সুদানের আল ফাশের শহর দখলে র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের (আরএসএফ)-এর সহিংস অভিযানে থেকে বেঁচে ফেরা নারীরা বর্ণনা করেছেন ভয়াবহ যৌন সহিংসতা, নির্যাতন আর হত্যার দৃশ্য।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলকে (ইউএনএফপিএ) দেওয়া সাক্ষাৎকারে তারা জানিয়েছেন, কেউ হেঁটে পৌঁছেছেন ৫০ কিলোমিটার দূরের তাওইলা শহরে, কেউ আবার ১,৫০০ কিলোমিটার দূরের আদ দাব্বাহ পর্যন্ত। নয় দিনের এক কষ্টকর যাত্রায়।
আমিনা নামের এক নারী বলেন, ‘রাস্তায় লাশ পড়ে ছিল সর্বত্র, মৃত মানুষে ভরা ছিল চারপাশ। অনেক শিশু পরিবার হারিয়ে রাস্তায় ঘুরছিল। আমাদের চোখের সামনেই হচ্ছিল ধর্ষণ, মানুষ খুন।’
ফাতিমা বলেন, আল ফাশের থেকে পালানোর পথে পিঠে তার মেয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে মেয়ের সামনে মারধর করা হয়।
‘ওরা আমার মেয়েকে পিঠ থেকে নামাতে, তারপর আমাকে বেত্রাঘাত করতে শুরু করে। মোবাইল ফোন দিয়ে বুকের ওপর আঘাত করেছিল। আমার বাচ্চারা চিৎকার আর কান্না শুরু করে,’ বলেন ফাতিমা।
সোরায়া বলেন, পালানোর সময় তিনি ও আরও কয়েকজন নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হন। অনেক নারীকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের অমানবিকভাবে তল্লাশি করেছিল। একজন পুরুষ যখন কোনো নারীকে এভাবে স্পর্শ করে—সে তো তার স্ত্রী নয়, তবু এভাবে হাত বাড়ায়, এটা কীভাবে মেনে নেওয়া যায়?’
তিনি বলেন, ‘তারা রাস্তায় অনেক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। আমরা পালিয়ে আসার পথে অসংখ্য মৃতদেহ ফেলে এসেছি। যারাই তাদের হাতে পড়েছে সবাইকে হত্যা করেছে।’
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) জানিয়েছে, র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) আল ফাশের দখল নেওয়ার পর শহরের প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার বেসামরিক নাগরিকের মধ্যে ৮২ হাজারের মতো মানুষ পালিয়ে যেতে পেরেছেন।
বাকি সবাই এখনো শহরে আটকা। স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, সম্প্রতি শহর থেকে বেরোনোর একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ আরএসএফ বন্ধ করে দিয়েছে।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের হিউম্যানিটারিয়ান রিসার্চ ল্যাব নিশ্চিত করেছে, শহরের চারপাশে তৈরি অস্থায়ী দেয়ালের কাছে পালাতে চাওয়া সাধারণ মানুষদের আরএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে। সেই দেয়ালের পাশে পড়ে আছে কয়েকজনের লাশ, আর কাছেই কিছু মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
আমিরা জানান, তরুণ ও সবল পুরুষদের জোর করে স্বীকার করানো হয়েছে যে তারা সেনাসদস্য। এরপর তাদের হয় আটক করা হয়েছে, নয়তো হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের যে দলটি আল ফাশের থেকে পালিয়েছিল, সেখান থেকে ৬০ জন তরুণকে ধরে নিয়ে গেছে। আমার স্বামী এখনো নিখোঁজ। আমরা জানি না তিনি কোথায়, বেঁচে আছেন কি না।’
সুরাইয়াও জানেন না তার ১৬ বছর বয়সী যমজ ছেলেদের কী হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি আল ফাশেরে আমার ছেলেদের হারিয়েছি। জানি না তারা জীবিত না মৃত।’
তিনি বলেন, পালানোর সময় সব টাকা-পয়সা আর জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।
নাদিয়া জানান, ‘তারা আমাদের জমি আর ফসল সব পুড়িয়ে দিয়েছে। ভেড়া, গাধা, গরু সব কিছু নিয়ে গেছে। আমাদের হাতে কিছুই রাখেনি।’
নাদিয়ার ছেলে শহিদ হয়েছেন। তিনি বলেন, “তারা আমার কাছ থেকে যা-ই নিয়ে যাক, ছেলের মৃত্যুর যন্ত্রণার মতো কষ্টের আর কিছু নয়। সে স্কুলের শিক্ষক ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিল, পুরো পরিবারের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। তারা তাকে হত্যা করেছে।’
দুই সপ্তাহ আগে আরএসএফ যখন আল ফাশের দখল করে, তখন তারা গণহত্যা ও নৃশংসতা চালায়। এর কিছু দৃশ্য তাদের নিজেদের যোদ্ধারাই ভিডিও করে রেখেছিল, যা স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমেও নিশ্চিত হয়েছে।
বেঁচে ফেরা একাধিক ব্যক্তি মিডল ইস্ট আই-কে জানিয়েছেন, আরএসএফ সন্ত্রাসীরা বেসামরিক মানুষদের ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতন করেছে।
সুদানের যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিলে। এরপর থেকেই নির্বিচারে সাধারণ মানুষদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে সন্ত্রাসী আরএসএফ। এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত কয়েক দেড় লাখ মানুষ নিহত হয়েছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ।
মিডল ইস্ট আই–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত লিবিয়া, চাদ, উগান্ডা ও সোমালিয়াজুড়ে বিস্তৃত একটি জটিল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করছে।
যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আরএসএফের বিরুদ্ধে দারফুরে গণহত্যাসহ ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই











