসংস্থাগুলোর কাছ থেকে একের পর এক স্বীকৃতি ও সম্মাননা পাচ্ছেন। ফিলিস্তিনের পতাকা ও তরমুজের পিন এখন আটলান্টিকের উভয় তীরে মিউজিক ফেস্টিভ্যালে সাধারণ দৃশ্য হয়ে উঠেছে।

ধীরে ধীরে আরও হলিউড তারকা ফিলিস্তিনের সিনেমা সমর্থন করতে শুরু করেছেন। রাফালো ও বার্ডেম চেরিয়েন ডাবিসের All That’s Left of You-এর সঙ্গে জড়িত, আর ব্র্যাড পিট, জোয়াকিন ফিনিক্স, রুনি মারা ও আলফোনসো কুয়ারন কাওথার বেন হানিয়ার The Voice of Hind Rajab-এর সঙ্গে।

No Other Land প্রথম আরব গল্প হিসেবে অস্কার জিতেছে। ২.৫ মিলিয়ন ডলারের বক্স অফিস আয় এটিকে উত্তর আমেরিকায় সর্বোচ্চ আয় করা আরব সিনেমা হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।

৭ অক্টোবরের দুই বছর পরে, ডোরোথি চ্যান্ডলার প্যাভিলিয়নে যেখানে রেডগ্রেভকে জোরে তালি দেওয়া হয়েছিল, তিনি এখন আর নিঃসঙ্গ কণ্ঠ নন। এদিকে, বিনোদন জগতের প্রো-জায়নিস্ট লবি ক্রমে মার্জিনালাইজড এবং বর্জিত হয়ে পড়েছে।

ডার্টি মানি

পেন্ডুলাম স্পষ্টভাবে ফিলিস্তিনের পক্ষে দুলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে জরিপ অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতি সমর্থক মনোভাব ইতিহাসে ন্যূনতম স্তরে নেমে এসেছে।

সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও তাদের ইসরায়েলি সমকক্ষদের সম্পূর্ণভাবে বর্জন করতে চাইছে না, তবে রাষ্ট্র সমর্থিত ইসরায়েলি শিল্পীদের সঙ্গে সহযোগিতায় স্পষ্ট হ্রাস লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে যে অসংখ্য প্রতিবাদ ও অবিচল ‘গ্রাসরুট’ আন্দোলনগুলো হয়েছে, তা না হলে এই ঐতিহাসিক পরিবর্তন সম্ভব হতো না।

শিল্পকলা, বিনোদন ও হলিউড এখন এমন প্রতিক্রিয়াশীল শিল্পক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয়েছে যা উদার ও জ্ঞানী যুব সমাজের সঙ্গে তাল মিলানোর চেষ্টা করছে।

এই ব্যাপক পরিবর্তন তাদের উদ্যোগের ফল নয়… এটি জনগণের ইচ্ছা ও দৃঢ় বিশ্বাসের ফলাফল।

গাজা কি শিল্প ও বিনোদনে একটি ভয়ঙ্কর পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর এখনও নিশ্চিত নয়।

গত মাসের ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গাজা সম্পর্কিত যে অসংখ্য রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে দীর্ঘদিনের ফিলিস্তিনের সমর্থক, আমেরিকান অভিনেত্রী ইন্ডিয়া মুরের অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধানের নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে করা বক্তব্য বিশেষভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

শিল্প ও বিনোদনে অর্থায়ন সবসময়ই জটিল ও বিতর্কিত বিষয়, বিশেষ করে সিনেমায়, যা একাধিক উৎস ও বিচ্ছিন্ন বিনিয়োগকারীর ওপর নির্ভরশীল।

ডার্টি মানি প্রতিটি প্রজন্মে, প্রতিটি মহাদেশে চলচ্চিত্র প্রযোজনার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সমালোচক ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিরা এটিকে মাধ্যমের একটি অপ্রতিরোধ্য বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। যদি সন্দেহজনক বা নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ উৎসের অর্থ দিয়ে এমন শিল্পকর্ম তৈরি হয় যা বিনিয়োগকারীর অবস্থানের বিপরীত যায়, তাহলে ক্ষতি কী?

তবু, স্বাধীন স্ট্রিমিং কোম্পানি মুবি-এর ইসরায়েলি সামরিক সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত সেকোয়া ক্যাপিটাল-এর সঙ্গে অংশীদারত্বকে কেন্দ্র করে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তা চলচ্চিত্র অর্থায়নের পরিসর নিয়ে আরও প্রশ্ন তোলার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য

ইসরায়েলকে টার্গেট করা সবচেয়ে সহজ, কিন্তু চীন বা সৌদি আরবের কী হবে? শোষণমূলক কর্মপরিবেশে পরিচালিত মার্কিন কর্পোরেশনগুলো কী হবে? গাজা গণহত্যায় জড়িত রাষ্ট্রগুলোর—যেমন জার্মানি—সরকারি অনুদানগুলো কী হবে?

প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে, মিশরের মতো রাষ্ট্র-অর্থায়িত স্বৈরশাসক দেশ দ্বারা অর্থায়িত সিনেমা সমর্থন করা কি নৈতিক?

তুলনা করলে ইসরায়েল স্পষ্ট উদাহরণ। কিন্তু আমরা যদি আরও স্বাস্থ্যসম্মত ও নৈতিক বিনোদন শিল্প চাই, তাহলে এই জটিল ও বিভ্রান্তিকর প্রশ্নগুলোও করতে হবে।

চলচ্চিত্রে ফিলিস্তিনের পরবর্তী পথ

ফিলিস্তিনের গল্প আজ আগের চেয়ে বেশি দৃশ্যমান, তবে প্রকাশের সুযোগ এখনও সীমিত। গাজা, নাকবা এবং ঔপনিবেশিক বসতি স্থাপন ৭ অক্টোবরের পরের ফিলিস্তিনের গল্পগুলিতে সবচেয়ে স্বীকৃত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সশস্ত্র প্রতিরোধ, কিংবা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি, ইসরায়েলের আগ্রাসনের মতো জটিল বিষয় নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে, সম্ভাব্য অর্থদাতা এবং এমন দর্শকদের বাধার মুখে পড়তে হয়, যারা সূক্ষ্ম ও বহুমাত্রিক গল্প গ্রহণে অনাগ্রহী।

হানি আবু আসাদের Paradise Now (২০০৫)-এর আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, এলিয়া সুলেমানের Divine Intervention (২০০২)-এর আইডিএফের ওপর সহিংস আক্রমণের হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনা, বা তাওফিক সালেহের ক্লাসিক The Dupes (১৯৭২)-এর মতো আরব রাষ্ট্রদের ফিলিস্তিন আগ্রাসনের জন্য দায়ী সাব্যস্ত করা চলচ্চিত্র শিগগিরই অর্থায়ন বা প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন না।

সব মিলিয়ে বলতে গেলে, ফিলিস্তিনের গল্প এখন স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে চলচ্চিত্রজগতে। ৭ অক্টোবরের আগে ও পরের শিল্প-বিনোদনের জগত যেন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আজকের দৃশ্যপট আগের সঙ্গে মেলানোই কঠিন।

সহানুভূতি, ভালোবাসা ও জ্ঞানের শক্তি প্রমাণ করেছে যে, অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষেও আলো থাকে।

ফরাসি দার্শনিক সিমোন দ্য বোভোয়ার দ্য এথিকস অব অ্যামবিগুইটি বইয়ে লিখেছিলেন, ‘যে স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতা অস্বীকার করতে চায়, সেই স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করতে হবে।’

১৯৪৮ সাল থেকে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিকৃত ও চকচকে সংস্করণ ছড়িয়ে দেওয়ার যে স্বাধীনতা জায়নিস্ট রাষ্ট্র ভোগ করে এসেছে, আর ফিলিস্তিনের গল্পকে ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্তব্ধ করে রাখার যে ক্ষমতা তারা উপভোগ করেছে, তার অবসানের সময় এখন এসে গেছে।

ফিলিস্তিনের গল্প আর ভিকটিম হওয়ার নয়। ঘাসান কানাফানি যেমন বলেছিলেন, ‘ফিলিস্তিনের সংগ্রাম প্রতিটি বিপ্লবীর সংগ্রাম। যেখানেই সে থাকুক না কেন; এটি আমাদের সময়ের শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের লড়াই।’

গার্ডিয়ানের ভিডিওতে দেখা ইসরায়েলিদের উদাসীনতা এখন আর নিয়ম নয়, বরং ব্যতিক্রম।

লেখাটি মিডল ইস্ট আই-এ ১০ অক্টোবর ২০২৫ এ প্রকাশিত। 

লেখক: জোসেফ ফাহিম

একজন চলচ্চিত্র সমালোচক, কিউরেটর ও প্রভাষক। তিনি মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসব, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। আরব সিনেমা নিয়ে লিখেছেন একাধিক বই এবং মিডল ইস্ট আই, আল মনিটর, আল জাজিরাসহ নানা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে—যেমন সাইট অ্যান্ড সাউন্ড, ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ও বিবিসি কালচার—নিয়মিত লিখছেন। তার লেখা এখন পর্যন্ত আটটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

ঈষৎ পরিবর্তনসহ ইংরেজি থেকে তারিক তাশফিনের অনুবাদ

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন