মধ্যপ্রাচ্য অর্ডার করতে ক্লিক করুন

সুদানে আরব আমিরাতের স্বার্থ কী, কেন তারা আরএসএফ মিলিশিয়াদের অবাধ অস্ত্র দেয়

এর সমাধান আসলে খুবই সহজ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া। আরএসএফ অস্ত্র, অর্থায়ন এবং রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য এই দেশটির ওপরই নির্ভরশীল। 
মুহাম্মদ বিন যায়েদ এবং হামিদতি । ছবি : সংগৃহীত
মুহাম্মদ বিন যায়েদ এবং হামিদতি । ছবি : সংগৃহীত

সুদানের সামরিক বাহিনী ও র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (RSF)-এর মধ্যে সংঘর্ষের ২৯ মাস অতিক্রম হয়েছে। এই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রায় নীরব দর্শকের মতো কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। জাতিসংঘ এই সংঘাতকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকট হিশেবে বর্ণনা করেছে। উত্তর দারফুরে পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপর্যয়কর। আরএসএফ গত ১৮ মাস ধরে এই প্রদেশের রাজধানী আল-ফাশের শহরে ৪ লাখের বেশি মানুষকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। শহরে প্রবেশের চেষ্টাকারী ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো নিয়মিত শিকার হচ্ছে ড্রোন হামলার ।

তা সত্ত্বেও জাতিসংঘের সর্বশেষ সাধারণ অধিবেশনে বিশ্বের কোনো নেতাই আল-ফাশেরে এই সর্বাত্মক অবরোধের বিষয়টি উল্লেখ করেননি। বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট পক্ষ এই অবরোধ অবসানের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা ব্যাহত করছে; আর সেটি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত, যারা আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে।

একটি প্রতিবেদন অনুসারে, সংযুক্ত আরব আমিরাতই সংঘাত নিরসনে গঠিত অনানুষ্ঠানিক গোষ্ঠী ‘কোয়ার্টেট’ (চতুর্পাক্ষিক)-এর একমাত্র সদস্য, যারা অবরোধ অবসানের চুক্তিতে পৌঁছাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি সম্প্রতি একটি মসজিদে আরএসএফ-এর হামলায় ৭৫ জন মুসল্লি নিহতের ঘটনার নিন্দাজ্ঞাপনেও বাধা দেয়। আমিরাত এই অভিযোগসহ আরএসএফ-কে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের অভিযোগ অস্বীকার করেছে, যদিও এই দাবির সপক্ষে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ রয়েছে।

সংঘাত শুরু হওয়ার এক বছর পর রাউল ওয়ালেনবার্গ সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস একটি স্বাধীন তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যাতে শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। তদন্তে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয় যে, আরএসএফ দারফুরের অ-আরব সম্প্রদায়, বিশেষ করে মাসালিত উপজাতির বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে।

আমাদের তদন্তে উঠে এসেছে, কীভাবে আরএসএফ যোদ্ধারা বর্ণবাদী ও অমানবিক ভাষা ব্যবহার করে অ-আরব গোষ্ঠীগুলোকে নির্মূল করার অভিপ্রায় পদ্ধতিগতভাবে প্রকাশ করে এবং পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। এর অগণিত উদাহরণ আছে। বেঁচে ফেরা একজন নিশ্চিত করেছেন যে, তাকে বলা হয়েছিল: ‘তুমি যদি মাসালিত হতে, তবে আমরা তোমার শিশুদেরসহ কাউকেই বাঁচিয়ে রাখতাম না।’

২০২৩ সালে, আরএসএফ পশ্চিম দারফুরের আল-জুনাইনা শহর অবরোধ করে হামলা চালায়। এতে তারা সরাসরি মাসালিত সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু বানায়, যার ফলে প্রায় ১৫,০০০ মানুষ নিহত হয়। চলতি বছরের এপ্রিলে আল-ফাশেরের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আরএসএফ সুদানের বাস্তুচ্যুতদের বৃহত্তম শিবিরে (আইডিপি ক্যাম্প) অভিযান চালায় এবং একই ধরনের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি করে। তারা ১,৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে এবং ৪ লাখের বেশি মানুষকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করে। বেঁচে ফেরা ব্যক্তিরা বলেছেন, আরএসএফ-এর লক্ষ্য ছিল তাদের নির্মূল করা।

সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সুদানের সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। তারা শুধুমাত্র দুটি প্রস্তাব পাস করেছে, যাতে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং অবরোধ অবসানের আহ্বান জানানো হয়েছে, কিন্তু এই আহ্বানগুলোকে সমর্থন করে কোনো সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া রাখা হয়নি।

এর সমাধান আসলে খুবই সহজ, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুখোমুখি অবস্থান নেওয়া। আরএসএফ অস্ত্র, অর্থায়ন এবং রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য এই দেশটির ওপরই নির্ভরশীল। 

বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফ-এর জন্য একটি প্রধান সরবরাহ লাইন খুলেছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মাধ্যমে (ইয়েমেন, লিবিয়া ও ইথিওপিয়াতেও ইউএই-এর বিরুদ্ধে একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে) বিমানযোগে ভারী অস্ত্র, গোলন্দাজ এবং ড্রোন পরিবহন করা হচ্ছে। এই ফ্লাইটগুলো গোপনে হলেও সুদানের ওপর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেল (যা অত্যন্ত সতর্ক একটি তদন্ত সংস্থা) সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং আরএসএফ-এর মধ্যে কার্গো বিমানের নিবিড় প্রচারাভিযান নিশ্চিত করেছে এবং পরে এটিকে ‘একটি নতুন আঞ্চলিক আকাশসেতু’ হিশেবে উল্লেখ করেছে।

দারফুরের ওপর আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের বিষয়টি এড়াতে সংযুক্ত আরব আমিরাত অস্ত্র চোরাচালানের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। আন্তর্জাতিক নজরদারি এড়াতে আমিরাত অবৈধ অস্ত্র পাচারের সাধারণ কৌশলগুলো ব্যবহার করছে। যার মধ্যে আফ্রিকার চাদ প্রজাতন্ত্রে তাদের বিমান ঘাঁটিটিকে একটি মেডিকেল কমপ্লেক্স এবং রেড ক্রিসেন্টের মানবিক মিশনের আড়ালে লুকিয়ে রাখা রয়েছে।

ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সংযুক্ত আরব আমিরাত অস্ত্রের চালান লুকাতে ফ্লাইটের নথি জাল করেছে এবং জাতিসংঘের অনুরোধ করা সন্দেহভাজন ফ্লাইটের রেকর্ড হস্তান্তর করতে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে, এবং  তারা নির্ধারিত সময়সীমা মানতে অক্ষম মর্মে অজুহাতে দেখিয়েছে। উগান্ডার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, তাদেরকে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে চাদে আসা ফ্লাইটগুলো পরিদর্শন বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একটি ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আমিরাতের ফ্লাইটগুলো উড্ডয়নের সময় রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে বা আনুষ্ঠানিক নিবন্ধন ছাড়াই উড্ডয়ন করছে।

যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত দাবি করেছে যে, তারা সুদানে ইসলামিক রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন ঠেকাতে চাইছে। বাস্তবে তারা সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে সুদানের মূল্যবান সম্পদ, বিশাল সোনার মজুদ, কৃষি, প্রাণিসম্পদ এবং লোহিত সাগরের বন্দরগুলোর অ্যাক্সেস সুরক্ষিত করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত স্বর্ণ বাণিজ্যের একটি পরিচিত আন্তর্জাতিক কেন্দ্র। এক দশকে তারা অনুমোদনবিহীন আফ্রিকান সোনা আমদানি করেছে প্রায় ১১৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যের। ফলে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে তাদের এই ন্যারেটিভ ধোপে টেকে না, বিশেষ করে যখন আরএসএফ নিজেই ইসলামপন্থীদের হাতে তৈরি।

সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফ নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হামিদতি)-কে আতিথেয়তা দিয়েছে এবং তার সাথে আমিরাতের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান এবং মনসুর বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের মতো ব্যক্তিদের সরাসরি যোগাযোগের চ্যানেল স্থাপন করেছে। আরএসএফ-এর অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে হামিদতির ভাইদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আরব আমিরাত-ভিত্তিক একটি সংস্থা আরএসএফ-এর পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বিদেশী ভাড়াটে সৈন্য নিয়োগ করে। আরএসএফ-এর সাথে যুক্ত ইউএই-ভিত্তিক সংস্থাগুলো অস্ত্র ও সোনা ক্রয় এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আরএসএফ-এর প্রতি সমর্থন বাড়াতে এবং তাদের নৃশংসতা ধামাচাপা দিতে মোহাম্মদ বিন জায়েদের এক উপদেষ্টার সাথে যুক্ত একটি সংস্থা হামিদতিকে ব্যক্তিগত বিমানে করে আফ্রিকান রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে দেখা করার জন্য সফরে পাঠিয়েছিল। কিছু মার্কিন কর্মকর্তার মতে, শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সাথে একটি বৈঠকে আরএসএফ-কে বস্তুগত সমর্থনের কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, ইয়েমেনে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য পাঠানোর কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফ-এর কাছে ঋণী।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থন ছাড়া আরএসএফ আল-ফাশেরের অবরোধ অব্যাহত রাখতে বা এই মাত্রায় নৃশংসতা চালাতে পারত না। আমিরাত যদি যুদ্ধবিধ্বস্তদের সমর্থনে সত্যি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, তবে তাদের অবশ্যই আরএসএফ-কে পিছু হটার আহ্বান জানাতে হবে। এই একটি পদক্ষেপই আল-ফাশেরকে শ্বাস ফেলার সুযোগ দেবে, যেখানে প্রায় অর্ধ মিলিয়ন বেসামরিক মানুষ খাদ্য সরবরাহ ছাড়াই আটকা পড়ে আছে এবং সবচেয়ে খারাপ কিছুর ভয়ে দিন কাটাচ্ছে।

আরো পড়ুন

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন