মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

মালির কি পতন হতে চলেছে ?

রাজধানী বামাকোতে মালির সেনাবাহিনী এবং জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন (JNIM) এর যোদ্ধাদের মধ্যে টানা সংঘর্ষ চলছে। সংগঠনটি প্রথমবারের মতো সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
মালির কি পতন হতে চলেছে ?
মালির কি পতন হতে চলেছে ?

মালিতে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। রাজধানী বামাকোতে মালির সেনাবাহিনী এবং আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র সংগঠন জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমীন (JNIM) এর যোদ্ধাদের মধ্যে টানা সংঘর্ষ চলছে। প্রথমবারের মতো এই সংগঠন সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ওপর চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

এর আগে সংগঠনটির উপস্থিতি রাজধানী থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরবর্তী অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। এখন সংঘর্ষ বামাকোর ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ায় নতুন করে আলোচনা তৈরি হয়েছে। 

২০২০ সালের আগস্টে ঘটে যাওয়া অভ্যুত্থানের পর মালি যে সংকটে পড়েছে, তা এখন আর কেবল নিরাপত্তা সংকট নয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জটিলতা এ সংকটকে আরো তীব্র করেছে। ক্ষমতার বৈধতা, প্রভাব বিস্তার এবং অভ্যন্তরীণ-আঞ্চলিক শক্তির প্রতিযোগিতা দেশের অস্থিতিশীলতাকে দীর্ঘায়িত করেছে।

গত পাঁচ বছর ধরে চলমান অন্তর্বর্তী শাসনব্যবস্থার মধ্যে বারবার নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই শূন্যতা কাজে লাগিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীসহ স্থানীয় শক্তিশালী পক্ষগুলো।

মানবিক পরিস্থিতিও ক্রমেই খারাপের দিকে। উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে বেসরকারি নাগরিকদের ওপর সেনাবাহিনীর হামলা বেড়ে যাওয়ায় বহু মানুষ নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতিক্রিয়াতেও বলতে গেলে ঐক্য নেই। 

এই প্রতিবেদনে বর্তমান পরিস্থিতির মূল কারণ, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ভূমিকা, সংঘর্ষের অগ্রগতির ধারা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। 

জামা’আত নুসরাতুল ইসলামি ওয়াল মুসলিমিন নিয়ে আমরা কী জানি?

সাহেল অঞ্চলের নিরাপত্তা ভারসাম্যে গত কয়েক বছরে সবচেয়ে প্রভাবশালী জিহাদি শক্তিতে পরিণত হয়েছে জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ও মুসলিমিন। বিশেষ করে মালি, বুর্কিনা ফাসো ও নাইজারে হামলার মাত্রা বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে গোষ্ঠীটির প্রভাব বেশ শক্তিশালী। এসব রাষ্ট্র তাদের অগ্রযাত্রা থামাতে ক্রমেই অক্ষম হয়ে পড়ছে।

গোষ্ঠীটির শক্তির মূল উৎস এর জোটভিত্তিক কাঠামো। ২০১৭ সালে স্বতন্ত্রভাবে পরিচালিত পাঁচটি সংগঠনকে একত্রিত করে এটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আনসার আদ দীন, মাসিনা ব্রিগেড, আল মুরাবিতুন এবং আল কায়েদা ইন দ্য ইসলামিক মাগরেব। নেতৃত্বে রয়েছেন ইয়াদ আগ ঘালি ও আমাদু কুফা। এই কাঠামো স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটিকে বহুমাত্রিক সামাজিক সংযোগ এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও গোত্রের সম্পর্ক কৌশলগতভাবে কাজে লাগানোর সুযোগ দিয়েছে।

উত্তর ও মধ্য মালিকে ভিত্তি করে সক্রিয় এই গোষ্ঠী সময়ের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও অভিযান বিস্তৃত করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে আটলান্টিক উপকূলবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে সেনেগাল ও মৌরিতানিয়ার সীমান্ত এলাকায় সাতটি সামরিক স্থাপনায় সমন্বিত আক্রমণ গোষ্ঠীটির সামরিক সক্ষমতার নতুন রূপ সামনে নিয়ে আসে। এতে স্পষ্ট হয়, তারা আর শুধু গেরিলা কৌশলে নয়, বরং আরও সংগঠিত ও কৌশলগত সামরিক অভিযান পরিচালনায় সক্ষম হয়ে উঠেছে।

শুধু সামরিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও এ সশস্ত্র গোষ্ঠির উত্থান ঘটেছে। তারা ছোট স্বর্ণখনি অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উৎপাদনের ওপর কর আরোপ করে। পাশাপাশি যাকাত এবং স্থানীয় ব্যবসায় বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি ধারাবাহিক অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এতে তারা স্থানীয় সমর্থন ও আনুগত্য—দুটোই অর্জন করতে পেরেছে।

রাষ্ট্রীয় উপস্থিতি দুর্বল হওয়া এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাওয়ায় গোষ্ঠীটির সামাজিক প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে। প্রান্তিক এলাকায় তারা শরিয়াভিত্তিক বিচারব্যবস্থা চালু করেছে, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে, বেহায়াপনার প্রসার রোধে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারের কাজ করছে। ফলে গোষ্ঠীটি কেবল সশস্ত্র শক্তি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় শূন্যতা পূরণকারী সামাজিক শক্তি হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

এর ফল হিসেবে সাহেল অঞ্চলে নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বহু মানুষের আস্থার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে গোষ্ঠীটি। মানুষ রাষ্ট্রীয় আদালত বা প্রশাসনের বদলে তাদের দ্বারস্থ হচ্ছে বিচার ও সমাধানের জন্য।

মালির সংকট কেন আরও জটিল হচ্ছে

মালির বর্তমান অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে, যেখানে রাজনীতি, নিরাপত্তা আর অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে, সংকট থেকে বেরোনোর পথ ক্রমেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উত্তেজনা এখন এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যদি এ ধারা চলতেই থাকে, তবে দেশটির ভেতরের ভারসাম্যই পাল্টে যেতে পারে।

২০২৫ সালের ৪ জুলাই অন্তর্বর্তী জাতীয় পরিষদ সামরিক শাসনকে কার্যত স্থায়ী করে তোলে। তারা অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আসিমি গোইতার মেয়াদ পাঁচ বছরের জন্য বাড়ায়, চাইলে আবারও নবায়নের সুযোগ থাকবে, তাও কোনো নির্বাচন ছাড়াই। এর আগে সরকার সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে দেয়। অর্থাৎ দেশে এখন একদলীয় ব্যবস্থা কার্যকর, যার বৈধতা টিকে আছে কেবল অভ্যুত্থানের ভিত্তিতে।

এই সিদ্ধান্তগুলো জনগণের আস্থা আরও হ্রাস করেছে, ভেতরের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছে। অনেকের কাছে এখন পরিষ্কার, শাসকগোষ্ঠী ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে পড়ছে।

নিরাপত্তার দিক থেকেও দেশটি ভয়াবহ সংকটে আছে। সম্প্রতি একযোগে এমন সব হামলা হয়েছে, যা সেনাবাহিনীর টিকে থাকার সামর্থ্য নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে। জুলাই মাসে পশ্চিমাঞ্চলের সাতটি ঘাঁটিতে বড় হামলার পর টিমবুক্তু আর বোলকেসির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিও টার্গেট হয় ইসলামি স্বাধীনতাকামীদের। 

২০২৪ সালে আলজিয়ার্স চুক্তি বাতিল হওয়ার পর উত্তরাঞ্চলে তুয়ারেগ গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে লড়াই আবার শুরু হয়। এর মধ্যে রাশিয়ার প্রভাব ওয়াগনার থেকে আফ্রিকান লিজিয়ন-এর হাতে যাওয়ায় বাইরের সহায়তাও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ফলে মালির সেনারা এখন আরও চাপের মুখে।

অর্থনৈতিক অবস্থাও দ্রুত অবনতির দিকে। রাজনৈতিক অস্থিরতা আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ গভীর সংকটে পড়েছে। নুসরাতুল ইসলাম ও মুসলিমিনের অবরোধে জ্বালানি পরিবহন বন্ধ, রাজধানী প্রায় অচল। পণ্যের দাম বেড়ে আকাশছোঁয়া, বাজারে লেনদেন স্থবির।

ইকোওয়াস জোট থেকে সরে আসার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। দেশটি অর্থনৈতিক সুবিধা হারিয়েছে, আন্তর্জাতিক সংযোগও প্রায় বিচ্ছিন্ন। এর প্রভাব পড়েছে প্রতিদিনের জীবনে, বিদ্যুৎ সরবরাহ অনিয়মিত, পরিবহন বন্ধ, স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ নিত্যপণ্য কিনছে কালোবাজার থেকে। গ্রামাঞ্চল আরও বিচ্ছিন্ন, সেখানে রাষ্ট্রের উপস্থিতি দুর্বল, আর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব ক্রমেই বাড়ছে।

সেনাবাহিনীর ভেতরেও স্থিতিশীলতা নেই। ১০ আগস্ট সরকার জানায়, অন্তত ২০ জন সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, অভিযোগ, তারা ২০২০ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা সামরিক পরিষদকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছিলেন। এতে সেনাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে, আর পাঁচ বছর ধরে চলা অস্থিরতা আরও গভীর হচ্ছে।

মালির সরকার কীভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে?

সংকট তৈরি হওয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়ার বদলে মালির সরকার শুরু থেকেই প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়। তারা ঘটনাকে সামাল দেওয়ার পরিবর্তে দায় চাপিয়ে দেয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর ওপর। সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়, এটা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্টের একটি বিদেশি ষড়যন্ত্র। 

সরকার ইকোওয়াস জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে ‘সার্বভৌম’ অবস্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করে। তাদের বক্তব্য, সংগঠনটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ দিচ্ছে। তাই জাতীয় সিদ্ধান্তকে সম্মান করতে হলে তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় থাকবেই।

কিন্তু এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সরকার অর্থনৈতিক বিচ্ছিন্নতার প্রভাব কমানোর জন্য কোনো বাস্তব পরিকল্পনা নেয়নি। রাজনৈতিক বক্তব্যের মাধ্যমে অবস্থান রক্ষার চেষ্টা দেখা গেছে, বাস্তবে সংকট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

সরকারি বক্তব্যে বারবার ‘অটল থাকা’ এবং ‘বাহ্যিক হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যানের’ কথা বলা হলেও নাগরিকদের দৈনন্দিন সংকট কমাতে কার্যকর সিদ্ধান্তের অভাবে তা কাগজে-কলমের অবস্থান হিসেবেই রয়ে গেছে।

ফলে পরিস্থিতি শান্ত করা তো দূরের কথা, বরং সরকারের ভাষ্য এখন ব্যর্থতার দায় অন্য পক্ষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার উপায় হয়ে উঠেছে। এমন সময়ে, যখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় স্পষ্ট। রাষ্ট্রীয় অদূরদর্শীতার সুযোগে জনগণের আস্থার জায়গা দখল করে নিচ্ছে জামা’আত নুসরাতুল ইসলাম ও মুসলিমিন।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অবস্থান

মালির নিরাপত্তা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাওয়ার ফলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। প্রতিক্রিয়াগুলো মূলত সংকটের ব্যাখ্যা ও ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা কতটুকু হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট বিভাজনই তুলে ধরছে।

পশ্চিমা দেশগুলো সতর্কতামূলক অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইতালি ও অস্ট্রেলিয়া তাদের নাগরিকদের দ্রুত দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছে। তারা জানাচ্ছে, জ্বালানি সংকটে বিপর্যস্ত বামাকোতে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল হতে পারে। পশ্চিমাদের ধারণা, মালি সংকট এখন কেবল অভ্যন্তরীণ নয়, বরং সীমান্ত পেরিয়ে পুরো অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, রাশিয়া পুরো পরিস্থিতিকে ভিন্নভাবে দেখছে। তারা ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে ‘ভ্রান্ত তথ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। বামাকোয় রুশ দূতাবাস পশ্চিমাদের সরিয়ে নেওয়ার আহ্বানকে সন্দেহের চোখে দেখছে। রাশিয়ার এই অবস্থান তাদের মালি-নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে আফ্রিকান লিজিয়নের উপস্থিতি ধরে রাখা ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বে ব্যর্থতার কোনো ইঙ্গিত না দেওয়াই অগ্রাধিকার।

আঞ্চলিক পর্যায়ে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে এমন এক সময়ে, যখন মালি ইকোওয়াস জোট থেকে বেরিয়ে এসেছে। সংস্থাটির নীরবতা আসলে রাজনৈতিক বৈধতা ও প্রভাব নিয়ে সরাসরি মুখোমুখি সংঘাতে না জড়ানোর কৌশল। বিশেষত এমন এক সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে, যেটা পশ্চিম আফ্রিকায় যৌথ চাপ প্রয়োগের প্রচলিত কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন সেনেগাল ও আইভরি কোস্ট, পরিস্থিতিকে বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের আশঙ্কা, সংকট সীমান্ত পেরিয়ে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো জ্বালানি বহর ও সীমান্ত অতিক্রমকারী সরবরাহ রুটে হামলা বাড়ানোর ফলে এ আশঙ্কা আরও তীব্র হয়েছে। যদি মালি নিয়ন্ত্রণ হারায়, তাহলে তা পুরো অঞ্চলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল সংকটে রূপ নিতে পারে।

দায় কার ওপর পড়ছে?

মালির ভেতরকার দুর্বলতা ও অস্থিতিশীলতার কারণগুলো একপাশে রাখলে, বামাকোর সরকারি অবস্থান মূলত বাইরের পক্ষগুলোর দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলছে। তাদের মতে, বিদেশি শক্তিগুলোই দেশের উত্তেজনা বাড়াচ্ছে এবং আল কায়েদা সম্পৃক্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে উৎসাহিত করছে। এসব অভিযোগের মূল লক্ষ্য ফ্রান্স, যাকে মালি সরকার মনে করে সাহেল অঞ্চলে হ্রাস পাওয়া প্রভাব ফিরিয়ে আনতে চায়। সরকারের ধারণা, ফ্রান্সকে মালির ক্ষমতার বলয় থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় প্যারিস এখন নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলার চেষ্টা করছে এবং পরোক্ষভাবে নতুন সামরিক শাসনকে অস্থিতিশীল করার পথ তৈরি করছে।

দ্বিতীয় যে দেশটির নাম অভিযোগে উঠে এসেছে, তা হলো আলজেরিয়া। ২০২৪ সালে মালি ‘আলজেরিয়া চুক্তি’ বাতিল করার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্কে স্পষ্ট টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত উত্তর মালির পুরোনো সংঘাত আবার উসকে দিয়েছে এবং বিদ্যমান শেষ রাজনৈতিক সমঝোতার কাঠামোকে দুর্বল করেছে। ফলে, আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে নয়, বরং উত্তরাঞ্চলে সংঘাত ফের জ্বলে ওঠার কারণ ব্যাখ্যা করার অংশ হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি পশ্চিমা দেশের বিরুদ্ধেও আংশিক অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থান মূলত পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার প্রভাব-সংঘাতের প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছে। রাশিয়া বর্তমানে ‘আফ্রিকান লিজিয়ন’-এর মাধ্যমে মালিতে সরাসরি সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখছে, যা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

সব মিলিয়ে, মালির সামরিক কর্তৃপক্ষ সংকটটিকে কেবল অভ্যন্তরীণ ভাঙন বা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার ফল হিসেবে নয়, বরং সাহেল অঞ্চলে আন্তর্জাতিক প্রভাব-প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চাইছে। ফলে, দেশের সংকট বোঝার ক্ষেত্রে বাইরের শক্তিগুলোকেই এখন প্রধান দায়ভার বহনকারী হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।

বামাকো কি পতনের পথে?

জামা‘আত নুসরাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাম্প্রতিক অভিযানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। রাজধানী বামাকোর উপকণ্ঠেও তাদের উপস্থিতি সামনে এসেছে। সংগঠনটির অবস্থান এখন রাজধানী থেকে মাত্র প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে। তা সত্ত্বেও কিছু বিশ্লেষকের মতে নিকট ভবিষ্যতে বামাকো সরাসরি পতনের ঝুঁকিতে নেই। তবে বর্তমান অগ্রগতির ধারায় অনেকেই মনে করছেন পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে পারে।

সংগঠনটি এখনো পুরোপুরি সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়নি। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ রাখা কিছু দুর্বল সীমান্তপথ ব্যবহার করে যোদ্ধা ও মানবসম্পদ আনতে পারছে। বিস্তৃত সীমান্ত এলাকায় উপস্থিতি বজায় রাখায় মালির সেনাবাহিনী চাপে রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, সংগঠনটির যোদ্ধা সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার সীমা টিকিয়ে রাখার সক্ষমতাও বাড়ছে। তবে বিমান হামলা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের কাছে নেই। ফলে আকাশপথে হামলা হলে তারা দুর্বল অবস্থায় পড়তে পারে।

ভূখণ্ড ও অভিযানের ক্ষেত্র বিস্তৃত হলেও সংগঠনটির সরঞ্জাম, লজিস্টিকস ও পূর্ণ সামরিক সক্ষমতা এখনো পুরোপুরি সুসংহত নয়। এর পাশাপাশি আঞ্চলিক সমন্বিত প্রতিরোধের সম্ভাবনাও আছে। সাহেল জোট পরিস্থিতি গুরুতর হলে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে সামরিক সমন্বয় বাড়াতে পারে। অন্যদিকে আইএসের উপস্থিতিও পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।

সাহেল অঞ্চলে এর প্রভাব যেমন হতে পারে 

মালির চলমান সংকট সাহেল রাষ্ট্রগুলোর জোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। নাইজার, বুরকিনা ফাসো ও মালিকে নিয়ে গঠিত এই জোটে এখন বামাকোই মূল কেন্দ্রবিন্দু। শুধু ভৌগোলিক কারণে নয়, পশ্চিমা প্রভাব থেকে সরে গিয়ে বিকল্প অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রক্রিয়ায় মালি সবচেয়ে এগিয়ে থাকায় তার গুরুত্ব বেড়েছে।

ফরাসি বাহিনীকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে এবং মস্কোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়িয়ে বামাকো তার কৌশলগত অবস্থান নতুনভাবে সাজিয়েছে। এই অবস্থান থেকে নাইজার ও বুরকিনা ফাসোকে সে স্বাভাবিক সহযোগী হিসেবে পেয়েছে, যাদের সবার লক্ষ্য জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

২০২৩ সালে প্রতিরক্ষা চুক্তি হিসেবে যাত্রা শুরু করা এই জোট এক বছরের মধ্যেই রূপ নিয়েছে কনফেডারেশনে। এর উদ্দেশ্য হলো পুরনো আঞ্চলিক কাঠামো—বিশেষ করে ইকোওয়াস জোট—থেকে বেরিয়ে এসে একটি স্বাধীন রাজনৈতিক, আইনি ও নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলা।

বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছন মালির বর্তমান সংকট জোটকে দুর্বল না করে বরং পশ্চিমনির্ভর পুরনো সমীকরণ থেকে মুক্তির পথকে আরও দ্রুততর করতে পারে।

এই জোট এখন আর কেবল একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানের ফল নয়; এটি রূপ নিচ্ছে একটি কৌশলগত রাজনৈতিক প্রকল্পে, যার লক্ষ্য পশ্চিম আফ্রিকার ক্ষমতার ভারসাম্যকে সার্বভৌমত্ব ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা।

মালির অভ্যন্তরীণ চাপ যত বাড়ছে, ততই জোটের সংহতি আরও শক্ত হচ্ছে। তারা এখন স্থায়ী ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তুলছে, যা পশ্চিম আফ্রিকার সাহেল অঞ্চলে এক নতুন মডেলের পথ খুলে দিতে পারে। যা আগামী কয়েক দশকে ক্ষমতার ভারসাম্য ও আঞ্চলিক মানচিত্রের চেহারা আমূল বদলে দিতে পারে। 

মোট কথা, দেশের অভ্যন্তরীণ জটিলতা ও বাইরের নানা প্রভাবের জালে মালির সংকট নিয়ে এখনই চূড়ান্ত মন্তব্য করা বা দ্রুত স্থিতিশীলতার আশা করা সময়োচিত নয়। 

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন