মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

দীর্ঘ ৪৩ বছর পর হামা গণহত্যার বিভীষিকা নিয়ে মুখ খুলছে সিরিয়াবাসী

দীর্ঘ ৪৩ বছর পর হামা গণহত্যার বিভীষিকা নিয়ে মুখ খুলছে সিরিয়াবাসী
দীর্ঘ ৪৩ বছর পর হামা গণহত্যার বিভীষিকা নিয়ে মুখ খুলছে সিরিয়াবাসী। ছবি : আশ-শারকুল আওসাত

সিরিয়ার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায় হামা গণহত্যা। ১৯৮২ সালের এই নৃশংস ঘটনাটি ঘটার পর পেরিয়ে গেছে দীর্ঘ ৪৩ বছর, কিন্তু এখনো পর্যন্ত এর কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত হয়নি, দায়ীদের বিচার হয়নি, আর অজানাই রয়ে গেছে জোরপূর্বক গুম হওয়া হাজারো মানুষের ভাগ্য। বেঁচে ফেরা মানুষদের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা বা নিহতদের পরিবারের অসহনীয় যন্ত্রণারও কোনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেলেনি। এই হত্যাযজ্ঞে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ হাজার নিরীহ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারান। মানবাধিকার সংগঠন ‘সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস’-এর ভাষায়, এটি ছিল ‘একটি পূর্বপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় গণহত্যা’, যা পরিচালিত হয়েছিল সিরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর সরাসরি নির্দেশে।

দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে এই গণহত্যা নিয়ে কথা বলা ছিল একটি অঘোষিত নিষেধাজ্ঞার মতো। শাসকের রক্তচক্ষুর ভয়ে মানুষ মুখ বন্ধ করে রেখেছিল, স্মৃতি চাপা পড়ে ছিল আতঙ্কের অন্ধকারে। কিন্তু সেই নীরবতার দেয়াল ভাঙতে শুরু করেছে সিরিয়াবাসী। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর, সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদের মস্কোয় পালিয়ে যাওয়ার পর এবারই প্রথমবারের মতো হামা গণহত্যার স্মরণে সরব হয়েছে দেশটি।

বাশার আল-আসাদ ছিলেন সিরিয়ার প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-আসাদের ছেলে। বাবার মৃত্যুর পর টানা ২৫ বছর সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন তিনি। তার শাসনামলে ছিল নিরঙ্কুশ দমন-পীড়ন, যেখানে হামা গণহত্যার মতো ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা ছিল জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু আসাদের পতনের পর সেই ভয়-নির্ভর শাসনের অবসান ঘটেছে, আর সেইসঙ্গে সাহসী হয়ে উঠেছে জনগণের কণ্ঠস্বর।

এখন সিরিয়ার রাস্তাঘাটে, চায়ের দোকানে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং গণমাধ্যমে হামা গণহত্যা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বেঁচে ফেরা প্রত্যক্ষদর্শীরা সাহস করে নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছেন, আর নিহতদের পরিবারগুলো দাবি তুলছে ন্যায়বিচারের। এই স্মরণ শুধু একটি ঘটনাকে মনে রাখার জন্য নয়, বরং বিচার, জবাবদিহি এবং সত্য উন্মোচনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

এই গণহত্যার স্মরণে প্রকাশ্যে আসা প্রতিটি কণ্ঠ যেন প্রতিধ্বনিত করছে একটিই বার্তা—আর কোনো নিরবতা নয়, সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য এখনই সময় কথা বলার। সিরিয়ার জনগণ চায়, এই ইতিহাস আর চাপা না থাকুক, নতুন প্রজন্ম জানুক সেই ভয়াবহ অতীত, যেন আর কোনো স্বৈরাচারী শাসকের হাতে এমন ট্র্যাজেডি পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

এই গণহত্যার পেছনের ঘটনা শুরু হয় ১৯৮২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। সিরিয়ার তৎকালীন শাসক হাফিজ আল-আসাদ মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি বিদ্রোহ দমনে শুরু করেন ২৭ দিনব্যাপী রক্তাক্ত সামরিক অভিযান। ১৯৮০ সালে তাঁর ওপর চালানো এক ব্যর্থ হত্যাচেষ্টার জেরেই এই অভিযান পরিচালিত হয়।

রক্তাক্ত অভিযানের নৃশংসতা: প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ভয়াবহতার ছবি
সেই অভিযানে হাফিজ আল-আসাদের ভাই রিফআত আল-আসাদের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী হামা শহরে অবিরাম গোলাবর্ষণ করে এবং নির্বিচারে হত্যা করে হাজারো বেসামরিক মানুষকে। ফরাসি সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামার বাসিন্দা হাইয়ান হাদিদ নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

হাইয়ান জানান, ‘আমার কোনো সম্পর্ক ছিল না মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে, কিন্তু কেবল আমাদের পরিবারের নামই ছিল আমাদের দুর্ভোগের কারণ।’ সেই সময়ে তিনি ছিলেন স্কুলের ছাত্র। হাইয়ান বলেন, ‘আমার বাবা সবসময় আতঙ্কে থাকতেন, ভাবতেন কখন বিপদ আসে আমাদের ওপর।’

হাইয়ানের এক আত্মীয়, মারওয়ান হাদিদ, ছিলেন মুসলিম ব্রাদারহুডের সশস্ত্র শাখা ‘আল-তালিয়া আল-মুকাতিলা’-এর কমান্ডার, যিনি ১৯৭৬ সালে কারাগারে মারা যান। অভিযানের ১৩তম দিনে সরকারি বাহিনী হাদিদের বাড়ি ঘিরে ফেলে এবং প্রায় ২০০ জন পুরুষকে ধরে একটি কারিগরি স্কুলে নিয়ে যায়। রাতের বেলা প্রায় ৪০ জনকে আলাদা করে তাঁদের হাত পেছনে টেলিফোনের তার দিয়ে বেঁধে ট্রাকে তোলা হয়।

হাইয়ান বলেন, ‘গন্তব্যে পৌঁছে আমি আমার প্রতিবেশীকে বলি, ‘এটা তো কবরস্থান।’ উত্তরে সে বলে, ‘তাহলে আমাদের হত্যা করা হবে।’ সত্যিই তাই হয়। দুই সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা সৈন্যরা একযোগে গুলি চালায় আমাদের ওপর।’

গোলার আঘাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যান হাইয়ান। ‘আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, নড়াচড়া করিনি। এটা কোনো সচেতন কৌশল ছিল না। ঠিক কীভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম, জানি না।’ মৃত্যুনিশ্চিত করতে সৈন্যরা কাছ থেকে গুলি করছিল, তবে হাইয়ানের কাছে আসা সৈন্যটি কোনো কারণে গুলি চালায়নি। ‘সেদিন আমার গায়ে লাল রঙের পাজামা ছিল। হয়তো সে ভেবেছিল আমি ইতোমধ্যেই মারা গেছি।’

বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতা আজও হাইয়ানের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে রেখেছে। ‘এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছিল বুঝতে যে আমি সত্যিই বেঁচে আছি। চারপাশে ছিল কুকুরের ঘেউঘেউ, গুলির শব্দ আর বৃষ্টির ঝরঝরানি।’ এরপর তিনি হাঁটতে হাঁটতে পাশের সেরিহিন গ্রামে পৌঁছান। ভোরের দিকে আবার হামায় ফিরে গিয়ে তাঁর চাচার বাড়িতে আশ্রয় নেন, যেখানে আরও সাতটি পরিবার লুকিয়ে ছিল।

আন্তর্জাতিক নীরবতা ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি
সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস (এসএনএইচআর) সম্প্রতি এক বিবৃতিতে হামা গণহত্যার সত্য উন্মোচন এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থার পরিচালক ফাদেল আব্দুল গানি ‘আশ-শারকুল-আওসাত’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘হামা গণহত্যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দায়মুক্তির সংস্কৃতির একটি বড় ব্যর্থতার উদাহরণ।’

তিনি বলেন, ‘এই গণহত্যা দেখিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা কতটা দুর্বল। গণহত্যা, জোরপূর্বক গুম এবং নিপীড়নের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পরও কোনো কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই ব্যর্থতাই সিরিয়ায় পরবর্তী দশকগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পথ সুগম করেছে, বিশেষ করে ২০১১ সালের বিপ্লবের সময় থেকে যে নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছে।’

নতুন সরকারের জন্য ন্যায়বিচারের চ্যালেঞ্জ

আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ান নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস মনে করে, এই ‘বন্ধ ফাইল’ পুনরায় খোলা নতুন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। সংস্থার বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গণহত্যার ঘটনার সত্য উন্মোচন, দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ক্ষতিপূরণ এবং এই ইতিহাসের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান এখন সময়ের দাবি।’

ফাদেল আব্দুল গানি বলেন, ‘হামা গণহত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজন এবং ভবিষ্যতের জাতীয় পুনর্মিলনের জন্য অপরিহার্য। ন্যায়বিচার ছাড়া একটি সুদৃঢ়, শান্তিপূর্ণ ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি কেবল স্বৈরশাসনকে শক্তিশালী করে এবং নিপীড়নমূলক শাসনকে পুনরুত্পাদন করে। তাই সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে এই অধ্যায়টি সমাপ্ত করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে এমন নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব

মানবাধিকার সংগঠনগুলো মনে করে, শুধু সিরিয়ার নতুন সরকার নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও এই গণহত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক নীরবতা এবং কার্যকর পদক্ষেপের অভাবই দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে।

এই গণহত্যার স্মরণ এবং ন্যায়বিচারের জন্য নতুনভাবে উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুধু সিরিয়ার অতীত ইতিহাসের জন্যই নয়, বরং ভবিষ্যতের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং ন্যায়বিচারের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে। সিরিয়ার জনগণ এখন চায়—বিচার, জবাবদিহিতা এবং একটি নতুন শুরু, যেখানে ন্যায়বিচার হবে সবকিছুর শীর্ষে।

সর্বশেষ