উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত পুরো গাজা উপত্যকাজুড়ে বিস্তৃত একটি দালাল মিলিশিয়া নেটওয়ার্ক সক্রিয় আছে। তারা অবাধে চলাচল করে তথাকথিত ‘হলুদ রেখা’-এর পেছনে, যা নিরাপত্তা সীমারেখা হিসেবে পরিচিত এবং যেখানে ইসরায়েলি বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।
এই গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সূত্র থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। যদিও তাদের কিছু নেতা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন, তবু ক্রমবর্ধমান প্রমাণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তারা এমন এলাকাগুলোতে সক্রিয়ভাবে চলাফেরা করছে যেগুলোতে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
এই দালাল মিলিশিয়া নেটওয়ার্কের প্রথম শাখা গড়ে ওঠে গাজার দক্ষিণ প্রান্তে। সেখানে ‘পপুলার ফোর্সেস’ নামে একটি দল অবস্থান নিয়েছে, যার নেতৃত্বে আছেন ইয়াসের আবু শাবাব। গত বছরের মে মাসে রাফাহ শহরে ইসরায়েলি সামরিক অভিযান চালানোর পর তিনি এই দলটি গঠন করেন।
এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুটি প্রধান অভিযোগ রয়েছে
প্রথমত, দক্ষিণ গাজায় প্রবেশ করা মানবিক সহায়তার একটি বড় অংশ লুট করে নেওয়া; দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা। ইসরায়েলি গণমাধ্যম এসব অভিযোগ স্পষ্টভাবে সামনে এনেছে, যদিও আবু শাবাব ও তাঁর দল তা দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।
বিতর্কিত এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র কার্যক্রম শুধু রাফাহতেই নয়, খান ইউনুসেও দেখা গেছে। সেখানে হুসাম আল আসতাল নামের এক ব্যক্তি নেতৃত্ব দিচ্ছেন আরেকটি মিলিশিয়াকে। তাঁর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, কারণ তাদেরকে এমন সব এলাকায় ভিডিওতে দেখা গেছে, যেগুলোতে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ নিষিদ্ধ যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ অনুযায়ী।
গত আগস্টে আল-আসতাল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন তাঁর নতুন গোষ্ঠীর নাম ‘সন্ত্রাসবিরোধী স্ট্রাইক ফোর্স’। তবে এই ঘোষণাকে ঘিরে নানা সন্দেহ দেখা দেয়, কারণ যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁকে ইসরায়েলের সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগে আটক রেখেছিল।
প্রভাব বিস্তার
গাজায় দালাল মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোর উপস্থিতি এখন আরও জটিল আকার নিচ্ছে। কারণ, নতুন এক প্রবণতা দেখা দিয়েছে, এই গোষ্ঠীগুলো আর নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকছে না; বরং সীমান্ত পেরিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।
পূর্ব গাজার শুজাইয়া এলাকায় রামি আদনান হাল্লাসের নেতৃত্বে একটি দল সক্রিয় রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তারা উত্তর গাজার কিছু এলাকার নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছে। এই ঘটনাটি স্পষ্ট করে দিচ্ছে, গোষ্ঠীগুলো এখন তাদের কর্মকাণ্ডের ভৌগোলিক পরিসর বাড়াচ্ছে এবং একে অপরের প্রভাবক্ষেত্রের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
এই সশস্ত্র কার্যক্রমের পরিধি সম্পূর্ণ হয় গাজার সবচেয়ে উত্তর প্রান্তে, যেখানে সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে প্রকাশ পায় এসব গোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং তাদের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্ভাব্য যোগসূত্র।
ওই অঞ্চলে আশরাফ আল-মানসি নেতৃত্ব দিচ্ছেন ‘পপুলার ফোর্সেস’ নামের এক দলকে, যা গঠিত হয় গত সেপ্টেম্বর মাসে বেইত লাহিয়া ও বেইত হানুন এলাকায়। এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ইয়াসির আবু শাবাবের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে, যা ইঙ্গিত দেয়, গাজার অভ্যন্তরে এই দালাল গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি সমন্বিত নেটওয়ার্ক বিদ্যমান।
প্রকাশিত ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে জ্বালানি, পানি ও খাদ্যসহ সহায়তা-কাফেলা উত্তর গাজার দিকে মানসির ঘাঁটির উদ্দেশে যাচ্ছে। সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হলো, এই কাফেলাগুলো এমন সব অঞ্চলে সক্রিয়, যা ইসরায়েলি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে বা সরাসরি তাদের নজরদারিতে ছিল। ফলে এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলি বাহিনীর সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
ইসরায়েলি সূত্রের দাবি, এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী বাস্তবে সহায়তা পায় সরাসরি ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা ‘শিন বেত’ (শাবাক) থেকে। পাশাপাশি, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ইলেকট্রনিক গোয়েন্দা ইউনিট ‘ইউনিট ৮২০০’ থেকেও তারা দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পায়। এসব তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, এই গোষ্ঠীগুলোর সৃষ্টি ও পরিচালনা একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার অংশ।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরপরই গাজার নিরাপত্তা সংস্থাগুলো অভিযান শুরু করে। তারা এমন সব দালাল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় যারা যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিল, সমাজে অস্থিরতা তৈরি করেছিল এবং দখলদার বাহিনীর হামলার সুযোগে বিভিন্ন অপরাধ করেছিল, যার শিকার হন বহু সাধারণ মানুষ।
গাজার নিরাপত্তা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, তারা শহরের এক প্রভাবশালী পরিবারের নেতৃত্বাধীন একটি দালাল মিলিশিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছে। এতে গোষ্ঠীর ৩২ সদস্য নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। আরও ২৪ জনকে আটক করা হয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে। অভিযানে গাজার নিরাপত্তা বাহিনীরও ৬ সদস্য শহিদ হয়েছেন।
সূত্র: আল জাজিরা





