মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

কে এই ইয়াসির আবু শাবাব? কী তার অপরাধ?

৫ জুন ইসরায়েল প্রকাশ্যে স্বীকার করে, তারা আবু শাবাবের গ্রুপকে অস্ত্র দিচ্ছে। একই সময়ে আবু শাবাব ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, তাঁর বাহিনী পূর্ব রাফা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং হামাসকে ‘হটিয়ে দিয়েছে’।
ইয়াসির আবু শাবাব
ইয়াসির আবু শাবাব

গাজা উপত্যকার রাফার পূর্বাংশে সশস্ত্র মিলিশিয়ার নেতা ইয়াসির আবু শাবাবকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা হত্যা করেছে, বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও।

রেডিওর খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের ধারণা আবু শাবাবকে হত্যা করেছে তাঁর নিজের লোকজনেরই কেউ। সেনাবাহিনীর রেডিওকে এক সূত্র জানায়, আবু শাবাবের মৃত্যু ইসরায়েলের জন্য নেতিবাচক।

ইসরায়েলের চ্যানেল ১২–এর বরাতে এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেন, অভ্যন্তরীণ বিরোধের জেরে পাওয়া আঘাতে সোরোকা হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়।

আল জাজিরার প্রতিবেদক ফাতিমা খামাইসি জানান, আবু শাবাবকে নিয়ে তথ্য এখনো নিশ্চিত না। নানা উৎসে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। তবে ইসরায়েলি গণমাধ্যম বলছে, কথিত ‘পপুলার ফোর্সেস’-এর নেতা ইয়াসির আবু শাবাবকে হত্যা করা হয়েছে।

তথ্য অনুযায়ী, তাঁকে হত্যা করেছে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর রেডিও এক সামরিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলছে, হামাসের কাছে আবু শাবাব সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য ছিল।

আল জাজিরার প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আবু শাবাব দক্ষিণ রাফাহ এলাকায় অবস্থান করছিল এবং ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করছিলেন। দখলদার বাহিনী তাঁর মাধ্যমে রাফায় এমন একটি প্রশাসনিক কাঠামো গড়তে চাইছিল, যা হামাসের প্রভাবমুক্ত হবে। তবে ফিলিস্তিনি জনমনে এর বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি ছিল। তা সত্ত্বেও দখলদার বাহিনী তাঁকে সুরক্ষা দিচ্ছিল।

ইয়াসির আবু শাবাব, ১৯৯০ সালে রাফাতে জন্ম নেওয়া একজন ফিলিস্তিনি, তোরাবিন গোত্রের সদস্য। সাত অক্টোবরের আগে সে ইসরায়েলি কারাগারে আটক ছিল। ইসরায়েল যখন নিরাপত্তা সংস্থার কার্যালয়গুলোতে বোমা হামলা চালায়, এরপরই সে মুক্তি পায়।

৩০ মে ২০২৫-এ রাফার পূর্বাঞ্চলে কাসসাম ব্রিগেড ‘মুস্তারিবিন’ বাহিনীর একটি ইউনিটকে টার্গেট করে হামলা চালালে তার নাম আলোচনায় আসে। পরে জানা যায়, ওই ইউনিটের সঙ্গে দখলদার বাহিনীর হয়ে কাজ করা একটি চক্রও ছিল, যাকে প্রতিরোধ বাহিনী ‘ইয়াসির আবু শাবাব চক্র’ বলে উল্লেখ করে।

আবু শাবাবের বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধ

মে ২০২৪-এর রাফা অভিযানের সময় থেকেই আবু শাবাবের নেতৃত্বাধীন গ্রুপের ভূমিকা ছিল স্পষ্ট। ‘সুরক্ষা প্রদান’–এর নামে তারা কেরেম শালোম সীমান্ত দিয়ে আসা সাহায্যের ট্রাক দখল করতে শুরু করে। এতে গাজার মানুষ খাদ্য ও জরুরি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। এখান থেকেই হামাস ও পপুলার ফোর্সেসের মধ্যে উত্তেজনা ছড়াতে থাকে।

সেপ্টেম্বরে হামাস আবু শাবাবকে টার্গেট করে হামলা চালালেও ভুলবশত ৯০ রাউন্ড গুলি গিয়ে লাগে সাহায্যকর্মী ইসলাম হিজাজির গাড়িতে।

১৬ নভেম্বর ২০২৪-এ পপুলার ফোর্সেস সরাসরি ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষকতায় ১০৯টি ইউএন সাহায্যের ট্রাকের কনভয়ে হামলা চালায়। এর মধ্যে ৯৮টি ট্রাক লুট হয়। গ্রেনেড ছোড়া হয়, চালকদের বন্দুক ঠেকিয়ে মাল নামাতে বাধ্য করা হয়। ইউএনআরডব্লিউএ এই ঘটনাকে গাজার সবচেয়ে ভয়াবহ লুট বলে উল্লেখ করে।

নভেম্বরে ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করার কারণে তার নিজের পরিবারও তাকে ত্যাগ করে। পরে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবু শাবাব স্বীকার করেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তাঁর গ্রুপ অন্তত অর্ধ ডজন ত্রাণের ট্রাক লুট করেছে।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে হামাস তাঁর এক সিনিয়র সহযোগীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

মে ২০২৫–এ পপুলার ফোর্সেস ইউএন ও রেডক্রসের কনভয় ‘সুরক্ষা’ দেয়ার কথা বলে নিজেদের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু হামাস এটিকে ইসরায়েলের সঙ্গে তার যোগাযোগ আড়াল করার কৌশল হিসেবে উল্লেখ করে।

৫ জুন ইসরায়েল প্রকাশ্যে স্বীকার করে, তারা আবু শাবাবের গ্রুপকে অস্ত্র দিচ্ছে। একই সময়ে আবু শাবাব ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, তাঁর বাহিনী পূর্ব রাফা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং হামাসকে ‘হটিয়ে দিয়েছে’।

এরপর ৯ জুন পপুলার ফোর্সেস আইডিএফের সঙ্গে মিলে ইসরায়েল–মার্কিন সমর্থিত সাহায্য বিতরণকেন্দ্রের পথে যাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালায়। এতে ৬ থেকে ১৪ জন নিহত হয়, আর আহত হয় অন্তত ১০০ জন। একই দিন হামাস গুপ্তচরবৃত্তি ও হত্যার অভিযোগে তাদের কমান্ডার ইসাম নাবাহিনকে আটক করে।

১০ ও ১১ জুন টানা দুই দিন পপুলার ফোর্সেস হামাসের ‘অ্যারো ইউনিট’–এর ওপর অ্যাম্বুশ চালায়।

২ জুলাই হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদ্রোহের অভিযোগে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। ৬ জুলাই আবু শাবাব স্বীকার করে, তাঁর গ্রুপ ইসরায়েলি সমর্থন পাচ্ছে।

২৭ জুলাই হামাস-সমর্থিত রাদ’আ ফোর্স তাঁর ছয় সহযোগীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। ২১ সেপ্টেম্বর হামাস তাঁর তিন সহযোগীকে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

২৮ সেপ্টেম্বর তাঁর আরও একজন অপারেটিভের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির পর হামাস তাঁর গ্রুপের সদস্যদের গ্রেপ্তার শুরু করে।

১৩ অক্টোবর তাঁর প্রধান নিয়োগকারী আহমদ জিদান আল তারাবিনকে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

২১ অক্টোবর রাদ’আ ফোর্স তাঁর আরও বহু সহযোগীকে আটক করে।

২৬ নভেম্বর আবু শাবাব দাবি করে, হামাসের চার যোদ্ধা তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং সে তাদের আইডিএফের হাতে তুলে দিয়েছে।

অক্টোবর-নভেম্বর সময়কালে তাঁর গ্রুপ নারী চিকিৎসক তাসনিম আল হামসকে অপহরণ করে ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়। এটা তাঁর বিশ্বাসঘাতকতার আরেকটি নজির হিসেবে গাজায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

এই পুরো সময়জুড়ে আবু শাবাবের কর্মকাণ্ড, মানবিক সহায়তা লুট, ইসরায়েলের সহায়তা গ্রহণ, নিজস্ব স্বার্থে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে দেওয়া, গাজার মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে আরও বাড়িয়েছে। এসবই তাঁকে গাজায় এক গাদ্দার ও অন্ধকার চরিত্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করে।

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন