মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

গাজা গণহত্যায় ভারতের ভূমিকা: আদানি-এলবিট যৌথ উদ্যোগ

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা চলাকালীন ভারতীয় কোম্পানি আদানি-এলবিট অ্যাডভান্সড সিস্টেমস ইন্ডিয়া লিমিটেড ইসরায়েলকে ২০টিরও বেশি হার্মিস-900 ড্রোন সরবরাহ করে। এসব ড্রোন ভারতের মাটিতেই তৈরি হয়।
বেনয়ামিন নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদি
বেনয়ামিন নেতানিয়াহু ও নরেন্দ্র মোদি

২০২৪ সালের ২৩ জুন ইসরায়েলি সংবাদপত্র ইয়েদিয়োত আহরোনোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ভারত ইসরায়েলকে আর্টিলারি শেল ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করছে। সেখানে আরও বলা হয়েছে, ভারতের চেন্নাই বন্দর থেকে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের উদ্দেশে রওনা হওয়া অস্ত্র ও বিস্ফোরকবাহী একটি জাহাজকে তাদের বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে স্পেন সরকার।

এছাড়া বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ভারত ও ইসরায়েলের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত আদানি-এলবিট কোম্পানি ইসরায়েলকে উন্নত ড্রোন সরবরাহ করেছে। কুদস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা যায়, ইসরায়েলি বাহিনী গাজার নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে জাতিসংঘের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে যে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে, তার ধ্বংসাবশেষে ‘Made in India’ লেখা রয়েছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সম্পর্ক এখন শুধু বেসরকারি খাতে সীমাবদ্ধ নয়, সরকারি পর্যায়েও বিস্তৃত হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপ ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। ভারতের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির আওতায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে আদানি গ্রুপ।

২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘Link West Policy’ ঘোষণা করেন, যার আওতায় ভারত পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। ভারতের আদানি গ্রুপ ইসরায়েলের হাইফা বন্দর অধিগ্রহণসহ প্রতিরক্ষা খাতে যৌথ উদ্যোগে নানা ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, যেসব গাজার যুদ্ধের গতিপথে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা চলাকালীন ভারতীয় কোম্পানি আদানি-এলবিট অ্যাডভান্সড সিস্টেমস ইন্ডিয়া লিমিটেড ইসরায়েলকে ২০টিরও বেশি হার্মিস-900 ড্রোন সরবরাহ করে। এসব ড্রোন ভারতের মাটিতেই তৈরি হয়।

ড্রোন তৈরির এই প্রকল্পটি ভারতের আদানি ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস ও ইসরায়েলের এলবিট সিস্টেমসের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) তৈরিতে বিশেষজ্ঞ এই প্রকল্প সামরিক খাতে ভারত–ইসরায়েল সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে।

ইসরায়েলের নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র রয়টার্স-কে জানিয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা চলাকালেও ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহে কোনো বাধা পড়েনি।

একজন ভারতীয় কর্মকর্তা রয়টার্স-কে বলেছেন,

‘ইসরায়েল নিশ্চিত করেছে যে, নয়াদিল্লি যে অস্ত্র কিনেছে, তার সরবরাহে কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। এর মধ্যে ড্রোনের বিভিন্ন উপকরণও অন্তর্ভুক্ত।’

২০২৪ সালের মে মাসে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম জানায়, স্পেন সরকার ভারতের চেন্নাই বন্দর থেকে রওনা হওয়া একটি অস্ত্রবাহী জাহাজকে তাদের বন্দরে নোঙর করতে দেয়নি।

একটি স্প্যানিশ সংবাদপত্র জানায়,

‘ডেনমার্কের পতাকাবাহী ওই জাহাজে ২৭ টন বিস্ফোরক ছিল, যা ভারতের চেন্নাই থেকে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।’

ভারত সরকার ইসরায়েলে সামরিক সহায়তা নিয়ে প্রকাশিত কোনো প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থেকেছে। একইভাবে, ইসরায়েল সরকারও এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেয়নি।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম The Wire-কে আদানি গ্রুপের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়,

‘ড্রোন রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।’

অন্যদিকে, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা কোম্পানি এলবিট সিস্টেমস-এর একজন মুখপাত্র বলেন,

‘আমরা নিশ্চিত করছি যে, ‘এলবিট সিস্টেমস’ এবং ‘আদানি’ একসঙ্গে মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) উৎপাদনে কাজ করছে। তবে বিশেষ কোনো চুক্তির বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’

গাজা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতের নৌপরিবহন শ্রমিকদের সংগঠন, যা বিশ্ব শ্রমিক ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত এবং দেশের ১১টি প্রধান সমুদ্রবন্দরের প্রতিনিধিত্ব করে তারা ঘোষণা দেয়,

‘ইসরায়েল বা যে কোনো দেশ  গাজা যুদ্ধে ব্যবহৃত সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন করবে, তাদের জন্য অস্ত্রবোঝাই পণ্য লোড বা আনলোড করা হবে না।’

আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড এক বিবৃতিতে জানায়, তারা গাজার যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং তাদের ব্যবসায়িক ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

২০২২ সালে, আদানি গ্রুপ ইসরায়েলের হাইফা বন্দরের ৭০% শেয়ার অধিগ্রহণ করে। এই বন্দর বর্তমানে ইসরায়েলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। ভারতের সাতটি রাজ্যের ১৩টি সমুদ্রবন্দর পরিচালনায় নিয়োজিত আদানি গ্রুপ ভারত-ইসরায়েল বাণিজ্য সম্পর্ক আরও জোরদার করছে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামুদ্রিক নিষেধাজ্ঞার মুখে নয়াদিল্লি বিকল্প পথ অবলম্বন করেছে। সাধারণত, ভারতের চেন্নাই বন্দর থেকে ইসরায়েলে যাওয়া জাহাজ গলফ অফ এডেন ও লোহিত সাগর (Red Sea) পেরিয়ে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে। কিন্তু হুথি বিদ্রোহীদের সম্ভাব্য হামলা এড়াতে ভারত আফ্রিকার দক্ষিণ দিক ঘুরে জাহাজটি স্পেনে পাঠায় এবং সেখান থেকে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে হাইফা বন্দরে পৌঁছানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে।

ভারত ও ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক সরকারি ও বেসরকারি খাতের সমন্বয়ে আরও শক্তিশালী হয়েছে। আদানি–এলবিট যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির আওতায় সামরিক সরঞ্জামের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে, হাইফা বন্দর চুক্তি ভারত–ইসরায়েলের কৌশলগত সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

যুদ্ধ চলাকালেও ভারতীয় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ইসরায়েলে পৌঁছানো অব্যাহত রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছে।

ভারত সরকার এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য না করলেও, গাজার যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট,

১. সামরিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশল অনুসরণ করা।

২. আদানি গ্রুপের বাণিজ্যিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা।

এই কৌশলের ফলে ভারত ও ইসরায়েলের সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হচ্ছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন