ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতীককে তারা পরিণত করেছে রাজনৈতিক অস্ত্রে। যে উৎসবগুলো একসময় ছিল আলো, রঙ আর আনন্দের, সেগুলো এখন অনেক জায়গায় শক্তি প্রদর্শন আর ভয় দেখানোর উৎসবে রূপ নিয়েছে।
মুসলমানদের ‘ভিনদেশি’ হিসেবে দেখানোর যে পরিবেশটা বহু বছর ধরে গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে এখন অনেক হিন্দু উৎসবই যেন প্রতি বছর একধরনের আধিপত্যের প্রদর্শনী হয়ে উঠছে। ধর্মের ভাষা নিঃশব্দে বদলে গেছে ঘৃণার ভাষায়।
বছরের পর বছর ধরে চলা এই সাম্প্রদায়িক প্রচারণা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সমাজকেও পরিণত করেছে এক ধরনের ক্ষোভ আর প্রতিশোধের মঞ্চে।
এ বছরের দীপাবলি উৎসব ঘিরে ঘৃণার রাজনীতির বৈশ্বিক রূপ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু ডানপন্থী অ্যাকাউন্ট দীপাবলির আনন্দ নয়, বরং এক বিকৃত উল্লাসে মেতেছে, যেখানে দীপাবলির আতশবাজিকে তুলনা করা হয়েছে গাজায় বোমা হামলার সাথে।
ভারতের জনপ্রিয় অনেকেই নেমেছেন এই অনৈতিক অন্ধকার প্রতিযোগিতায়। একসময়ের সাহসী চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত রাম গোপাল বর্মা ‘এক্স’-এ লিখেছেন, ‘ভারতে বছরে এক দিন দীপাবলি, আর গাজায় প্রতিদিনই দীপাবলি।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এই মন্তব্যটি এক বিকৃত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গণহত্যাও উৎসবের শুভেচ্ছাবার্তা হয়ে ওঠে। ইন্টারনেটজুড়ে এমন আরও বহু বার্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেখানে গাজার ধ্বংসযজ্ঞকে ব্যঙ্গের বিষয় বানানো হচ্ছে, তার ট্র্যাজেডিকে পরিণত করা হচ্ছে উদ্যাপনের গল্পে।
ইসলামবিদ্বেষী অবস্থান
যেখানে পরিকল্পিতভাবে ইসলামবিদ্বেষকে জনমতে রূপ দেওয়া হয়, সেই ভারতের ভূমি থেকে এমন বক্তব্য উঠে আসা কোনো নিছক কাকতাল নয়। আজকের বিশ্বে ইসলামবিদ্বেষী অনলাইন কনটেন্টের একটি বড় অংশের উৎস এই ভারতের ডিজিটাল পরিসর, যেখানে সংঘবদ্ধ ট্রল বাহিনী ও রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা পেজ ধর্মীয় আবেগকে ঘৃণার অস্ত্রে পরিণত করছে। ঘৃণা আর আবেগের এই সংমিশ্রণ এক অদ্ভুত রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করেছে, যা শুধু ভারতে নয় আন্তর্জাতিক পরিসরেও প্রভাব ফেলছে।
গাজা ইস্যুতে ভারতের ডানপন্থী কণ্ঠের উচ্চারণও সেই উগ্র মানসিকতার পরিচয় দেয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদীর চোখে গাজা শুধু দূরের কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়; সেটি যেন তাঁর কল্পিত মুসলমান ‘আক্রমণকারীর’ ওপর প্রতীকী বিজয়ের প্রতিচ্ছবি।
ইসরায়েলের উগ্র সামরিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে ভারতের এই মেলবন্ধন আদর্শগত। হিন্দুত্ববাদ ও জায়নবাদ—দু’টিই নিজেদের তুলে ধরে ‘শত্রু বেষ্টিত সভ্যতা’ হিসেবে, যারা টিকে থাকার জন্য লড়াই করছে। উভয়ই সহিংসতাকে বৈধতা দেয় আত্মরক্ষার নামে এবং মুসলমানদের চিত্রিত করে তাদের অস্তিত্বের শত্রু হিসেবে।
তাই যখন ভারতীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্টগুলো দীপাবলির আলোকে গাজার আগুনের সঙ্গে তুলনা করে, সেটি নিছক রুচিহীনতা নয়, বরং শ্রেষ্ঠত্ববাদের এক আন্তঃদেশীয় সংহতির প্রকাশ।
উৎসবের সাম্প্রদায়িকীকরণ এখন এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে সহিংসতা বা উত্তেজনা প্রায় স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হোলির সময় অনেক মসজিদে রঙ নিক্ষেপ ঠেকাতে ত্রিপল টাঙানো হয়। এটা দেশটি নিজের ঘোষিত সম্প্রীতির পথ থেকে কত দূরে সরে গেছে, তারই নীরব স্বীকারোক্তি।
রাম নবমীর শোভাযাত্রা প্রায় নিয়মিতভাবে দাঙ্গায় গড়ায়। মোটরসাইকেলে সশস্ত্র পুরুষরা বিকৃত স্লোগান তোলে, ইচ্ছাকৃতভাবে উসকানি দেয়, আর প্রায়ই নিশানা হয় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা।
আরও ভয়ংকর হলো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এসব আচারকে এখন ডিজিটাল পরিসরে টেনে নিয়েছে। উৎসব আর রাস্তায় থেমে থাকে না, চলতে থাকে পর্দায়, হ্যাশট্যাগে, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে। গাজাকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক দীপাবলি মিম, হোলিতে মুসলিম নারীকে নিপীড়নের ভিডিও, রাম নবমীতে রাস্তায় সহিংসতা উদ্যাপনের রিল—ঘৃণায় আচ্ছন্ন এক সমাজের এই হলো নতুন সাংস্কৃতিক রূপ।
এই ভার্চুয়াল সহিংসতায় অংশ নেওয়া মানে ‘হিন্দু জাতি’র প্রতি আনুগত্য দেখানো। আর তা প্রত্যাখ্যান করা মানে ঝুঁকি নেওয়া, দেশদ্রোহী, মুসলমানপন্থী বা আরও ভয়ংকর কিছু বলে চিহ্নিত হওয়া।
যেখানে ধর্ম ন্যায্যতা দেয় নিষ্ঠুরতাকে
এই সাংস্কৃতিক প্রকল্পের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। এটি সমষ্টিগত ধর্মভক্তিকে পরিণত করেছে সমষ্টিগত শাস্তিতে। লক্ষাধিক মানুষকে জুড়ে দিয়েছে এক কল্পিত আধিপত্য বোধের সাথে। যেখানে ধর্ম নিষ্ঠুরতাকে ন্যায্যতা দেয়, আর সহানুভূতিকে দেখা হয় বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে।
এর ফলে মুসলমানদের ভারতে, গাজায় কিংবা অন্য কোথাও, চিরকাল বসানো হয় শত্রুর আসনে; তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখানো বা দুঃখ প্রকাশ করাও হয়ে ওঠে অপরাধ। যখন দীপাবলির আতশবাজির উল্লাসের সঙ্গে গণহত্যার বোমাবর্ষণকে তুলনা করা হয়, তখন তা শুধু নির্মমতার প্রকাশ নয়—বরং এক আদর্শিক বার্তা, ‘আমাদের উৎসব-আনন্দ তোমাদের ধ্বংসের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে।’
এমন পরিবেশে উৎসব আর আনন্দের উপলক্ষ থাকে না। তা পরিণত হয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার এক পুনরাবৃত্ত আচার হিসেবে। যেখানে সহিংসতা, প্রতীকী হোক বা বাস্তব, ভক্তির প্রকাশ বলে গণ্য হয়।
নৈতিক অবক্ষয় আজ এতটাই গভীরে শেকড় গেড়েছে যে তা সমাজের শ্বাসপ্রশ্বাসে মিশে গেছে। প্রতি বছর প্রদীপ জ্বলে, আকাশ আতশবাজিতে রঙিন হয়ে ওঠে, চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের উল্লাস। কিন্তু সেই আনন্দের আবহেই মিশে থাকে বারুদের ধোঁয়া, আর তার সঙ্গে ভেসে আসে ঘৃণার গন্ধ। যেন এক জাতি, যে ঘৃণাকেই নিজের ঐতিহ্য বলে মেনে নিয়েছে। যার উৎসবের আলোও অন্যের অন্ধকারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
আজকের ভারতের ট্র্যাজেডি শুধু তার রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়, এর শিকড় গেঁথে আছে জাতির মানসিক গঠনেও। এক ধরনের উন্মাদনা জন্ম নিয়েছে, যেখানে মানুষ শিখছে অন্যের যন্ত্রণায় আনন্দ খুঁজতে, ধ্বংসের আগুনে উৎসবের আলো দেখতে, আর নিষ্ঠুরতার মধ্যেই জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে। যেখানে সহানুভূতি নয়, বরং নির্মমতাই হয়ে উঠেছে নতুন আদর্শ।
যখন কোনো সমাজ বোমাবর্ষণকে ঈশ্বরীয় প্রদর্শনী বলে উদ্যাপন করে, যখন তার উৎসব মুখর থাকে ঘৃণার স্লোগানে, আর শিল্পীরা মৃতদের নিয়েও ব্যঙ্গ করতে দ্বিধা করেন না—তখন তা নিছক রাজনৈতিক পচন নয়, বরং এক গভীর সভ্যতাগত অসুস্থতার ইঙ্গিত। এমন এক অসুস্থতা, যেখানে ধর্মের পবিত্রতা মুছে গিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ক্ষমতার উন্মাদনা, আর মানবিকতা পরিণত হয়েছে উপহাসের বস্তুতে।
ভারতের মুসলমানরা বহু দিন ধরেই গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে আসছেন। এই সংহতি কেবল ধর্মীয় আত্মীয়তার নয়, বরং এক গভীর নৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ—যেখানে তাঁরা গাজার যন্ত্রণায় খুঁজে পান নিজেদের প্রান্তিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। এই সহানুভূতিই হিন্দুত্ববাদী বৃত্তে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই ভারতীয় মুসলমানদের মানসিকভাবে আঘাত করতে, গাজাকে পরিণত করা হয় ব্যঙ্গের প্রতীকে।
এই নিষ্ঠুরতার উদ্দেশ্য স্পষ্ট। গাজায় নিহতদের নিয়ে ব্যঙ্গ করার পাশাপাশি, দেশে যাঁরা তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করছেন, তাঁদেরও হেয় করা। গাজার ধ্বংসযজ্ঞকে উৎসবের প্রতীকে পরিণত করে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ধর্মকে পরিণত করেছে এক আক্রমণাত্মক অস্ত্রে। উদ্দেশ্য, ভারতের মুসলমানদের উসকে দেওয়া। তাঁদের সংহতি ও সহমর্মিতাকে পরিণত করা প্রকাশ্য উপহাস ও বিদ্বেষের উপকরণে।
সূত্র: মিডল ইস্ট আই থেকে অনুদিত











